মত ও মন্তব্য-ধনীদের ধনপিপাসার নির্বিচার বলি by হারুন হাবীব

ব্যক্তিগত আগ্রহ-অনাগ্রহ খুব একটা দরকারি কিছু নয়। তবুও বলি, পুঁজিবাজার বা শেয়ার মার্কেট নিয়ে আমার আগ্রহ সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু পুঁজিবাজার অর্থনীতির একটি বড় মানদণ্ড। আমার আত্মীয়-বন্ধুবান্ধব অনেকেই এ ব্যবসায় যুক্ত আছেন। তাঁদের কেউ কেউ সাধারণ বিনিয়োগকারী থেকে কোটিপতি হয়েছেন।


কোনো ব্যবসায় রাতারাতি এমন লাভ হয় বলে কখনো শুনিনি। কিন্তু বাংলাদেশে শোনা যায়! গরিব দেশে বড়লোক হওয়ার সহজ রাস্তা!
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের পুঁজিবাজারের হালচাল খুব একটা জানা নেই আমার। তবে বাংলাদেশে যা দেখছি, তাতে বলতে বাধ্য_এ ব্যবসাটি একটি বড় মাপের জুয়া খেলা কিংবা 'হাই স্টেক লটারি', যা রাতারাতি মানুষকে কোটিপতি বানিয়ে দিচ্ছে, পথের ভিখিরিও করছে! সুস্থ অর্থনীতির স্বার্থে আমাদের পুঁজিবাজারের এ চরিত্র কতটা অপরিহার্য তা অর্থনীতির পণ্ডিত কেন_সাধারণ মানুষও প্রশ্ন করতে পারেন। বলাই বাহুল্য, এই অতিমুনাফার কারণেই সাধারণ ও অতিসাধারণ বিনিয়োগকারী রাতারাতি বড়লোক হওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে জুয়া খেলতে বাধ্য হচ্ছেন।
আমাদের শেয়ারবাজার যেভাবে দ্রুত সম্প্রসারিত হয়, তা কখনোই বিদ্যমান অর্থনীতির অন্তর্নিহিত শক্তির পরিচায়ক হতে পারে না। এখানে যে পরিমাণ বিনিয়োগ আকর্ষণ করে, সেটিও অস্বাস্থ্যকর অর্থনীতির নিদর্শন। বিপুলসংখ্যক মানুষ শেয়ারবাজারের দিকে ঝুঁকেছেন। অনেকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন। দেশে কর্মসংস্থানের অভাবে বিপুলসংখ্যক বেকার যুবক বিভিন্ন উৎস থেকে টাকা ধার করে বিনিয়োগ করেছেন। চাকরিজীবীসহ সব ধরনের পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিরাও এ বিনিয়োগের আশ্রয় নিয়েছেন বাড়তি আয়ের জন্য। অন্যদিকে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকায় বহু লোক পুঁজিবাজারে প্রবেশ করেছেন। মোটকথা, শেয়ারবাজার এখন একটি বড় আয়ের উৎস।
১৯৭৫-এর রক্তাক্ত পালাবদলের পর আওয়ামী লীগ প্রথমবার ক্ষমতায় ফিরে আসে ১৯৯৬ সালে। প্রায় দুই যুগের ব্যবধানে সেই ফিরে আসাটা কতটা চ্যালেঞ্জের ছিল এবং ক্ষমতায় টিকে থাকাটা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ১৯৯৬ সালেই ঘটল পুঁজিবাজারে প্রথম ভয়াবহ ধস। সেই ধস এতটাই ভয়ংকর ছিল যে সেদিনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে পরিস্থিতি সামলাতে ঘর্মাক্ত হতে হয়েছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ভিতও নাড়িয়ে দিয়েছিল ১৯৯৬-এর পুঁজিবাজারের অস্বাভাবিক উত্থান এবং পতন।
কোনো যোগসূত্র থাক বা না থাক_স্মরণকালের দ্বিতীয় ভয়াবহ পুঁজিবাজার বিপর্যয়ের ঘটনাটি ঘটল ২০১১ সালে, যখন আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের মতো সরকার পরিচালনা করছে। দ্বিতীয় দফা সরকার পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের পথে ফুলের চাদর বিছানো আছে_এমনটা মনে করা মূর্খতা হবে। এর পরও ঘটল ভয়ংকর ঘটনাটি। শেয়ারবাজার অস্বাভাবিক চাঙ্গা করা হলো এবং অস্বাভাবিক পতনও ঘটানো হলো পরিকল্পিতভাবে! আমি বলতে বাধ্য, সরকারবিরোধীদের নানামুখী ষড়যন্ত্র মোকাবিলার সঙ্গে সাম্প্রতিককালের ভয়াবহ পুঁজিবাজার ধস সরকারের চ্যালেঞ্জে নতুনমাত্রা যোগ করেছে।
সাম্প্রতিক ধসের কারণ অনুসন্ধানে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে এই অস্থিরতার কারণ হিসেবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) গাফিলতি ও একশ্রেণীর ধনী ব্যবসায়ীর পরিকল্পিত কারসাজিকে দায়ী করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এসইসি, ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জ, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ ইত্যাদি ঐক্যবদ্ধ হয়েই কেলেঙ্কারিটি ঘটিয়েছে। কয়েক হাজার কোটি টাকা লুট করা হয়েছে। দেশের বাইরেও কোটি কোটি টাকা চলে গেছে! অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে এ কেলেঙ্কারিতে কিছুসংখ্যক ক্ষমতাবান, ধনী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অবিশ্বাস্যভাবে লাভবান হলেও গরিব ও মধ্যবিত্ত বিনিয়োগকারীরা দেউলিয়া হয়েছেন।
জনমনের স্বাভাবিক প্রত্যাশা, তদন্ত প্রতিবেদনটি দেশবাসীর সামনে প্রকাশ করা হবে, প্রকাশ করা হবে 'ঠাণ্ডা মাথার খুনিদের' নাম-পরিচয় এবং অবৈধভাবে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ করে যারা কোটি কোটি টাকা লুণ্ঠন করছে, সাধারণ মানুষকে পথে বসিয়েছে, তাদের আইনের হাতে সোপর্দ করা হবে, শাস্তি হবে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হবে, তবে প্রয়োজনীয় সম্পাদনা করে।
এ দেশে কোনো তদন্ত রিপোর্ট সচরাচর প্রকাশ করা হয় না। কোনো বিশেষ ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, কমিটি তদন্ত সম্পাদন করে এবং তা সরকারের কাছে জমা দেয়। ব্যস, এ পর্যন্তই। এ রকম অসংখ্য কমিটির কথা বলা যায়, যার রিপোর্ট কী এবং সে রিপোর্টের ভিত্তিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে_দেশবাসীর তা জানা নেই। আশা করতে পারি, রিপোর্টটি প্রকাশের ব্যবস্থা হবে এবং এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বাংলাদেশ এখন আর আগের মতো নেই। সরকার বা কোনো রাজনৈতিক দল ইচ্ছে করলেই কোনো কিছু চেপে রাখতে পরে না এখন। সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদের আমলেও যা সম্ভব ছিল_এখন তা সম্ভব নয়। দেশে মুক্ত-স্বাধীন গণমাধ্যম বিকশিত হয়েছে। তথ্য গোপন রাখা এখন সম্ভব নয়; সংশ্লিষ্টদের ইচ্ছা থাকলেও নয়। কাজেই সরকারের পক্ষ থেকে পুঁজিবাজার কারসাজির প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা না হলেও নানা গণমাধ্যমে রিপোর্টের অংশবিশেষ ইতিমধ্যেই প্রচারিত হয়েছে। যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে, বলতেই হবে, তারা ক্ষমতাবান।
বিস্ময়ে সঙ্গে লক্ষ করা গেছে যে ১৯৯৬ সালের পুঁজিবাজার বিপর্যয়ে যাদের নাম এসেছিল-এবারও মোটামুটি তাঁরাই অপকর্মটি করেছেন। একদিকে লাখ লাখ মানুষকে পথে বসিয়েছেন, অন্যদিকে সরকারকে বড় সংকটে ফেলেছেন। পুঁজিবাজারে এযাবৎকালে সংঘটিত বড় বড় বিপর্যয়ের নেপথ্যে রয়েছে এই একই গোষ্ঠীর পরিকল্পিত কারসাজি। এত দিন এসব অভিযোগের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল না। যে নামগুলো এ প্রসঙ্গে সচরাচর আলোচনায় এসেছে, তারা শুধু প্রতিপত্তির হিসেবে নয়, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিবেচনায়ও ক্ষমতাবান। সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় এঁরা যেমন আছেন, তেমনি বিরোধী দলেরও ছত্রচ্ছায়াতে আছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারি বা প্রধান বিরোধী দল নয়_শনাক্ত হওয়া উচিত আসল অপরাধী। দলমত-নির্বিশেষে যদি আসল অপরাধীদের শনাক্ত করা হয়_সরকার ও বিরোধী দল যদি এ ক্ষেত্রে একে অপরকে সহযোগিতা করে, তাহলেই কেবল পুঁজিবাজার-দস্যুদের বিচার করা সম্ভব।
পুঁজিবাজারের পরিকল্পিত উত্থান ও পতন একটি বড় ধরনের দস্যুতা, যাকে রাষ্ট্রীয়ভাবেই মোকাবিলা করা উচিত। এখানে কোনো রাজনীতি নেই, নেই কোনো দলীয় পরিচয় বা রাজনৈতিক মুনাফা। যা আছে তা নিছক দস্যুতা_যে দস্যুতা একদিকে যেমন রাষ্ট্রের মুখে কলঙ্ক মাখছে, অন্যদিকে রাজনীতির মৌলিক চরিত্রকেও কলুষিত করছে। আমাদের সমাজ ছোট ছোট দস্যুতাকে দমন করার চেষ্টা করে আইন প্রয়োগ করে। কিন্তু বড় দস্যুতাগুলোকে এড়িয়ে যায় কিংবা এড়িয়ে যেতে বাধ্য হয়। আশা করব, জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী বর্তমান সরকার তার শত চ্যালেঞ্জের মাঝেও এ চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করবে এবং জাতিকে বারংবারের দস্যুতা থেকে মুক্ত করবে।
তদন্ত রিপোর্টে নাম উঠে এসেছে কয়েকজন দাগি কর্মকর্তারও। এসইসি পুনর্গঠনের জোর সুপারিশ করা হয়েছে। তবে শুধু এ প্রতিষ্ঠানটিকে বলির পাঁঠা বানানো ঠিক হবে না। এর গঠন প্রক্রিয়ার গলদ, কর্মকাণ্ড দেখভাল যাদের দায়িত্ব, তাদের ভূমিকাও বিবেচনায় আনতে হবে। এসইসি পুনর্গঠন মানে শুধু কিছু ব্যক্তির প্রতিস্থাপন নয়। দৃঢ় নৈতিকতাসম্পন্ন ও যোগ্য লোকের নিয়োগ নিশ্চিত হতে হবে। তা না হলে যতই পুনর্গঠন করা হোক সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে।
অর্থমন্ত্রী ইতিমধ্যেই আশ্বস্ত করেছেন, এই বড় দস্যুরা যে দলেরই হোন তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। আশা করব, ন্যায় ও স্বচ্ছতার প্রশ্নে সরকার তার অবস্থানে দৃঢ় থাকবে। যারা নিজেদের পকেট ভারী করতে দেশের হাজার হাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে সর্বস্বান্ত করেছে, সরকারকে বিব্রত ও বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে ফেলেছে, এরা কোনোভাবেই দেশ ও জনগণের বন্ধু হতে পারে না। এদের পেছনে রাজনৈতিক বা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ধরনের প্রশ্রয় থাকা উচিত নয়। প্রতিটি সুবিবেচক মানুষের প্রত্যাশা, দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ, প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠনসহ পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল রাখতে আরো যেসব সুপারিশ উঠে এসেছে, সেগুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়ে সরকার এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

হারুন হাবীব : সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.