লিউকোপ্লাকিয়া এবং ওরাল ক্যান্ডিডোসিস

লিউকোপ্লাকিয়া এবং ওরাল ক্যান্ডিডোসিস অর্থাৎ মুখের ছত্রাক সংক্রমণ দুটি রোগই মুখের সাদা সংক্রমণ। কিন্তু লিউকোপ্লাকিয়াকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্যান্সারের পূর্বাবস্থা অর্থাৎ প্রি-ম্যালিগন্যান্ট লিশন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তাই রোগ দুটির চিকিৎসার ক্ষেত্রে সবার সচেতন হতে হবে।


লিউকোপ্লাকিয়া সাদা হয়ে থাকে, কিনারা গোলাকার হয়। ওরাল ক্যান্ডিডোসিস সংক্রমণে মাঝখানে গোলাপী থাকে এবং কিনারায় সাদা প্যাঁচের মতো থাকে যে কারণে এগুলো কিনারায় সাদাটে রং দেখায়। কিনারা গোলাকার হয় এবং তালুতে বেশি দেখা যায়। ওরাল ক্যান্ডিডোসিস বা ছত্রাক সংক্রমণে রোগী খাদ্য চিবানোর সময় এবং খাবার গলধঃকরণের সময় ব্যথা অনুভব করে। কিন্তু লিউকোপ্লাকিয়ার ক্ষেত্রে রোগী কোনো ব্যথা অনুভব করে না। যেহেতু রোগী ব্যথা অনুভব করে না তাই সহজে ডাক্তারের কাছে রোগী যেতে চায় না। তাই লিউকোপ্লাকিয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ লিউকোপ্লাকিয়া দীর্ঘদিন যাবত মুখে বিদ্যমান থাকলে সেটি ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। এই কারণে লিউকোপ্লাকিয়ার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তাছাড়াও মুখের অভ্যন্তরে সাদা সংক্রমণ বা আলসার দেখা দিলে প্রথমে রোগ নির্ণয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোগীদের কোনো অবস্থাতেই ওষুধের দোকানে গিয়ে মুখস্থ কোনো মলম প্রয়োগ বা ভিটামিন গ্রহণ করা ঠিক নয়। মুখের রোগ নির্ণয়ে অহেতুক কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজন নেই। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।

বার বার মুখের আলসার কেন হয়?
মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তার কারণে মুখে আলসার বার বার দেখা দিতে পারে। এছাড়া দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার কারণেও মুখের আলসার প্রায়শই লক্ষ্য করা যায়। হারপিস ভাইরাস বছরের পর বছর শরীরে থাকতে পারে। এ ভাইরাস মুখের আলসার হিসেবে দেখা যায় যখন ভাইরাসটি উদ্দীপনা পায়। জ্বরজনিত কারণে, হরমোনের পরিবর্তন, স্ট্রেস ও সূর্যের আলোতে হারপিস ভাইরাস উদ্দীপিত হয়ে থাকে। ভিটামিন ‘বি’ এর অভাব হলে মুখে জ্বালাপোড়া ভাব অনুভূত হতে পারে। খাবার গলধঃকরণের সময়ও মাঝে মাঝে সমস্যা হতে পারে। গালের ভিতর মিউকাস মেমব্রেন ফ্যাকাসে দেখায়। ভিটামিন ‘বি’ এর অভাবের কারণে রক্তস্বল্পতা দেখা দিতে পারে। মারাত্মক ধরনের ভিটামিন বি১২ বা কোবালামিনের অভাব হলে স্নায়ুগত সমস্যা যেমন তাপভাব দেখা দিতে পারে। মারাত্মক ধরনের ভিটামিন ‘বি’ এর অভাব হলে এট্রপিক গ্লসাইটিস হতে পারে। এট্রপিক গ্লসাইটিস এর ক্ষেত্রে জিহ্বার টেস্ট বাডের ডিজেনারেশন হয়ে থাকে। ফলে জিহ্বার স্বাদ ঠিকভাবে পাওয়া যায় না। ক্রনস ডিজিজের ক্ষেত্রে মানবদেহে অস্ত্রের বা গাটের প্রদাহ দেখা দেয়, এর ফলে পাকস্থলী ও মুখে আলসার দেখা যায়। গ্লুটেন জাতীয় প্রোটিনের ইনটলারেন্সের কারণে সিলিয়াক ডিজিজ হয়ে থাকে। গ্লুটেন গম, রাই এবং বার্লিতে পাওয়া যায়। সিলিয়াক ডিজিজের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রান্তে প্রদাহ দেখা দেয়। বয়স্কদের ক্ষেত্রে সিলিয়াক ডিজিজে মুখে আলসার দেখা যায়। হরমোনের পরিবর্তনের কারণে মেয়েদের মাসিকের সময় মুখের আলসার দেখা যেতে পারে, আবার মাসিক বন্ধ হয়ে গেলেও মেনোপজের সময় আলসার হতে পারে। সাধারণ কারণগুলোর মধ্যে অতিরিক্ত সময় টুথব্রাশের কারণে বা শক্ত টুথব্রাশের কারণে বার বার মুখে আলসার হতে পারে। শক্ত খাবার চিবানোর কারণেও মুখে আলসার হতে পারে। আলসারেটিভ কোলাইটিস রোগীদের ক্ষেত্রেও মাঝে মাঝে মুখে আলসার দেখা যেতে পারে। তবে আলসারেটিভ কোলাইটিস রোগীদের চেয়ে ক্রনস ডিজিজের রোগীদের মুখের আলসার বেশি দেখা যায়। কারণ আলসারেটিভ কোলাইটিস রোগটি কোলনে অর্থাৎ বৃহদন্ত্রে সীমাবদ্ধ থাকে। আর ক্রনস ডিজিজের ক্ষেত্রে পরিপাকতন্ত্রের মুখ, পাকস্থলী, অন্ত্র এবং পায়ুপথসহ যে কোন অংশ আক্রান্ত হতে পারে। শুধু মাত্র ভুল মাউথ ওয়াশ ব্যবহারের কারণেও মুখে বার বার আলসার হতে পারে। আপনার মাউথ ওয়াশ প্রয়োজন আছে কিনা বা প্রয়োজন থাকলে কোনটি আপনার জন্য প্রযোজ্য তা অবশ্যই জেনে নিতে হবে।

থ্যালাসেমিয়া রোগে মুখের সমস্যা
থ্যালাসেমিয়া একটি জীনবাহিত বংশগত রোগ। বাবা মায়ের কাছ থেকে এ রোগ সন্তানের শরীরে প্রবেশ করে। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার শতকরা ১০ ভাগ লোক থ্যালাসেমিয়া রোগের জীন বহন করছে এবং শতকরা চার ভাগ লোক থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত যাদের প্রতি মাসে রক্ত নিতে হয়। থ্যালাসেমিয়া রোগে এক বা একাধিক গ্লোবিন চেইনের সিনথেসিস বা সংশ্লেষণ বাধাপ্রাপ্ত হয় ফলে হিমোগ্লোবিন উৎপাদনের পরিমাণ কমে যায় এবং রোগীর রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। থ্যালাসেমিয়া মেজর এ মারাত্মক রক্তস্বল্পতা, লিভার ও প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া এবং হাড়ের অসামঞ্জস্যতা দেখা যেতে পারে। আক্রান্ত শিশুদের মাঝে ফলিক এ্যাসিডের অভাব দেখা যায়। এছাড়া কার্ডিওমায়োপ্যাথিও দেখা যেতে পারে। থ্যালাসেমিয়া রোগে মাইক্রোসাইটিক হাইপোক্রমিক এনিমিয়া দেখা যায়।
বিটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগীর শরীরে আয়রনের পরিমাণ বেড়ে যায় যা হৃদপি-, যকৃত, অগ্ন্যাশয়, ত্বক এবং লালাগ্রুন্থিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে যা সিক্কা সিনড্রোম নামে অভিহিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যকৃত ও অগ্ন্যাশয়ের কার্যক্রম ব্যাহত হয়ে থাকে। বিটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রক্ত নিতে হয় এবং ফলিক এ্যাসিড সম্পূরক হিসাবে প্রদান করতে হয়। আয়রন চিলেটিং এজেন্ট দ্বারা অতিরিক্ত আয়রনের চিকিৎসা করা হয়।
থ্যালাসেমিয়া রোগে উপরের চোয়াল বা ম্যাক্সিলা বড় হয়ে যেতে পারে। বোন ম্যারো বা অস্থি মজ্জার সম্প্রসারণের কারণে এমনটি হতে পারে। থ্যালাসেমিয়া রোগে মাঝে মাঝে দাঁত ফাঁকা হয়ে যেতে পারে। উপরের চোয়ালের ইনছিসর দাঁত সামনের দিকে প্রসারিত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে অর্থোডনটিক চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। প্যারোটিড গ্রন্থির ব্যথাযুক্ত ফোলাভাব হতে পারে। আয়রন জমা হওয়ার কারণে শুষ্ক মুখের সৃষ্টি হয়ে থাকে।
ফলিক এ্যাসিডের অভাবজনিত কারণে বার্নিং মাউথ বা মুখ জ্বালাপোড়া হতে পারে। শুষ্ক মুখের কারণে লালার নিঃসরণ কমে যাওয়ায় দন্তক্ষয় থেকে শুরু করে মুখের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই থ্যালাসেমিয়া রোগে সবার সচেতন হতে হবে এবং এ রোগের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে হবে কোন অবহেলা না করে।

জন্মনিরোধ ওষুধ ও দাঁতের চিকিৎসা
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বা অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ রোধ করার জন্য জন্মনিরোধক ওষুধ সেবন একটি অন্যতম পদ্ধতি। কিন্তু এই জন্মনিরোধ পিলের সঙ্গে দাঁতের চিকিৎসার কি সম্পর্ক? যারা নিয়মিত জন্মনিরোধক বড়ি সেবন করে যাচ্ছেন তাদের দাঁতের যতেœ সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে যারা মাড়ি রোগ বা জিনজিভাইটিসে ভুগছেন তাদের ক্ষেত্রে রোগটি আরও প্রবল হয়ে দেখা দেয়। ক্রমাগত জন্মনিরোধক ওষুধ সেবন করতে থাকলে তীব্র পেরিওডন্টাইটিস দেখা দিতে পারে। দাঁত তোলার পর ড্রাই সকেট বা অ্যালভিওলার অস্টাইটিস দেখা যেতে পারে। যারা নিয়মিত জন্মনিরোধক ওষুধ সেবন করে যাচ্ছেন তাদের দাঁতের পাথর থাকলে অবশ্যই দ্রুত স্কেলিং করিয়ে নিতে হবে। তাছাড়া মাড়িতে বা পেরিওডন্টাল লিগামেন্ট কোন সমস্যা দেখা দিলে ডেন্টাল সার্জনের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিন। মোটকথা নিয়মিত ডেন্টাল চেকআপে থাকুন।
জন্মনিরোধক ওষুধ ও দাঁত তোলা: মহিলাদের মাঝে যারা জন্মনিরোধক বড়ি সেবন করছেন তারা যদি মাসিকের প্রথম ২২ দিনের মধ্যে দাঁত ফেলেন সেক্ষেত্রে ড্রাই সকেট বা অ্যালডিওলার অস্টাইটিস হওয়ার দ্বিগুণ সম্ভাবনা থাকে। এ ক্ষেত্রে মাসিকের শেষ সপ্তাহে, অর্থাৎ ২৩ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে দাঁত তোলা ভাল। কারণ এ সময় ইস্ট্রোজেন লেভেল কম থাকে অথবা কার্যকর থাকে না। ইস্ট্রোজেন প্রণোদনা দেয় ফিব্রিনোলাইসিসের ক্ষেত্রে। ফলে রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া ইস্ট্রোজেন ক্ষতস্থান শুকানোর প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই যারা নিয়মিত জন্মনিরোধক ওষুধ সেবন করছেন তাদের দাঁত তোলার ক্ষেত্রে অবশ্যই সচেতন হতে হবে।
লিভারের বিপাক ক্রিয়া বাড়িয়ে দিয়ে ওষুধ জন্মনিরোধক পিলের সঙ্গে ইন্টারএ্যাকশন করে থাকে। এ ইন্টারএ্যাকশনের কারণে জন্মনিরোধক পিলের কাজ ব্যাহত হয়। এর ফলে গর্ভধারণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
যে সব ওষুধ জন্মনিরোধক ওষুধের সঙ্গে ইন্টারএ্যাকশন করে থাকে সেগুলো হলো: (ক) এন্টিকনভালসেন্ট জাতীয় ওষুধ (খ) বারবিচুরেটস্্ (গ) ফিনাইটয়েন (ঘ) কার্বামাজেপেইন (ঙ) রিফ্যামপিছিন (চ) ওরাল এান্টিবায়োটিকস এবং এন্টিমাইক্রোবায়ালস যেমনÑ এ্যামক্সিসিলিন, টেট্রাসাইক্লিন, পেনিসিলিন, মেট্রোনিডাজল। জন্মনিরোধক ওষুধ সেবনকারী মহিলাদের মাঝে যারা এ্যামক্সিসিলিন অথবা অন্যান্য পেনিসিলিন বা টেট্রাসাইক্লিন দাঁত ও মুখের চিকিৎসায় সেবন করছেন তাদের ক্ষেত্রে জন্মবিরোধক ওষুধ অতিরিক্ত ৭ দিনের জন্য গ্রহণ করতে হবে। আর যদি রিফ্যামপিছিন সেবন করেন সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত ৪ সপ্তাহ জন্মনিরোধক ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.