সন্ত্রাস দমনের নামে পাক-আফগান ও ইরানের যৌথ চুক্তি by ইয়ামিন খান

পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং ইরান সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এরই মধ্যে একটি যৌথ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এ চুক্তিটি ইসলামাবাদে ত্রিদেশীয় বৈঠকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশী, ইরানের মানোচেহার মোত্তাকি ও আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাঙ্গিন দাদফার মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে—‘আমরা সন্ত্রাসবাদকে একটি স্বাভাবিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করি, যেটা যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রতিহত করা সম্ভব।’ আঞ্চলিক নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য এবং সেই সঙ্গে নিজ নিজ দেশের মাটিকে অন্য কাউকে ব্যবহার করতে না দেয়ার কথা এই চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা যে কোনো মূল্যে ত্রিদেশীয় গোয়েন্দা সহযোগিতা এবং বৃহত্ সমঝোতার মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদ ও উগ্র জঙ্গিবাদ দমনে একমত হয়েছেন, যাতে করে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে অবৈধ অস্ত্রের সরঞ্জামকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব হয়। যে কোনো সচেতন ব্যক্তি খুব ভালো করে বুঝতে পারবেন যে, ত্রিদেশীয় চুক্তি সন্ত্রাসবাদ কিংবা সীমান্তে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার অর্থ কি? এই অর্থ অত্যন্ত পরিষ্কার। আফগান জনগণের প্রতিরোধ যুদ্ধ মোকাবিলার জন্য এই ফ্রন্ট বা জোট গঠন করা হয়েছে। প্রশ্নটি এখানেই। এই যৌথচুক্তির মাধ্যমে কী মার্কিন আগ্রাসনের পথকে সুগম করে তোলা হচ্ছে না? সন্ত্রাসবাদ দমনের অজুহাতে যে ত্রিদেশীয় চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে তার নেপথ্যে যে কারণ যুক্ত রয়েছে, সেটি হচ্ছে—যারা জিহাদের মাধ্যমে বীরবিক্রমে আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানে কিংবা অন্য কোনো মুসলিম দেশে অবস্থান নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে সশস্ত্র যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তাদেরকে সীমান্ত অঞ্চলের সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করা। এই ত্রিদেশীয় চুক্তিটি করা হয়েছে মূলত সন্ত্রাস দমনের নামে আমেরিকাকে সহায়তা করার লক্ষ্য নিয়ে।
একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কথিত সন্ত্রাসবাদ বিরোধী নীতিরই একটা অংশ এটি। আমরা জানি, গত শতকের নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নতুন যে কৌশল গ্রহণ করে তা হচ্ছে মুসলিম প্রধান দেশগুলোকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা। তারা অন্য পরাশক্তিধর দেশগুলোকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, সন্ত্রাসবাদ লালন করছে একমাত্র মুসলিম দেশগুলো। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের অভিমত ভিন্ন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলমানরা যাতে সংগঠিত হয়ে একটা বড় শক্তিতে পরিণত হতে না পারে। তাছাড়া ইসরাইলের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে এমন কোনো মুসলিম দেশকে তারা কিছুতেই মেনে নিবে না। সম্ভবত এ কারণেই তেল শক্তি নিয়ে ইরাক অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী হয়ে উঠছিল বলেই এই দেশটিকে আজ ধুলায় মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। সন্ত্রাস দমনের নামে আজ যেভাবে ইরাক, আফগানিস্তানকে প্রায় মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে সেটা বিশ্ববাসী খুব ভালো করে প্রত্যক্ষ করছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানগত দিক দিয়ে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীন যেভাবে অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে এগিয়ে আসছে তাতে ভবিষ্যতে তেলসমৃদ্ধ এই অঞ্চলকে ঘিরে নতুন করে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হতে পারে। ভবিষ্যতে যাতে এই অবস্থার সম্মুখীন হতে না হয়, সেজন্যই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার অনুগত লোককে ক্ষমতায় বসিয়ে পুরো এলাকাকেই নিজের বলয়ভুক্ত করে রেখেছে। তাই জাতিরাষ্ট্রের স্বার্থে মুসলিম দেশগুলোকে এমন কোনো চুক্তি করা উচিত নয়, যা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ রক্ষা করে। শঙ্কিত হওয়ার কারণ, এই ত্রিদেশীয় চুক্তির মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা সমগ্র মুসলিম বিশ্বের উপর আধিপত্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ঘৃণ্য অপচেষ্টায় লিপ্ত হতে পারে। মনে রাখা দরকার, এই আশঙ্কা একদম অমূলক নয়। তাই সাম্রাজ্যবাদী যে কোনো আগ্রাসন রোধে সময় থাকতেই মুসলিম প্রধান দেশগুলোর তাদের স্বার্থ সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
লেখক : ছাত্র, ইংরেজি বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর

No comments

Powered by Blogger.