সপ্তাহের হালচাল-উপনির্বাচনে গেলে সংসদে নয় কেন by আব্দুল কাইয়ুম

ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জ উপনির্বাচনে যদি বিএনপি অংশগ্রহণ না করত, তাহলে কেউ হয়তো অবাক হতো না। তাদের বর্তমান সাংসদেরাই তো সংসদ অধিবেশনে যান না। তাহলে আর লোক বাড়িয়ে লাভ কী? কিন্তু দেখা গেল, তারা দুই উপনির্বাচনেই প্রার্থী দিয়েছে। রাজনীতিতে এটা শুভ সংকেত। দুটি ব্যাপার পরিষ্কার হলো।


প্রথমত, বিএনপি যে সংসদ অধিবেশনে যাচ্ছে না, সেটা সাময়িক। সংসদে তাদের অবাধে কথা বলতে দিলে নিশ্চয়ই যাবে। অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব সরকারের। প্রথম আলো আয়োজিত ‘সরকারের দুই বছর’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও সে কথাই বলেছেন। বিএনপি সংসদে যেতে চায়, সরকারের ভালো কাজেও সহযোগিতা করতে চায়, কিন্তু বিরোধী দলের ওপর যে হারে নির্যাতন চালানো হচ্ছে, নেতা-কর্মীদের গুম করে ফেলা হচ্ছে, তা বন্ধ করতে হবে, বিরোধী দলকে কথা বলতে দিতে হবে। খুবই যুক্তিপূর্ণ দাবি।
দ্বিতীয়ত, শূন্য আসন দুটি ছিল আওয়ামী লীগের। আর এখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন। যখন বিএনপি বলছে, প্রশাসন থেকে শুরু করে আদালত পর্যন্ত সবখানে সরকার দলীয়করণ করছে, তখনো নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপি আশাবাদী হতে পারছে—এটা নিশ্চয়ই তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার। এর পেছনে অবশ্য একটি কারণ আছে। এবার নির্বাচন কমিশন বেশ স্বাধীনভাবে কাজ করছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যে সংস্কার করা হয়েছে, বর্তমান সরকার সেই ধারা সমুন্নত রেখে সুষ্ঠু নির্বাচনের নির্ভরযোগ্য প্রাতিষ্ঠানিক শর্ত সৃষ্টি করেছে। দেখা গেছে, এর আগের উপনির্বাচনগুলোতে বিরোধী দল বিএনপি প্রত্যাশিত ফল পেয়েছে। যে আসনটি তাদের ছিল, সেখানে তাদের প্রার্থীই জয়ী হয়েছে। শুধু ভোলার উপনির্বাচনে বলপ্রয়োগে ফলাফল আওয়ামী লীগের পক্ষে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ ছিল বিএনপির। কিন্তু সেই অভিযোগের সত্যতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি। উপরন্তু, ওই আসনে আগের সাংসদ ছিল আওয়ামী লীগের। উপনির্বাচনে তারাই জিতেছে। নিজেদের আসন নিজেরা পাওয়ায় তেমন প্রশ্ন ওঠেনি।
তবে এই মুহূর্তে বিরোধী দল বিএনপি একটু সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। কারণ, সরকারের দুই বছরে জনপ্রিয়তা যে কমেছে, তাতে সন্দেহ নেই। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। অবশ্য সরকারের দিক থেকে বাজারদর নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগও আছে। দাম বাড়লে যেমন এক দল মানুষের পকেটের টাকা বেরিয়ে যায়, তেমনই আরেক দল মানুষের পকেট ভরে। রিকশার ভাড়া আগে যেখানে ছিল ১০ টাকা, এখন তা ২০ টাকা। মধ্যবিত্তের বিপদ, কিন্তু গ্রামের নদীভাঙা যেসব মানুষ ঢাকায় রিকশা চালিয়ে জীবন ধারণ করে, তাদের দুমুঠো খেয়ে-পরে বাঁচার সুবিধা হয়। এ বিষয়ে কথা বলার সময় একবার বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছিলেন, জিনিসপত্রের দাম বাড়লেই যে দারিদ্র্যের হার বাড়ে বলে ধারণা করা হয়, সেটা ঠিক নয়। সবকিছু নির্ভর করে গরিব, বিশেষত দিনমজুরদের মজুরি বাড়ে না কমে, তার ওপর। চালের দাম বাড়লে, যারা কিনে খায় তাদের সমস্যা বাড়ে, অন্যদিকে খোদ কৃষকের কিছু লাভ হয়; যদিও মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভের বড় অংশটা নিয়ে নেয়। কিন্তু সবকিছুর পরও শেষ কথা হলো, জিনিসপত্রের দাম বাড়লে মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণার জন্ম নেয়। এটা সরকারের বিরুদ্ধে যায়। এর সঙ্গে আছে গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যা। ঢাকায় তীব্র যানজট। যাঁরা রাজনৈতিক অঙ্গনে জনমত তৈরি করেন, সেই মুখর মধ্যবিত্তের মূল অংশই থাকেন বড় বড় শহরে। তাঁদের একটি বড় অংশ নানা কারণে সরকারের ওপর বিরক্ত। বিএনপি যদি একে সম্বল করে যুক্তিসম্মতভাবে এবং বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে অগ্রসর হয়, তাহলে জনসমর্থন তাদের অনুকূলে নিয়ে আসা সহজ হবে। সুতরাং, বিএনপির উপনির্বাচনে যাওয়া রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয়।
এ মাসেই ২৬২টি পৌরসভায় নির্বাচন হচ্ছে। যদিও নির্দলীয়, কিন্তু সব প্রার্থীরই রাজনৈতিকভাবে দলীয় পরিচয় আছে। দলের সমর্থন পাওয়ার জন্য প্রার্থীরা ব্যাকুল। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আপ্রাণ চেষ্টা করছে, যেন তাদের দলীয় সমর্থনে একক প্রার্থী থাকে। দলের সমর্থকেরা যেন একাধিক প্রার্থীর পেছনে বিভক্ত হয়ে না পড়ে। এভাবে এই নির্বাচনও এক অর্থে রাজনৈতিক অঙ্গনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সুষ্ঠু নির্বাচন মানেই একধাপ অগ্রগতি। বিএনপি তো বলেনি যে নির্বাচন করে লাভ নেই, সরকার প্রভাব বিস্তার করে সব দখল করে নেবে। পরিস্থিতি যে ততটা খারাপ নয়, তা স্বস্তির বিষয়। এবং বাস্তবেও দেখা যাচ্ছে যে পরিস্থিতি, অন্তত নির্বাচনী পরিস্থিতি খুবই ভালো। না হলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী প্রবল প্রতাপশালী মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী মোহাম্মদ মন্জুর আলম মেয়র নির্বাচিত হন কীভাবে?
রাজনীতিতে অনেক হতাশার মধ্যেও এদিকে কিছু আশার আলো দেখা যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, দুই নেত্রী এই আশাটুকু উজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেবেন কি না। নববর্ষের প্রথম দিনে ছাত্রদলের সভায় এই সরকারের সব কর্মকাণ্ড অবৈধ ঘোষণা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এ ব্যাপারে একটি মিশ্র সংকেতই দিয়েছেন। একজন জ্যোতিষীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, নতুন বছরটি কেমন যাবে? উত্তরে তিনি বলেন, বছরটা শনি (শনিবার) দিয়ে যখন শুরু, বুঝতেই পারছেন কী হতে যাচ্ছে। তাহলে কি আমাদের শনির দশায় পড়তে হবে? খালেদা জিয়া যে কঠোর ভাষায় সরকারকে শাসিয়েছেন, তাতে আশাবাদী হওয়া কঠিন। তিনি তো বলেই ফেললেন, ‘ক্ষমতায় না থাকলে নাম-নিশানা-ফলক কিছুই থাকবে না!’
এ ধরনের মানসিকতাকে রাজনীতিতে শনিগ্রহ হিসেবে দেখা চলে। তিন বছরেই সরকারের পতন ঘটাতে হবে কেন? পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে দোষ কী? সরকারের কি এমন কোনো কাজ নেই, যা পরবর্তী সরকার রেখে দিতে পারবে না? সব কাজই কি খারাপ? এটা কীভাবে হয়? শিক্ষানীতি তো বিরোধী দল প্রত্যাখ্যান করেনি। পরবর্তী সরকারে তারা নির্বাচিত হয়ে এলে কি সেটাও বাতিল করা হবে? এ রকম মনোভাব ভালো নয়। এতে বিশ্বে এমন একটি ধারণার সৃষ্টি হয় যে বাংলাদেশের কোনো স্থিরতা নেই, নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেই আগের সরকারের সবকিছু বাতিল করে। এতে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দৃঢ়তর করার ক্ষেত্রেও দেখা দেবে সমস্যা।
এটা শুধু বিএনপির দোষ নয়, দোষ আওয়ামী লীগেরও। তারাও ক্ষমতায় এসেই নাম বদলানো, ফলক ভাঙা শুরু করে। এর আগে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পর্যায়ক্রমে একই কাজ করেছে। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের সময় থেকে সেই যে শুরু হয়েছে, এখনো চলছে। বাংলাদেশ বেতার থেকে রেডিও বাংলাদেশ, জয়বাংলার বদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, ঢাকা বিমানবন্দর থেকে জিয়া, তারপর এখন হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (যদিও টিকিটে বা বিশ্বের বিভিন্ন বিমানবন্দরের ডিসপ্লে বোর্ডে এখনো লেখা থাকে ডিএইচকে, মানে ঢাকা), যমুনা সেতু থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু, ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম। আর কত? যথেষ্ট হয়েছে। এবার সহনশীল রাজনীতির পথে ফিরে আসা দরকার।
এটা কি সম্ভব? অনেকে হতাশ। কিন্তু আশাবাদীর সংখ্যাও কম নয়। সরকারের দুই বছর বিষয়ে প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, বিএনপি সংসদে না গেলেও সংসদীয় কমিটির সভাগুলোতে তাদের সাংসদেরা সব সময় অংশ নেন এবং কমিটির সভায় তাঁরা দলীয় অবস্থান থেকে নয়, বরং দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। সেখানে অনেক সময় সরকারদলীয় সদস্য সরকারের অবস্থানের বিরুদ্ধে যান, আবার বিরোধীদলীয় সদস্যরা সরকারের পক্ষেও অবস্থান নেন। বাইরে যত বিরোধই থাকুক না কেন, ভেতরে যদি সরকারের নীতিগত বিষয়ে সরকার ও বিরোধীদলীয় সাংসদেরা মতৈক্যে চলতে পারেন, তাহলে সেটাও এক বড় অগ্রগতি।
বিএনপি আয়কর নথি খুলেছে। একটা টিন নম্বর নিয়েছে। বলেছে, আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতার জন্য তারা এই পদক্ষেপ নিয়েছে। বিএনপির এই পদক্ষেপকে সবার সমর্থন জানানো উচিত। যদিও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবে আয়কর নথি খোলার আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই, তা-ও অধিকন্তু ন দোষায়! ভালো কাজ একটু বেশি করলে ক্ষতি নেই। বিএনপি এটা করে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আওয়ামী লীগসহ সব দলেরই উচিত এই পথ অনুসরণ করা। স্বচ্ছতা এখন সর্বত্র আলোচিত বিষয়। দলের স্বচ্ছতা সর্বাগ্রে দরকার।
এভাবে কিছু লেনদেন হোক। সরকারের ভালো কাজ বিরোধী দল সমর্থন করুক। বিরোধী দলের ভালোটা সরকার গ্রহণ করুক। পরস্পর থেকে দূরে সরে না গিয়ে কাছে আসার চেষ্টা করাই ভালো। বৈরিতা বিশ্বের কোনো দেশেই মঙ্গল বয়ে আনেনি। আমাদের এই বাংলাদেশেই দেখেছি, স্বৈরশাসক এরশাদকে হঠানোর জন্য দুই নেত্রী, দুই জোটের মতৈক্য ও যুগপৎ আন্দোলনের ফলেই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়েছিল। আওয়ামী লীগ-বিএনপি মতৈক্যে আসতে পেরেছিল বলেই একানব্বইয়ের সংসদে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল।
আজ আবার দুই দল শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন, খাদ্যনিরাপত্তা, গ্যাস-বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি জরুরি জাতীয় ইস্যুতে এক হয়ে দাঁড়াক।
তবে সবচেয়ে আগে বিএনপি সংসদ অধিবেশনে আসুক। মতৈক্য সৃষ্টির সেটাই হতে পারে প্রথম সোপান।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.