জয় জুঁই যূথী ফিরে যাক বাদাবনে by পাভেল পার্থ

সবকিছু ছাপিয়ে সুন্দরবনের তিনটি মাসুম বাঘ ছানাই হয়ে উঠল আমাদের নগরের গল্প। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের রমজাননগর এলাকার পশুশিকারিরা বাচ্চাগুলো ধরেছিল। র‌্যাব-২ আবদুল কাদেরের বাসায় অভিযান চালিয়ে বাঘের বাচ্চাগুলো উদ্ধার করে।


সমকালের সূত্রমতে, বাঘের বাচ্চা তিনটিকে স্থানীয় শিকারিরা ৩০ হাজার টাকায় ঢাকায় বিক্রি করেন। বণিকবার্তা পত্রিকা জানিয়েছে, ১০ লাখ টাকা দরে বাঘের বাচ্চাগুলো মংলা বন্দরে অপেক্ষারত একটি জাহাজে করে পাচারের প্রক্রিয়া চলছিল। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঢাকার ধনী ও প্রভাবশালীদের বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল ময়ূর, হরিণসহ নানা জাতের বিপন্ন পাখি। ২০১১ সালের ৮ ডিসেম্বর পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া থানা পুলিশ একটি পুরুষ বাঘের চামড়া ও শরীরের হাড়-মাংস আটক করে। ১৭ এপ্রিল ২০১২ তারিখে দিবাগত রাত ৩টায় বিমানবন্দর থেকে ৩০০টি তারকা কচ্ছপ, ৯০টি শিলা কচ্ছপ এবং ২৫টি কড়ি কাইট্ট্যা প্রজাতির কচ্ছপ আটক করে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। ২ জুলাই ২০১০ তারিখে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ময়না, টিয়া, লাভবার্ডসহ বিপুলসংখ্যক পাখি পাচারের সময় বাংলাদেশ বিমান কর্তৃপক্ষ পাচারটি বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল।
এই যে একটির পর একটি বন্যপ্রাণী পাচার ও বাণিজ্যের ঘটনা ঘটে চলেছে তার কোনো পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও বিচার জনসমক্ষে প্রকাশিত এবং প্রচারিত না হওয়ায় বিষয়টি এক 'অপরাধহীনতার' মাত্রা পেয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক বাঘ ছানাদের উদ্ধার এবং অপরাধীদের শাস্তির প্রক্রিয়া দেখে স্পষ্ট হয়ে উঠছে বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত অপরাধের উপযুক্ত বিচার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কতখানি দুর্বল। কারণ এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত বাণিজ্যের বিরুদ্ধে কোনো শক্তিশালী আইনি কাঠামো গড়ে ওঠেনি। নেই কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও বিচারের বিধান। এ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন ও বিচার প্রক্রিয়াগুলো আলোচনা করলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে উঠবে। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) অধ্যাদেশ ১৯৭৩-এর ৫.১ এবং ৫.২নং ধারায় বন্যপ্রাণী শিকার, ধরা, বিক্রয় ও হত্যা নিষিদ্ধ। পাশাপাশি ওই অধ্যাদেশের ১১নং ধারায় দান, বিক্রয় বা অন্য যে কোনো প্রকারে বন্যপ্রাণীর ব্যবহার নিষিদ্ধ। বন্যপ্রাণী অধ্যাদেশের উলিল্গখিত আইনগুলো ভঙ্গ করলে সর্বনিম্ন ৬ মাস থেকে সর্বোচ্চ এক বছরের জেল এবং সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। 'বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) অধ্যাদেশ ১৯৭৩'কে প্রতিস্থাপন করে বিল আকারে জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত হয়েছে 'বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আইন ২০১১'। অনেক পাল্টাপাল্টির পর আইনটি বর্তমানে 'বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন' নাম নিয়ে চূড়ান্ত হওয়ার দিন গুনছে। ওই আইনের তৃতীয় অধ্যায়ের ৬নং ধারায় বন্যপ্রাণী শিকার নিষিদ্ধ। ওই ধারা লঙ্ঘন করলে অপরাধীর শাস্তি হবে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড, সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডই প্রযোজ্য হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে বন্যাপ্রাণী আইন ২০১১-এর ৩৯নং ধারায়।
লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারোর কাছ থেকে কোনো বন্যপ্রাণী বা বন্যপ্রাণীর অংশ ক্রয় করলে সর্বোচ্চ এক বছর কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে 'বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১১'-এর ৩৪নং ধারায়। 'অপরাধ ও দণ্ড' শীর্ষক আইনের নবম অধ্যায়ের ৩৬নং ধারায় বাঘ ও হাতি হত্যার সর্বোচ্চ কারাদণ্ড সাত বছর এবং সর্বোচ্চ জরিমানা ১০ লাখ টাকার বিধান রাখা হয়েছে। একই ব্যক্তি পুনরায় ওই অপরাধ করলে তার সর্বোচ্চ কারাদণ্ড হবে ১২ বছর এবং সর্বোচ্চ অর্থদণ্ড দিতে হবে ১৫ লাখ টাকা।
বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত অপরাধ নিরসনে অবশ্যই 'পরিবেশবান্ধব আইনি মনস্তত্ত্ব ও বিচার কাঠামো' জরুরি। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১১-এর সপ্তম অধ্যায়টির নাম 'বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদ আমদানি, রফতানি ও পুনঃরফতানি'। ওই অধ্যায়ের ৩১নং ধারাটিতে বন্যপ্রাণী সম্পর্কিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণে একটি 'অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ইউনিট' গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। বাঘ ছানাদের সাম্প্রতিক উদ্ধারের ঘটনাটি আমাদের একটি শক্তিশালী ও কার্যকর 'বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণ কাঠামো' গঠনের জোর দাবি জানায়। পত্রিকায় জয়, জুঁই ও যূথী নামে বাঘ ছানাদের তিনটি নামও উলেল্গখ করা হয়েছে। জয়, জুঁই আর যূথী আবার ফিরে যাক বাদাবনে তার মায়ের কোলে। আর কোনো মায়ের কোল শূন্য না হোক। আর কোনো বাঘ-সন্তান না হারাক তার প্রিয়জন, এই সুরক্ষা সরকার বাহাদুরকেই তৈরি করতে হবে।

পাভেল পার্থ :গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ animistbangla@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.