'জেনারেটর ব্যবসার' আড়ালে রাজধানীতে বিপুল বিদ্যুৎ চুরি by শতদল সরকার

বিদ্যুৎ অফিসের সবাই খুব ভালো কইরা কাম করে। দ্যাখেন, রাইত ৩টার সময়ও আমগো এইখানে ঘড়ি ধইরা লোডশেডিং করে। একটু এদিক-সেদিক হয় না। তয় একটা ব্যাপার বুঝবার পারতাছি না, আইপিএস নাই, জেনারেটর ছাড়াই চকবাজারে বিদ্যুৎ চইলা গেলেও বিদ্যুতের বাতি নেভে না ক্যান।


ফ্যানও দেখি ঘোরে। এই বিদ্যুৎটা অরা কোনহানে পায়? এইটা ক্যামনে হয়!'
একদিকে তীব্র লোডশেডিংয়ের ভোগান্তি, অন্যদিকে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্তিতে এভাবেই বিস্ময় প্রকাশ করেন পুরান ঢাকার উর্দু রোডের বাসিন্দা মোহাম্মদ সোলায়মান। এই প্রশ্ন শুধু সোলায়মানের নয়, গত চার দিন কালের কণ্ঠের সরেজমিন অনুসন্ধানকালে সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের যাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে তিনিই এমন প্রশ্ন তুলেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বছরে কয়েক কোটি টাকার বিদ্যুৎ চুরি করে একদল অসাধু ব্যক্তি বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। শুধু পুরান ঢাকায়ই প্রতিদিন কয়েক হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ চুরি করে অবৈধ সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। এভাবে সরকারের বিদ্যুৎ চুরি করে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বিপুল অর্থ।

বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর জেনারেটর সংযোগ দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী ব্যবসায়ীরা এই বিদ্যুৎ চুরির হোতা। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও একদল অসাধু ব্যবসায়ী। তারা বিদ্যুতের প্রধান সংযোগের সঙ্গে অতিরিক্ত একটি তার লাগিয়ে দিনের পর দিন বিদ্যুৎ চুরি করছে। এভাবে কেবল পুরান ঢাকায়ই প্রতিদিন কয়েক হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ চুরি হয়ে যাচ্ছে। কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সরকার।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিদ্যুৎ বিতরণ লাইনের দুটি বা এর অধিক ফিডার কাছাকাছি রয়েছে- এমন জায়গা বেছে নিচ্ছে চোরেরা। তারা দুটি কিংবা তারও অধিক ফিডার থেকে বিদ্যুতের সংযোগ নেয়। ফলে একটি ফিডারের বিদ্যুৎ বন্ধ হলে চালু অপরটি থেকে বিদ্যুৎ চুরি করে তারা।
এ ছাড়া বিদ্যুতের তারের সঙ্গে যেকোনো বাসার কাছ থেকে একটি আংটা লাগিয়ে আবাসিক ভবনের সংযুক্ত লাইনের সঙ্গে তার যুক্ত করে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ চুরি করা হয়। সাধারণত ফুটপাতের দোকান, ক্লাব, দখল করা দলীয় কার্যালয় ও টিনের ঝুপরি ঘরে বিদ্যুতের সংযোগ নিয়ে কয়েক হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ চুরি করা হচ্ছে।
গত শুক্রবার বেড়িবাঁধের ওপর একটি ট্রাকস্ট্যান্ড ও ট্রাকচালকদের ক্লাবে দেখা যায় টেলিভিশন দেখছেন ট্রাকের অর্ধশত চালক। এই বিদ্যুতের সংযোগ কিভাবে এলো- জানতে চাইলে চালক জাহাঙ্গীর মোল্লা বলেন, 'ওপরে থেইকা লাইন টাইনা লইছি। এইখানে সবই এমতে টানা লাইন।'
বিদ্যুৎ আছে মিটার নেই : চকবাজার এলাকায় ফুটপাতের দুই শতাধিক দোকানে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুতের আলো জ্বলে। অথচ কোনো মিটার নেই। শাহজাদা পাঞ্জাবির দোকানের মালিক আলমগীর হোসেনের প্রশ্ন, 'এইখানে ২৪ ঘণ্টা আড়াই শ বাতি জ্বলে। অথচ একটা দোকানেও বিদ্যুতের মিটার নাই; লাইন নেয় নাই। এই বিদ্যুৎ কোথা থেইকা আইলো?' কয়েকজন বাসিন্দা অভিযোগ করেন, চোরের দল এভাবে বিদ্যুৎ দিয়ে মাসোহারা আদায় করে।
বিদ্যুৎ চুরি কেবল পুরান ঢাকার চৌধুরীবাজার, ইসলামবাগ ও কামালবাগে সীমাবদ্ধ নেই। একই অবস্থা চোখে পড়েছে নিউ মার্কেট, কামরাঙ্গীরচরের কারখানা ও ফুটপাত, পান্থপথ ও মিরপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক সুকুমার চন্দ্র রায় বলেন, জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন লাগে। কিন্তু রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এই অনুমোদন ছাড়াই চলছে জেনারেটর ব্যবসা। অব্যাহতভাবে চলছে বিদ্যুৎ চুরি।
সংশ্লিষ্ট এলাকার দোকান মালিকরা জানান, চকবাজারের কাছাকাছি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের যথাক্রমে রহমতগঞ্জ, নিউ রহমতগঞ্জ ও হায়দারবক্স লেনের তিন ফিডার থেকে সংযোগ নিয়ে জেনারেটরের নামে অবৈধ বিদ্যুতের ব্যবসা করছেন ঠাণ্ডু মিয়া ও মোহাম্মদ হাসান। ঢাকা সিটি করপোরেশন মার্কেটের পেছনের গলিতে জেনারেটর সংযোগ দিয়ে তাঁরা বিদ্যুতের ব্যবসা করছেন। আর অন্তরালে বিদ্যুতের তিনটি ফিডারের সংযোগ নিয়ে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ চুরি করছেন।
এ ছাড়া জেনারেটরের নামে বিদ্যুৎ চুরির অভিযোগ পাওয়া গেছে তাজমহল মার্কেটের এনাম, লালবাগ চৌরাস্তা এলাকার পাপ্পু, পুরনো চক মার্কেটের নুরুদ্দিন এবং নূর আলী হোল্ডিং থেকে আফতাব প্লাজা পর্যন্ত মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে।
এই বিদ্যুতের গ্রাহক দোকান মালিকরা জানান, সব ফিডারে একসঙ্গে বিদ্যুৎ চলে গেলেই কেবল তাঁরা জেনারেটরের বিদ্যুৎ পান। তখন বাতি কম জ্বলে এবং ফ্যানও কম ঘোরে। অধিকাংশ সময়ই বিদ্যুতের সরাসরি সংযোগ থেকেই তাঁদের বিদ্যুৎ দেওয়া হয়। এ কারণে বাতির আলো কমে না, ফ্যানের গতিও কমে না।
কাঁটাবন ৩৩/১১ কেভি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মজিবুর রহমান এ ব্যাপারে বলেন, বিষয়টি তাঁদের গোচরে রয়েছে। মাঝেমধ্যে তাঁরা অভিযানে গেলেও আগেই টের পেয়ে অবৈধ ব্যবসায়ীরা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখে।

No comments

Powered by Blogger.