প্রতিক্রিয়া-লোটাটা, বদনাটাও চাই by শাহ্দীন মালিক

নকলটা কখনোই আসলের মতো হবে না, হতে পারে না। আনিসুল হকের প্রথম আলোতে নিয়মিত প্রকাশিত ‘গদ্যকার্টুন’ আমার ভীষণ পছন্দ। তার লেখায় প্রভাবান্বিত হয়ে অনুকরণের খায়েশ। তাই আগেভাগেই বলে রাখছি—নকলটা আসলের মতো হবে না। অতএব পাঠক সাবধান।


দুটোই কেচ্ছা। একটা পুরোনো, একটা নতুন। পুরোনো কেচ্ছাটা পার্সি কবি শেখ সাদীর। যেহেতু কেচ্ছা, তাই একটু-আধটু এদিক-সেদিকে বাধা নেই। শেখ সাদী রাজদর্শনে যাওয়ার পথে রাত ঘনাল। পথের এক সরাইয়ে রাত্রিযাপনের জন্য প্রবেশ। সরাই মালিকসহ কেউই বিশেষ পাত্তা দিল না। সাধারণ আহার জুটল। সরাইয়ের এক কোনায় কোনোমতে রাত্রিযাপন। রাজদর্শনের পর ফিরতি পথে আবার—এবার ইচ্ছা করে, পরিকল্পনামাফিক—সরাইটিতে রাত্রিযাপনের জন্য যাত্রাবিরতি। এবার সরাইয়ে প্রবেশ করা মাত্র মালিকসহ সবাই হন্তদন্ত হয়ে তার আদর-আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে উঠল। ভালো ভালো খাবার-দাবার এল। শেখ সাদী তখন খাবার মুখে না পুরে তার অতি দামি জামা-কাপড়ের বিভিন্ন পকেটে পুরতে শুরু করলেন। প্রথমবার তার বেশ-ভূষা ছিল মলিন, জীর্ণ-শীর্ণ। এবার রাজা-প্রদত্ত অত্যন্ত দামি জাব্বা-জোব্বা। সে সুবাদে সরাই মালিকের আদর-আপ্যায়ন। তাই শেখ সাদী খাদ্য খাওয়ালেন তার জামাকাপড়কে।
কেচ্ছাটাতে বাইরের জৌলুশসংক্রান্ত কিছু নীতিকথার ইঙ্গিত নিশ্চয় ছিল। অর্থাৎ ওসব এখন অতীতের ব্যাপার।
বর্তমানের কেচ্ছা। ফ্লাগসহ গাড়ি পেয়েছেন এক ভদ্রলোক। বিরাট পদ, ঢাউস গাড়ি, ফ্লাগটাও সিল্কের। ভদ্রলোক পরিদর্শনে ঢাকার বাইরে যাবেন দুই দিনের জন্য। পাজেরো দরকার। অফিসে পাজেরো গাড়ি নেই। ঢাকার বাইরে এখন উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সবারই পাজেরো আছে। অতএব পাজেরো ভাড়া করো! পাজেরো এল। কিন্তু রেন্ট-এ-কার থেকে দুই দিনের জন্য ভাড়া করা পাজেরোতে আর ফ্লাগস্ট্যান্ড নেই। দুনিয়া জাহান্নামে যেতে পারে কিন্তু ফ্লাগঅলা ভদ্রলোক তো ফ্লাগস্ট্যান্ড ছাড়া গাড়িতে চড়তে পারেন না। রেন্ট-এ-কার কোম্পানিও পেয়ে বসল। ফ্লাগস্ট্যান্ড লাগানো এবং দুই দিন পরে ফ্লাগস্ট্যান্ড গাড়ি থেকে খুলে নিতে হবে। ডেন্টিং-পেইন্টিংয়ের অনেক বাড়তি খরচ। দফারফা হলো। দুই দিনের জন্য ফ্লাগস্ট্যান্ড লাগানো-খোলা। আনুষঙ্গিক ডেন্টিং-পেইন্টিং। দুই দিনের গাড়ি-ড্রাইভার ভাড়া। হাজার হলেও পাজেরো গাড়ি তো। সর্বসাকল্যে এক লাখ ১০ হাজার টাকা গাড়ি ভাড়া।
শুনেছি, উঠতি রাজনীতিবিদেরা ঢাকা থেকে নিজ নিজ এলাকায় গেলে নাকি আজকাল পাজেরো ভাড়া করে যান।
শেখ সাদীর সময়টা ছিল মধ্যযুগের ইরান। এখন আমরা আধুনিক গণতন্ত্রের বাংলাদেশে বসবাস করছি।
বাংলাদেশের আধুনিক গণতন্ত্রের নমুনা আবার আজ দেখলাম পত্রপত্রিকায়। ক্যাবিনেট মিটিংয়ে মন্ত্রী-সচিবেরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবদার করেছেন, মন্ত্রী-সচিবপ্রতি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ২০টা করে টিকিট। ফ্লাগঅলা গাড়িতে চড়ে গিয়ে আমজনতার মতো তো টিকিটের লাইনে আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। মন্ত্রী-সচিবেরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলে দেশ কীভাবে চলবে। মন্ত্রী-মিনিস্টার-সচিবদের পরিবার আছে, আত্মীয়স্বজন আছে, এলাকার নেতা-কর্মী আছে, ২০টা টিকিটে কীভাবে কুলাবে? সবাইকে অন্তত এক শটা করে টিকিট দেওয়া গণতান্ত্রিক সরকারের অবশ্যকর্তব্য।
আধুনিক-গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে আইন প্রয়োগ হয় বিরোধীদের বেলায়। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে কানাকড়ি সম্পর্ক থাকলেই হয় মামলা প্রত্যাহার।
মন্ত্রী-সচিবদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধাসংক্রান্ত আইন বোধ হয় আছে। বোধ হয় বলছি, কারণ যাদের জন্য এই আইন, নিয়মরীতি-নীতি তাঁরা এসবের খোঁজ রাখেন না। আর তাই আমরা যেহেতু মন্ত্রী-মিনিস্টার না তাই আমাদের জন্য আইনগুলো ‘বোধ হয়’। আইন অনুযায়ী প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধার জন্য ওয়ার্ল্ড কাপ টিকিটের কথা সম্ভবত বলা নেই। যেটা আইন অনুযায়ী প্রাপ্য না সেটা চাওয়া, দাবি করা, পাওয়া অতীতে বেআইনি কাজ বলে গণ্য হতে পারত।
এখন দিন বদলেছে। এখন সবই আমার। গাড়ি আমার, বাড়ি আমার, ফ্লাগ আমার, খাল-বিল-নদী-নালা সবই আমার। মায় ক্রিকেটের টিকিট পর্যন্ত।
ক্রিকেট খেলার দিনগুলোতে স্টেডিয়ামে মন্ত্রিসভার মিটিং করলেই ল্যাঠা চুকে যায়। রথ দেখা কলা বেচা—দুটোই হবে। তবে স্টেডিয়ামে মন্ত্রিসভার বৈঠকের জন্য প্রয়োজনীয় লোটা-বদনা বোধ হয় নেই। সবাই মিলে না আবার লোটা-বদনা চেয়ে বসে।
ড. শাহ্দীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট, শিক্ষক, ব্র্যাক স্কুল অব ল।

No comments

Powered by Blogger.