নারীশিক্ষা

বাংলাদেশে নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে যে কার্যকর অগ্রগতি হয়েছে তার স্বীকৃতি এখন পাওয়া যাচ্ছে। এখানে স্কুলে মেয়েদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি অনেকেরই প্রশংসা অর্জন করেছে। সম্প্রতি ভারতের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে ছেলেদের তুলনায় স্কুলে মেয়েদের উপস্থিতির হার বেশি।


অমর্ত্য সেন শুক্রবার নয়াদিল্লীতে তিন দিনব্যাপী শিক্ষাবিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে বক্তৃতাকালে এ কথা বলেন। বাস্তবিকই নানা সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশে গত দু’তিন দশক ধরে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও বেশকিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে; এর মধ্যে অন্যতম হলো নারী উন্নয়ন। অনেক উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় এখানে মাতৃমৃত্যুর হার কম। একই সঙ্গে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। বিশেষ করে বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে দেশব্যাপী নারীশিক্ষার উন্নয়নে বেশকিছু কল্যাণকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে; নারী সমাজ এখানে শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সুবিধা পাচ্ছেন। নারী উন্নয়ন বিষয়ে সরকারী নীতি এখানে দেশব্যাপী সর্বস্তরে উন্নয়নকে নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশের মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ ও সমস্যাজর্জরিত দেশে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, এখানে নারীশিক্ষা ও নারী উন্নয়নের মাধ্যমে গোটা দেশকেই বদলে দেয়া সম্ভব। কারণ একটি শিক্ষিত নারী সবদিক দিয়ে একটি শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবার গড়ে তুলতে পারে। সন্তানদের শিক্ষিত ও দেশের যোগ্য দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শিক্ষিত মায়ের ভূমিকা অপরিসীম। এ কারণে বাংলাদেশ সরকার নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে যেভাবে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়েছেÑ তা বিশেষভাবে প্রশংসাযোগ্য। এ বিষয়ে অমর্ত্য সেন তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন, ‘সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেছে। ঠিক একইভাবে চীন ১৯৭৯ সালের আগে শিক্ষা খাতে জোর দিয়েছিল।’
অমর্ত্য সেন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করেছেন। বাস্তবিকই চীন প্রথমে শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের মাধ্যমে একটি শিক্ষিত জাতি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে আত্মনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশকেও সর্বপ্রথম সাক্ষরতার হার শতকরা এক শ’ ভাগে উন্নীত করতে হবে; এর কোন বিকল্প নেই। মাত্র ক’দিন আগে বাংলাদেশে ২০১১ সালের আদমশুমারির বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছে। এতে সুস্পষ্টভাবে জানা গেছে, বাংলাদেশে সাত বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৫১ দশমিক ৮ শতাংশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পুরুষের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৫৪ দশমিক ১ শতাংশ; নারীর মধ্যে এই হার ৪৯ দশমিক ৪ শতাংশ। সুতরাং বিশ্বব্যাপী নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যত প্রশংসাই অর্জন করুক না কেন, দেশে শিক্ষা কিংবা সাক্ষরতার দিক দিয়ে নারী সমাজ পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে আছে। হয়ত অন্য কিছু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের তুলনায় বাংলাদেশে নারী সমাজের উন্নয়নমূলক অবস্থাটি পুরুষদের তুলনায় ভাল; কিন্তু তা মোটেই সন্তোষজনক নয়। আদমশুমারির ফল অনুযায়ী দেশের মোট নারীর অর্ধেকই নিরক্ষতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। সুতরাং দেশের অর্ধেক নারীকে অন্ধকারে রেখে পরিপূর্ণ নারী মুক্তি অর্জনের স্বপ্ন দেখা কখনোই সম্ভব নয়। দেশে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী; এছাড়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে মহিলারা সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছেন; কিন্তু দেশব্যাপী নারী সমাজের প্রকৃত অবস্থা কী? দেশব্যাপী বিপুলসংখ্যক নারী এখনও পুরুষের দ্বারা ব্যাপকভাবে নির্যাতনের শিকার। গ্রামাঞ্চলে সালিশের নামে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক নারী নির্যাতিত হচ্ছেন। তবু এর পাশাপাশি সর্বত্র বিদ্যালয়গামী মেয়েদের সংখ্যা বাড়ছে। এ সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। প্রতিটি মেয়ের জন্য শিক্ষার আলো নিশ্চিত করা দরকার। সর্বক্ষেত্রে নারীপুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া সমাজে নারীর যথাযথ মর্যাদা কখনোই প্রতিষ্ঠিত হবে না। স্কুলে মেয়েদের উপস্থিতি বৃদ্ধির পাশাপাশি নারী শিক্ষার প্রকৃত বিস্তার জরুরী।

No comments

Powered by Blogger.