মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রের যুদ্ধ by সেলিমা তাসনীম ছন্দা

'নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো' কিংবা 'অপরের সমস্যায় নাক গলানো' কাকে বলে শিখতে হলে আমেরিকার দ্বারস্থ হবে। জাপানে ভূমিকম্প-সুনামি, তেজস্ক্রিয়ার পরিমাণ নির্ধারণ, আরব বিশ্বে গৃহযুদ্ধ কিংবা বাংলাদেশে ড. ইউনূস_ কোথায় নেই আমেরিকা।


অথচ অনেক পরিবর্তনের বিশাল অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় এসেছিলেন বারাক ওবামা। তিনি এত আশাজাগানিয়া নেতা যে, ভাবা হয়েছিল বিশ্বের কাছে আমেরিকার ভাবমূর্তিই পরিবর্তন করে দেবেন। অন্তত, নতুন যুদ্ধ শুরু হবে না, এমন আশা ছিল। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে দূরত্ব কমবে এমন আশা ছিল আমেরিকার বাইরে। মুসলমান পিতার ঘরে জন্ম নেওয়া মুসলিম বিশ্বে কেটেছে যার কৈশোর, প্রতি চারজনে একজন আমেরিকান যাকে মুসলমান ধর্মে বিশ্বাসী বলে মনে করেন কেমন করে তিনি হবেন মুসলমানদের শত্রু? যুদ্ধ ঘোষণা করবেন মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে! নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, প্রত্যাশা তো ছিল ওবামা পৃথিবীতে শান্তির ঝরনা বইয়ে দেবেন। যুদ্ধ নয়, শান্তি_ এই তো ছিল স্লোগান। শুরুটা তো তেমনই ছিল। কিন্তু এখন নতুন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
আমেরিকার সাধারণ মানুষও আর যুদ্ধ চায় না। তারা নিজের ঘরে শান্তি চায়। তাদের প্রেসিডেন্ট সারা পৃথিবীর সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব নিয়ে বসে থাকুন এটা তাদের মোটেই পছন্দ নয়। এক একটি যুদ্ধে স্বজন হারানোর বেদনা আমেরিকার আকাশে-বাতাসে। আছে বিশ্বমন্দার ধাক্কা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা। দৈনন্দিন বাজার-ঘাট, পেট্রোলিয়ামসহ সবকিছুর মূল্যবৃদ্ধি। চারদিকে শুধু হতাশা আর অনিশ্চয়তা। এখন নিজের দিকে তাকানোর সময়, শুধুই নিজের দিকে। অথচ আমেরিকার চোখ আগের মতো এখনও বাইরের দিকেই।
ঘরে-বাইরে বিরোধিতার কারণেই লিবিয়ায় গাদ্দাফির বিরুদ্ধে অসহায় মানুষের পক্ষে অস্ত্র ধরতে অনেক চিন্তাভাবনা হয়েছে। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে বেনগাজির অসহায় মুক্তিকামী মানুষ খুশি হয়েছে। যেমন করে আমরা খুশি হয়েছিলাম একাত্তরে মিত্রবাহিনীর পদধ্বনি শুনে। ফ্রান্স ও ব্রিটেনসহ জাতিসংঘের অন্যান্য দেশের মতো আমেরিকাও তাদের বন্ধু রাষ্ট্র।
কিন্তু স্বপ্ন পূরণ হলে, মুক্ত হলে একনায়কতন্ত্র থেকে মুক্তি ও স্বাধীনতার মূল্য লিবিয়া কতটুকু দিতে পারবে_ তা নিয়ে সন্দিহান আমেরিকার মানুষ। আজকাল আধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে আরব বিশ্বে বা পৃথিবীর অনুন্নত সব দেশের মানুষ বিশেষ করে যুবসমাজ অনুপ্রাণিত হচ্ছে_ প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে নিজের সমাজের দিকে, নেতৃত্বের দিকে তাকাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি পারে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যেতে, আমরা কেন পারব না? তারা একনায়কতন্ত্র, রাজতন্ত্র ও পরিবারতন্ত্র থেকে বের হয়ে এসে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে চায়। চায় গণতন্ত্র। অথচ মানুষের মতো গণতন্ত্রেরও আছে শৈশব-কৈশোর। আমরা চোখ তুলে তাকালেই দেখব উন্নয়নশীল অনেক রাষ্ট্রই হাঁটি হাঁটি পা পা করে গণতন্ত্রের দিকে এগোচ্ছে। কোনো উন্নত বিশ্বের আলোকে যখন আমরা তাকাই তখন আশাবাদীই হই। সব দেশই একদিন অন্ধকারে ছিল। এই যে আমেরিকা এখন গণতন্ত্রের তীর্থভূমি, তার বয়স ২৩৫ বছর। তাই কারও হতাশ হওয়ার কিছু নেই। শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবেই।
আমেরিকার সংবিধান অনুযায়ী কোনো রাষ্ট্র সরাসরি দেশের কোনো ক্ষতির কারণ না হলে তার ওপর হামলা চালানো নিষিদ্ধ। যদিও আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ আমেরিকার কী? একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যাবে, কোনো রাষ্ট্রে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিশেষ করে শূন্যতা সৃষ্টি হলে আল কায়দা এসে সে স্থান পূরণ করে। আল কায়দা বা জঙ্গি কারও কাম্য নয়।
অনেকেই মনে করেন, আরব বিশ্বের তেলের জন্য হস্তক্ষেপ করতে চায় আমেরিকা। এমন ধারণা একেবারেই অমূলক। ওপেকের মাত্র চার ভাগ তেল আসে লিবিয়া থেকে। আসলে আমেরিকা মুক্তির স্বাদ দিতে চায়। সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়ানো গৃহযুদ্ধের দাবানল পৃথিবীকে রক্ষা করতে চায়। শরণার্থী বা রিফিউজিদের সংখ্যা কমাতে চায়। প্রেসিডেন্ট ওবামা একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। স্বপ্ন দেখেন মুক্ত পৃথিবীর। তাই নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা ও তুচ্ছজ্ঞান করে বিশ্ব মানবতার মুক্তির জন্য, গণতন্ত্রের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তার চলার পথ সুগম হোক। পেঁৗছে যাক গন্তব্যে এই আমাদের প্রত্যাশা।
 

No comments

Powered by Blogger.