চাকরিটা আমাকেই ছাড়তে হয় by মৌনতা আরওয়া

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করেছিলেন আফসানা আনোয়ার। শিক্ষার পাট চুকিয়ে জয়েন করেন বাংলাদেশের খ্যাতনামা এক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে। কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে পরিবার থেকে বিয়ে দেওয়া হয় তাকে। দু'বছর করেন সাজানো-গোছানো সুখের সংসার। তৃতীয় বছরের মাথায় কোলজুড়ে আসে তার কন্যাসন্তান।


তিন মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটিয়ে যখন অফিসে যাওয়া শুরু করলেন তখন মুখোমুখি হলেন চরম বাস্তবতার। মা বৃদ্ধা। শাশুড়ি নেই। একক পরিবারে থাকা আফসানা বুঝতে পারছিলেন না তার ছোট্ট শিশুকে কার কাছে রেখে যাবেন। খালাত বোনকে কিছুদিন নিজের কাছে এনে রেখে কিংবা গৃহপরিচারিকার কাছে ছয় মাস বাচ্চাকে রেখে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন তিনি। অবশেষে সংসার, সন্তান আর অফিস নিয়ে যখন আর পারছিলেন না তখনই সিদ্ধান্ত নেন আর চাকরি করবেন না। চাকরি করলে সন্তানকে কার কাছে রেখে যাবেন? কে তার দেখাশোনা করবে?
শৈশবে-কৈশোরে পড়াশোনায় খুব ভালো কন্যাসন্তানটি। এসএসসি, এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট করে মা-বাবাকে গর্বিত করে মেয়েটি। স্বপ্নের জাল বুনে ভর্তি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো কোনো সাবজেক্টে। ভালো ফল অতঃপর যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মক্ষেত্র। একটা সময় সংসারে প্রবেশ। এরপর আমরা কি কখনও দেখি শতকরা ক'টি মেয়ে তার কর্মক্ষেত্রে টিকে রয়েছে? আর কতজনইবা হারিয়ে গেছে সংসার-সন্তানের মায়ায়? এ রকম কি কোনো জরিপ আছে বাংলাদেশে, যে যথেষ্ট যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকার পরও কতজন নারী ঝরে পড়ছে তার কর্মক্ষেত্র থেকে? জানতে চাই বেসরকারি সংস্থা কর্মজীবীর নারীর নির্বাহী পরিচালক শিরীন আখতারের কাছে। তিনি জানান, 'এ রকম ঘটনা তো সমাজে হরহামেশাই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, উচ্চতর শিক্ষিত অনেক মেয়েই তাদের কর্মদক্ষতা, মেধা, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরি থেকে সরে আসছেন। কেননা তারা পারছেন না ঘর-সংসার- সন্তান সমানতালে সামলাতে। আমি বিশ্বাস করি এ দেশের মেয়েরা দশভুজা হয়ে ঠিকই ঘর-সংসার সামলান। কিন্তু নারীছেঁড়া ধনটিকে কার কাছে রেখে যাবেন, কে নেবে ছোট্ট শিশুটির যত্ন_ এসব ভাবনা মায়ের মনকে তোলপাড় করেন সারাক্ষণ। কোনো চিন্তা না করেই নিজের শিশুসন্তানদের জন্য কর্মক্ষেত্র থেকে সরে আসেন মা। এ রকম হাজারো মা আছেন আমাদের সমাজে, যারা শুধু সন্তানের দেখাশোনা, সন্তানকে সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। উচ্চশিক্ষিত হয়েও থাকছেন শুধু গৃহিণী হয়ে। সন্তানের মা হয়ে।' কিন্তু পড়াশোনা শেষ করে কোনো নারীই চান না কর্মক্ষেত্র থেকে সরে আসতে। তারপরও আমাদের নারীরা ঝরে পড়েন কর্মক্ষেত্র থেকে। এ অবস্থার সমাধান কি হতে পারে তা জানতে চাইলেঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেনস অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদা ইসলাম জানান, 'একজন নারী যিনি তার শৈশব থেকে মেধার পরিচয় দিয়ে পড়াশোনায় ভালো করে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন, তার তো স্বপ্নই থাকবে যে তিনি একটি ভালো চাকরি করে নিজেকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাবেন। অথচ প্রথম বাধাটাই আসে পরিবার থেকে। বউয়ের কি দরকার চাকরি করার? স্বামী যেহেতু এত টাকা বেতন পান। শ্বশুরবাড়ি থেকে আসে এ মন্তব্য। অথচ অর্থ নয়, চাকরি করাটা একজন মেয়ের জন্য আত্মসম্মানের বিষয়। এটা পরিবারের সবাইকে বুঝতে হবে। শ্বাশুড়িকে চিন্তা করতে হবে নিজের মেয়ের ক্ষেত্রে তিনি কি করতেন!'
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম জানান, 'আমাদের দেশে যত নিপীড়নের শিকার নারীরা। পরিবার, সমাজের রীতিনীতি, দায়বদ্ধতা সব পালনের দায়িত্ব নারীর কাঁধে। দু'হাতে নারী দশভুজা হয়ে সব কাজ সামলাতে গিয়ে হিমশিম অবস্থায় পড়ে যান। কিন্তু যত কঠিন অবস্থাই থাক আমি বলব, মেয়েরা যেন তার র্কমক্ষেত্র থেকে সরে না আসেন। অনেক নারীকে আমি দেখেছি অফিসে কাজের পরিবেশ পাচ্ছেন না ঠিকমতো। হয় সহকর্মীদের উত্ত্যক্তকরণে নয়তো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অসামাজিক আচরণে নারী কর্মক্ষেত্র থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। আমরা চাই নারীরা যেন কর্মক্ষেত্রে অন্তত সহকর্মীদের এমন অনৈতিকতার শিকার না হন। শিরীন আখতার আরও বলেন, 'প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে ডে কেয়ার সেন্টার থাকা খুব জরুরি। নারী যদি তার শিশুটিকে ভালো একটি ডে কেয়ার সেন্টারে দিয়ে আসতে পারেন এবং নিশ্চিন্ত থাকেন যে, তার সন্তান নিরাপদে আছে, তবে তিনি তার কর্মক্ষেত্র থেকে সরে আসবেন না। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ ব্যাপারে জোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
 

No comments

Powered by Blogger.