কাঠের খুটখাট শব্দ ব্যস্ত কারিগর বেশ চাহিদা- রূপগঞ্জের পল্লীতে নৌকার হাট by মীর আব্দুল আলীম

নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের অজপাড়াগাঁয়ের পল্লীতে গড়ে উঠেছে নৌকার গ্রাম। আর এ নৌকার গ্রামকে ঘিরে বালু নদীর তীর ঘেঁষে জমে উঠেছে ব্যতিক্রমী নৌকার হাট। কাঠের খুটখাট আর নদীর পানির ছলাৎ-ছলাৎ শব্দ যে-কারও মনকে আবেগে ভরিয়ে দেবে। নৌকা তৈরির এ গ্রাম দু’টির অদূরেই বালু নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে ঐতিহ্যবাহী


নৌকার হাট। বর্ষা এলেই রূপগঞ্জের নয়ামাটি ও পিরুলিয়া এলাকায় নৌকা তৈরির ধুম পড়ে যায়। কারিগরেরা হয়ে পড়ে মহাব্যস্ত। কায়েতপাড়া নৌকার হাটটিতে তখন চলে নৌকা বেচাকেনার রমরমা ব্যবসা। এছাড়া গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের গোলাকন্দাইল বাজারে প্রতি বৃহস্পতিবার বসে নৌকার হাট। ইছাখালী-নগরপাড়া সড়কের অদূরেই নৌকার গ্রাম। এলাকা দুটি পানিতে ডুবে আছে। গ্রামগুলো পানির উপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে দ্বীপের মতো। আষাঢ় থেকে ভাদ্রÑ মাত্র তিন মাসের মৌসুমী ব্যবসা। চাহিদা যথেষ্ট, তাই কারিগরদের ব্যবস্থাও বেশি।
শুরুর ইতিহাস ॥ রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের পিরুলিয়া ও নয়ামাটি এলাকার কারিগরেরা স্বাধীনতারও আগে থেকে নৌকা তৈরি করে আসছে। কারও কারও মতে, এ এলাকার নৌকা তৈরির ইতিহাস প্রায় শতাব্দী প্রাচীন। পিরুলিয়া এলাকার অশীতিপর বৃদ্ধ অঞ্জনকুমার দাস বলেন, আমার জন্মের আগে থেইক্যা বাপ-দাদারা গয়না (নৌকা) বানাইয়া আইতাছে হুনছি। নয়ামাটি ও পিরুলিয়া ছাড়া গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের গোলাকান্দাইল, সাওঘাট এলাকার কারিগরেরা নৌকা তৈরি করে আসছে।
কারিগর কারা ॥ নৌকা তৈরির গ্রাম পিরুলিয়া ও নয়ামাটি বললেই সবাই চেনে। তবে এ এলাকা দু’টি গ্রামের ৯০ ভাগ মানুষই হিন্দু সম্প্রদায়ের। হিন্দুরাই দীর্ঘদিন ধরে নৌকা তৈরি করে আসছে। আশির দশকের পর নৌকা ব্যবসায়ী কমে যায়। অনেকে ভারত চলে যাওয়ায় এখনও দেড় শ’ পরিবার টিকে রয়েছে কোনমতে। সাওঘাট এলাকার কারিগর প্রদ্যুত কুমার সরকার বলেন, ‘আগে ব্যবসা ভালাই আছিল। অহন কাঠের দাম আর লোয়া (লোহা) পেরেকের দাম বাইড়া যাওনে লাভ কম অয়।’
কারিগরদের কথা ॥ পিরুলিয়া ও নয়ামাটি এলাকার নৌকা তৈরির কারিগরেরা এখন ভালই আছেন। নৌকা বিক্রি করে তাঁরা সংসার চালাচ্ছেন। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাচ্ছেন। বছর শেষে মোটামুটি লাভের মুখও দেখছেন। কথাগুলো একবাক্যে বললেন পিরুলিয়া এলাকার সত্যেন দাস। তাঁর ছেলে লেখাপড়া করছে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। নয়ামাটি এলাকার রমেশ দাস বলেন, ‘কই খারাপ তো নাইগো দাদা। মোডা ভাত- আর মোডা কাপড় পরবার পারি। এইডাই সুখ।
বর্তমান অবস্থা ॥ নৌকা তৈরির কারিগরদের অবস্থা এখন কিছুটা ভাটা পড়েছে। ’৯০ দশকের পর যান্ত্রিক সভ্যতা ফিরে আসায় নৌকার কদর কিছুটা কমে যায়। প্রতিবছর বর্ষায় নৌকা তৈরির ধুম চলে। তবে বন্যা হলে ব্যবসা ভাল হয় বলে জানালেন সুনীল দাস। তিনি বলেন, ’৮৮ আর ’৯৮ সালের বন্যায় অনেক টেহা লাব অইছিল।’ নয়ামাটি এলাকার নৌকার কারিগর রবি দাস বলেন, ‘কাডের দাম বাইড়া যাওনে লাভটা কম হয়। নাইলে ব্যবসা খারাপ না। আর স্টিলের নৌকার কারণে কিছুডা লছ অইতাছে। তারপরেও খারাপ নাই। ডাইল-ভাত খাইবার পারি।’
খরচ কত ॥ একেকটি নৌকা তৈরি করতে খরচ পড়ে ৯-১০ হাজার টাকা। আর মোটামুটি কাঠের নৌকা তৈরিতে খরচ পড়ে ৬-৭ হাজার টাকা। কথাগুলো বললেন নৌকার কারিগর তাপস দাস।
নৌকার হাটের কথা ॥ বালু নদীর তীর ঘেঁষেই কায়েতপাড়া বাজারে নৌকার হাট। বর্ষা মাসজুড়েই এ হাট জমে। ঢাকার নিম্নাঞ্চলসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্রেতারা নৌকা কিনতে আসেন। দামে সস্তা হওয়ায় এখানকার নৌকার কদরও বেশি। গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের গোলাকান্দাইল বাজারের সামনে বিলে জমে ব্যতিক্রমী নৌকার হাট। এ হাটে প্রতি বৃহস্পতিবারে প্রায় কয়েক হাজার নৌকা ওঠে। নৌকার হাট শুরু হয় নৌকা তৈরির গ্রামগুলোর কারিগরদের ঘিরেই। প্রতি বৃহস্পতিবার এ হাট জমে ওঠে। বৃহস্পতিবার এ হাটে কয়েক হাজার নৌকা ওঠে। ওঠে নৌকার বৈঠাও। গজারি কাঠের একেকটি নৌকার দাম পড়ে ১২-১৩ হাজার টাকা। আর কোষা ৭-৮ হাজার টাকা। বৈঠাগুলো ২শ’ থেকে ৩শ’ টাকায় বিক্রি হয়। নৌকা বিক্রেতা সুবল চন্দ্র দাস বলেন, ‘দাদু ব্যবসা ভালই, তয় পানি বেশি অইলে লাভ অয়।’ ঢাকার ত্রিমহোনী থেকে নৌকা কিনতে আসা ওমর আলী বলেন, এ হাটে সস্তায় নৌকা পাওয়া যায়। আড়াইহাজার থেকে নৌকা কিনতে আসা জিএম শহীদ বলেন, ‘এ হাটে নৌকার দাম কম। তাই এহান থেইক্যা কিনবার আইছি।’

No comments

Powered by Blogger.