শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস প্রসঙ্গে by হায়দার আকবর খান রনো

গত এক বছর থেকেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটে ভালো ছিল না। বিশেষ করে ছাত্রাঙ্গনে সন্ত্রাস, সশস্ত্র সংঘর্ষ ও হত্যার ঘটনা যে কোনো শান্তিপ্রিয় সুস্থ চিন্তার মানুষকে বিচলিত না করে পারে না। তার ওপর বিগত কয়েক দিনের পরপর কয়েকটি ঘটনা আমাদের উদ্বেগকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে।

সর্বশেষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির কর্তৃক ছাত্রলীগ কর্মীকে নৃশংসভাবে হত্যার যে ঘটনা দেখলাম, তা চরম বর্বরতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ঘটনার পরপর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু দ্রুত ছুটে গেছেন রাজশাহীতে। তিনি হত্যাকারী শিবিরের ও তাদের অভিভাবক দল জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। পাঠকরা নিশ্চয় জানেন যে, জামায়াত-শিবিরের প্রতি আমার ব্যক্তিগত সহানুভূতি কোনোদিনই ছিল না। এই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াত-শিবিরের হাতে ছাত্র মৈত্রীর কয়েকজন নেতাকর্মী নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়েছিলেন। জামিল আখতার, রুমীসহ অনেকেই নিহত হয়েছেন। শিবির সম্পর্কে রগ কাটার অভিযোগ সাধারণভাবে প্রচলিত আছে। তবে যে কোনো ঘটনায় আমি ব্যক্তিগত দুর্বলতা বা আক্রোশ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পরিচালিত হতে চাই না। প্রকৃত দোষী যে-ই হোক, তার শাস্তি হওয়া দরকার বলে আমি মনে করি। আমার ধারণা, অধিকাংশ মানুষই তাই চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একই কথা বলেছেন। রাজশাহীর ঘটনার পর উত্তরবঙ্গে পুলিশি অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবির কিংবা ছাত্রদল—যারাই জড়িত থাকুক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। দলীয় নেতা হলেও দেশ পরিচালনার প্রধান দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধানমন্ত্রীর এই ধরনের নিরপেক্ষতা রক্ষা করে চলা কাঙ্ক্ষিত বলে আমরা মনে করি।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও বাস্তব ঘটনার মধ্যে অনেক ফারাক রয়েছে। রাজশাহীতে ছাত্রলীগ কর্মী নিহত হওয়ার পরপর সরকার যে ধরনের তত্পরতা দেখিয়েছে, অন্যান্য ক্ষেত্রে তেমনটা দেখা যায় না। রাজশাহীর এই ঘটনার মাত্র কয়েকদিন আগে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সশস্ত্র সংঘর্ষের ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্র নিহত হয়েছিল। সত্যিকার অর্থে এটাকেই বলে ক্রসফায়ার। অর্থাত্ নিহত আবু বকর সিদ্দিক সংঘর্ষরত দুই গ্রুপের কোনোটার মধ্যেই ছিলেন না। দুই পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি মারা গেলে সেটা হলো একটা অ্যাকসিডেন্ট, দুর্ঘটনা। তাকেই বলা হয় ক্রসফায়ার। প্রকৃত আভিধানিক অর্থ তাই। কিন্তু এখন ক্রসফায়ার মানে যা প্রচলিত আছে তা হচ্ছে মিথ্যা ভাষণ, বানোয়াট গল্প। এখন কোনো ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে র্যাব, যৌথ বাহিনী বা পুলিশ যখন ম্যাজিস্ট্রেট বা কোর্টের কাছে সোপর্দ করার আগেই, এমনকি থানা হাজতে ঢুকানোর আগেই ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করে, সেটাকেও ক্রসফায়ার বলে চালানো হয়। এর ফলে দুটি হত্যা হয়। এক মানুষ হত্যা, দুই সংবিধান এবং গণতন্ত্রকেও হত্যা করা হয়।
যাই হোক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সিদ্দিককে হত্যা করা হয়েছিল, তা ছিল একটা দুর্ঘটনা। বিবদমান ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ চলাকালে মেধাবী ছাত্রটি প্রাণ হারাল। এখন যেমন সরকার খুবই তত্পর হয়ে অভিযুক্ত শিবিরের কর্মীদের গ্রেফতার করার জন্য স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ‘শিবিরের ঘাঁটি গুড়িয়ে দেয়ার’ হুঙ্কার দিয়েছে, তেমনটি দেখিনি অন্যান্য ক্ষেত্রে, যেখানে অভিযুক্ত হচ্ছে ছাত্রলীগ নেতা বা কর্মীরা। প্রধানমন্ত্রী যদিও বলেছেন যে দোষী হলেই শাস্তি হবে—ছাত্রলীগ, শিবির বা ছাত্রদলের মধ্যে ভেদাভেদ তিনি করবেন না। কিন্তু বাস্তবে তার সরকার ও প্রশাসনের আচরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। ছাত্রলীগ হলে বাঁচানোর চেষ্টা করো, বিরোধী পক্ষ হলে কঠোর হস্তে দমন করো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় ছাত্রলীগ জড়িত ছিল। কারণ তাদের অন্তর্দ্বন্দ্বের জের হিসেবে প্রাণ হারাল এমন এক ছাত্র যে এই দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে কিছুই জানে না। হয়তো ছাত্র রাজনীতির খবরও রাখে না। সম্ভবত মন দিয়ে পড়াশোনা করতেই এসেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমন এক ছাত্রের মৃত্যুর পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন কী বললেন? তিনি বললেন, ‘এটি স্বাভাবিক ঘটনা, বিচ্ছিন্ন ঘটনা, এমনটা ঘটতেই পারে।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করেন, তখন সরকারি ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসীরা যে আরও উত্সাহ পাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এটাই তার শেষ কথা নয়। এরপর তিনি মন্তব্য করলেন, এই ঘটনার জন্য নাকি দায়ী ছাত্রদল। চমত্কার সব যুক্তি। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের কোন্দল, সেখান থেকে সংঘর্ষ। তারই ফলশ্রুতি নিরীহ ছাত্রের মৃত্যু। এখানে ছাত্রদল এলো কোথা থেকে? ছাত্রদল যে একেবারে ধোয়া তুলসী, একথা নিশ্চয়ই বলব না। যখন তাদের প্রভাব ছিল, তখন তারাও সন্ত্রাস করেছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দল এখনও আছে। কিন্তু এবারের ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড অতীতের সব সন্ত্রাসী রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, সেদিনের ঘটনায় ছাত্রদল কীভাবে জড়িত হলো? যুক্তিবিহীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তা বলা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে বর্তমান সরকারের মন্ত্রীদের। বিশেষ করে কয়েক জনের তো বটেই।
আমার দেশ পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে কিছু উদ্ধৃত করা যাক।
“গত সপ্তাহে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় আহত হয়ে পরে হাসপাতালে মারা যান ইসলামের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র আবু বকর সিদ্দিক। এ মৃত্যুর ঘটনাকে ‘স্বাভাবিক ও ঘটতেই পারে এবং এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ মন্তব্য করার দুদিনের মাথায় ওইদিনের ঘটনার জন্য ছাত্রদলকে দায়ী করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে ছাত্রদলের ইন্ধন থাকার ইঙ্গিত দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে ঢুকে ছাত্রদল এই অরাজকতা করছে।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেছেন, ছাত্রদল বলেন আর বিএনপি বলেন, তারা চাইবেই আমাদের ক্ষতি করতে। তারাই আমাদের দলে ঢুকে এ ঘটনা ঘটাচ্ছে।”
এখানে উল্লেখ্য, যে সশস্ত্র বন্দুকধারী ছেলেটির ছবি ছাপা হয়েছিল প্রায় সব কাগজে সে এবং এর আগে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে গোলাগুলি হয়েছিল সেখানে অস্ত্রহাতে যে ছেলেটির ছবি ছাপা হয়েছিল, সেও অপরিচিত ছেলে নয়। উভয়ই ছাত্রলীগের কর্মী ও স্থানীয় পর্যায়ের কর্মকর্তা। ছাত্রলীগের মধ্যে যদি ছাত্রদলের ছেলেরা ঢুকে এতটা ক্ষমতাবান হয়ে উঠতে পারে, তাহলে তো ছাত্রলীগের ভবিষ্যত্ নিয়েই আমরা ভাবিত হয়ে পড়তে বাধ্য হব। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বোঝা উচিত, এভাবে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। নিজের দোষ বিনা যুক্তিতে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে বাস্তবকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। যারা সবই দেখছেন এবং বুঝছেন, তারা এরই মধ্যে ছাত্রলীগের ওপর মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন, যা কোনো একদিন আক্রোশের রূপ নিতে পারে। একই সঙ্গে আরও যে ইমপ্রেশনটা জনগণ নিচ্ছে তা হলো, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীরা সত্য কথা বলেন না। ২০০৮ সালের নির্বাচনে যারা হয়তো বড় আশা নিয়ে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল, তাদের একটা বড় অংশ এরই মধ্যে মন্ত্রীদের আবোল-তাবোল কথাবার্তায় এবং সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও দ্রব্যমূল্যের কারণে অনেকদূর সরে গেছেন। সে খবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো মন্ত্রীদের জানা আছে কি-না আমি জানি না।
মন্ত্রীদের মন্তব্য এখানেই শেষ নয়। ১৪ দলের বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বললেন, ছাত্রলীগের মধ্যে চিহ্নিত শিবির ঢুকে পড়েছে। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটির চারটি গুরুত্বপূর্ণ হলে চিহ্নিত শিবিরপন্থীরা রয়েছে। উল্লেখ্য, মাত্র কয়েকদিন আগে রাজশাহীতে ১৪ দলের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির অঙ্গ সংগঠন ছাত্রমৈত্রীর এক তরুণ ছাত্রলীগের হাতে নিহত হয়েছিলেন। এ নিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টি কিছু বিবৃতি দিলেও খুব সম্ভবত এখন তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যের খাতিরে নিজেদের কর্মীর নিহত হওয়ার ঘটনাটিকে হজম করে নিয়েছেন। যাই হোক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় আমরা সরকার দলের তিনটি অভিমত বা ভার্সন পেলাম। ১. ঘটনাটি স্বাভাবিক, এর জন্য বিশেষ কেউ দায়ী নয়। এমন ঘটনা হতেই পারে। ২. ছাত্রদলের ইন্ধনে এটা ঘটেছে এবং ৩. ছাত্রশিবির ছাত্রলীগের মধ্যে ঢুকে পড়ে এসব অপকর্ম করছে। এখন সরকারকেই বলতে হবে, তিনটির মধ্যে কোনটি সত্য।আসল সত্য সবারই জানা। সরকারি ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ নিজেই সব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, যা প্রায়ই সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে। আর তারই পরিণতিতে প্রাণ হারাচ্ছে কিছু তরুণ। আর অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণ কিন্তু মতাদর্শ বা রাজনৈতিক বিষয় নয়। স্রেফ টেন্ডারবাজি, ঠিকাদারির বখরা ও হলের সিট দখল (সেখানেও প্রতিপত্তি ও অর্থনৈতিক লাভের বিষয় জড়িত আছে)—এসবই হচ্ছে শিক্ষাঙ্গনে অরাজকতা ও সন্ত্রাসের মূল কারণ।
এসব ঘটনা দেখে প্রধানমন্ত্রী বেশ আগেই অনেক দুঃখ পেয়েছিলেন। মনের দুঃখে তিনি এক সময় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেতৃত্বের পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু তার দুঃখ, বেদনা, অভিমান কোনোটাই তার দলের ছাত্রকর্মীদের বিরত করতে পারেনি। ছাত্রলীগ তারই নিজের দল, তরুণ বয়সে তিনি নিজেও ওই সংগঠন করেছিলেন, ছাত্রলীগের প্রার্থী হয়ে ইডেন কলেজের ভিপিও হয়েছিলেন। কিন্তু সেন্টিমেন্ট দিয়ে দেশ পরিচালনা করা চলে না। তাকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে তারই প্রিয় ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে। যেমন করে রাজশাহীতে অভিযুক্ত ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে তত্পর হয়েছেন, তেমনটি কি হতে পারেন না ছাত্রলীগের বিরুদ্ধেও?
বহুবিধ কারণেই বর্তমান সরকারের জনপ্রিয়তা এরই
মধ্যে হ্রাস পেয়েছে। তবে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী
লীগের টেন্ডারবাজের দল সরকারকে ডোবাতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন। প্রধানমন্ত্রী, দয়া করে নিজ দল ও ছাত্র সংগঠনকে
সামলান। বিলম্ব হলে শুধু সরকারের নয়, গোটা দেশেরই সর্বনাশ হবে।

No comments

Powered by Blogger.