রাজনীতি-জনসমর্থন ধরে রাখতে হবে by আবদুল মান্নান

দেখতে দেখতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের দুই বছর পূর্ণ হতে চলল। সরকার তো বটেই, যাঁরা সরকারের বাইরে থাকেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিজয়ী হলে আনন্দিত হন, তাঁরা নিশ্চয়ই এখন হিসাব-নিকাশ করছেন গত দুই বছরের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির।


এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য, যখনই এ দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছে, তাদের কাছে প্রত্যাশাও অনেক বেশি ছিল। সত্তরের নির্বাচনে যখন বাঙালি উজাড় করে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে সারা দুনিয়াকে অবাক করে দিয়েছিল, তখন তাদের প্রত্যাশা ছিল আওয়ামী লীগ এ দেশের মানুষকে পাকিস্তানের শোষণ ও শাসন থেকে মুক্ত করবে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তা করেছিল। স্বাধীনতার পর মুক্ত বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন। বঙ্গবন্ধুর সরকার তা অনেকাংশে করেও এনেছিল, কিন্তু তা শেষ করার আগেই মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট ঘাতকের বুলেট তাঁকে বাঙালির কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত, দীর্ঘ ২১ বছর আওয়ামী লীগকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ক্ষমতায় ফিরে আসতে। এই উপমহাদেশের রাজনীতিতে এত দীর্ঘ বিরতির পর একটি রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় ফিরে আসা একটি নজিরবিহীন ঘটনা। পাকিস্তানে মুসলিম লীগ পঞ্চাশের দশকে সেই যে একবার ক্ষমতা থেকে উৎখাত হলো, আর কখনো ক্ষমতায় ফিরে আসেনি, যদিও ওই নামে আরও একাধিক মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছে। ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর কংগ্রেস ঠিক আগের শক্তি নিয়ে বেশি দিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। বাংলাদেশে বিএনপি এখন ক্ষমতার বাইরে। আর এক টার্ম যদি দলটিকে ক্ষমতার বাইরে থাকতে হয়, তাহলে তারও বিলুপ্তি ঘটতে পারে বলে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন। আওয়ামী লীগের এত দীর্ঘ বিরতির পর ক্ষমতায় ফিরে আসা অথবা দল হিসেবে টিকে থাকা এবং শক্তিশালী হওয়ার অন্যতম কারণ দলটির প্রতি গণমানুষের ব্যাপক সমর্থন ও আস্থা। তবে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, অনেক সময় দলের নেতারা জনগণ যে তাঁদের শক্তির উৎস, তা বুঝতে পারেন না। এই না পারার কারণে তাঁরা সমর্থনের জন্য সময় সময় অপ্রত্যাশিত জায়গায় হাত বাড়ান।
স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর সর্বমহলে এটি প্রত্যাশিত ছিল ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগই বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করবে। তা না হওয়ার প্রধান কারণ ছিল অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাস এবং নির্বাচন পরিচালনায় ঠিকমতো যত্নশীল না হওয়া। ১৯৯১ সালের অভিজ্ঞতার আলোকে ১৯৯৬-এর নির্বাচনে কিছুটা ভালো করলেও সরকার গঠনের জন্য তার প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। এরশাদের জাতীয় পার্টি আর জাসদের সমর্থন নিয়ে শেখ হাসিনাকে সরকার গঠন করতে হয়েছিল। সরকার গঠনে এরশাদের জাতীয় পার্টির সমর্থন নেওয়াটা কতটুকু যুক্তিসংগত ছিল, সে প্রশ্নের মুখোমুখি এখনো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে হতে হয়। ১৯৯৬ সালে ২১ বছর বিরতি দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও তার প্রথম দুই বছর চলে যায় ঘর গোছাতে। প্রশাসনে আস্থাভাজন বলতে প্রায় কেউই ছিল না। এ সময় সরকার অনেক ক্ষেত্রে নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে। অনেকটা ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ সিনড্রম। তার পরও সে আমলে শেখ হাসিনা সরকারের একাধিক অর্জন মানুষকে আশান্বিত করে। সে সময়ের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল পার্বত্য চুক্তি ও ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি। ২০০১ সালের নির্বাচনে আবারও পরাজয়। এর কারণ মূলত সময়মতো লতিফুর রহমান-আবু সাঈদ গংদের পক্ষপাতমূলক আচরণ, রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নির্লিপ্ততা সম্পর্কে সঠিকভাবে সচেতন না হওয়া, ১৯৯১ সালের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা না নেওয়া এবং মেয়াদের শেষের দিকে এসে কতিপয় মন্ত্রী-সাংসদের সন্তানদের লাগামহীন সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজি—বর্তমানে যার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে ছাত্রলীগ আর যুবলীগ।
২০০৬ সালে চারদলীয় জোট সরকারের মেয়াদ শেষে যদি সময়মতো একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো, তাহলে এটি মোটামুটি ধরে নেওয়া যায়, আওয়ামী লীগই জয়ী হতো। কারণ, জোট সরকারের পাঁচ বছরের দুঃশাসন। অনেকটা জোর করে ক্ষমতায় থাকতে চাওয়ার কারণেই জোটের পরাজয় দেখতে জনগণকে আরও দুই বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর আগের ধারাবাহিকতায় এবারও জনগণের প্রত্যাশা ছিল অনেকটা আকাশচুম্বী। তারা জোটের অতীত দুঃশাসনের কবল থেকে মুক্তি চাইছিল এবং একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল। শেখ হাসিনাও তা বুঝতে পেরেছিলেন এবং নির্বাচনী ইশতেহারের স্লোগান ছিল ‘দিনবদলের সনদ’। দুই বছরের মাথায় এসে যদি একজন শিক্ষক হিসেবে সরকারের এ সময়ের কাজের মূল্যায়ন করে তাকে গ্রেড দিতে বলা হয়, তাহলে ‘বি প্লাস’ পর্যন্ত দেওয়া যেতে পারে। এটাও মনে রাখতে হবে, আগামী বছরগুলোতে বি প্লাস থেকে নিচে সি অথবা ওপরে এ গ্রেডেও আসা-যাওয়া সম্ভব। এসব কিছু নির্ভর করবে সরকারের আগামী দিনের কর্মকাণ্ডের ওপর। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি মন্ত্রিসভার এক সভায় বলেছেন, ‘এখন জনগণ সরকারের কাজের মূল্যায়ন করবে। এখন জনপ্রিয়তায় ভাটার টান পড়বে। দুই বছর ভালো গেছে। আগামী তিন বছর সবকিছু দ্রুত করতে হবে।’ এমন উপলব্ধির জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। তবে বলে রাখা ভালো, বাস্তবে সবকিছু শেষ করার সময় গোনা শুরু হবে দুই বছর পর। কারণ, সাধারণত প্রশাসন শেষের বছরে পরবর্তী সরকারের জন্য কাজ করে।
দুই বছরের মাথায় এটি বলতে দ্বিধা নেই, ১৯৯৬ বা ২০০১-এর শেখ হাসিনা এবং ২০০৮-এর শেখ হাসিনার মধ্যে পার্থক্য আকাশ-পাতাল। এখনকার শেখ হাসিনা অনেক বেশি সাহসী, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং নেতা হিসেবে ঝুঁকি নিতে অভ্যস্ত হয়েছেন। তবে একটা কথা না বললেই নয়, আর তা হচ্ছে, শেখ হাসিনার শুভার্থীরা মনে করেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকুন আর না-ই থাকুন, সব সময় এমন কিছু ব্যক্তি দ্বারা তিনি পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েন, যাঁরা তাঁর লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করেন। তাঁর শুভার্থীরা এখনো এই আশঙ্কা থেকে মুক্ত নন। তাঁদের ধারণা, এদিকে প্রধানমন্ত্রী একটু নজর দিলে তাঁর এবং দেশের জন্য মঙ্গল হবে।
গত দুই বছরে বর্তমান সরকারের বড় সফলতা ছিল বিডিআর বিদ্রোহ এবং আইলার মতো দুটি বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা। বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিগত জোট সরকারের আমলে যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছিল, আশা করা যাচ্ছে, আগামী গ্রীষ্মকালের আগেই তা সহনীয় পর্যায়ে পৌঁঁছাবে। প্রত্যাশা করা হচ্ছে, আগামী এক বছরে জাতীয় গ্রিডে আরও তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ হবে। এটি সম্ভব হবে নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র স্থাপনের কারণে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও তা আরও উন্নতি হওয়ার দাবি রাখে। মানবাধিকারের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। এক ক্রসফায়ারই সরকারের মানবাধিকার সংরক্ষণ বিষয়টাকে দেশে এবং দেশের বাইরে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বর্তমান সরকারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সফলতা এসেছে দেশের কৃষি ক্ষেত্রে। শেখ হাসিনার বড় সৌভাগ্য, তাঁর মন্ত্রিসভায় একজন মতিয়া চৌধুরী আছেন, যিনি হতে পারেন শিক্ষানবিশ মন্ত্রীদের রোল মডেল। যাঁরা এটি করতে পেরেছেন, তাঁরা সফলতা দেখাতে পেরেছেন। আর যাঁরা পারেননি, তাঁদের ব্যর্থতা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন—এখনো তাঁদের কেন মন্ত্রিসভায় রাখতে হবে? শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের নেতৃত্বে তাঁর মন্ত্রণালয়ের সাফল্য জাতিকে আশান্বিত করেছে। স্বল্পতম সময়ে তিনি একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি উপহার দিয়ে প্রমাণ করেছেন, নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে পারলে অনেক কঠিন কাজও সহজভাবে করা সম্ভব। গত বছর শেষ মুহূর্তে তিনি যেভাবে স্কুলপাঠ্য বইয়ের সংকট কার্যকরভাবে মোকাবিলা করেছেন, তা একটি অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্যতম অঙ্গীকার ছিল ক্ষমতায় গেলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করা। কাজটি সরকার কিছুটা দেরিতে হলেও শুরু করেছে। মানুষ প্রত্যাশা করে, অন্তত মূল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ বর্তমান সরকারের আমলেই শেষ হবে। দুটি বিষয় নিয়ে আগামী দিনে বর্তমান সরকারকে আরও কার্যকরভাবে ভাবতে হবে। প্রথমটা হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি। এর কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে গড়ে ওঠা শক্তিশালী সিন্ডিকেট। বর্তমান অবস্থায় মনে হয়, পুরো বাজারব্যবস্থা সরকার এই সিন্ডিকেটের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে, দেশব্যাপী ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নামধারী কিছু দুর্বৃত্তের বেপরোয়া দুর্বৃত্তপনা। আগামী দিনে আওয়ামী লীগ বা মহাজোটকে যদি কোনো বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে তা হবে এদের কারণেই। যানজট-সমস্যার কোনো উন্নতি এত দ্রুত হওয়া সম্ভব নয়। একমাত্র দক্ষ ও সুষ্ঠু জনপরিবহনব্যবস্থা সে সমস্যার সমাধান এনে দিতে পারে। সরকারের কিছু মন্ত্রীর লাগামহীন অতিকথন অনেক সময় সরকারকেই বেকায়দায় ফেলে। দেখা যায়, একই বিষয়ে একই টেবিলে বসে দুজন মন্ত্রী দুই রকমের বক্তব্য দিচ্ছেন। এটি সাধারণ মানুষকে শুধু বিভ্রান্তই করে না, বিরক্তও করে। দু-একজন মন্ত্রী আছেন, যাঁরা এখনো রাজপথে স্লোগান দেওয়া অথবা পুলিশের প্রতি ঢিল ছোড়া দলীয় কর্মীর বাইরে নিজেদের চিন্তা করতে পারেন না। জনগণ আশা করে, সামনের দিনগুলোতে তাঁরা তাঁদের আচরণ পরিবর্তন করতে সক্ষম হবেন।
শেখ হাসিনা তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে রূপকল্প ২০২১-এর কথা বলেছেন। তা বাস্তবায়ন করতে হলে জনগণের সমর্থন ধরে রাখতে হবে, যার প্রস্তুতি শুরু করার সময় এখনই। এর কোনো বিকল্প নেই। যে দলটির নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, সে দলটির নেতৃত্বেই বাংলাদেশ তার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে—এটাই তো প্রত্যাশিত। সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে শিক্ষক, ইউল্যাব, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.