প্রতিপক্ষঃ আদালতের পরিধি by এবনে গোলাম সামাদ

আইন পড়িনি। আমার সামান্য গবেষণা কর্ম নিয়োজিত থেকেছে জীববিজ্ঞানের একটি ক্ষুদ্র শাখায়। কিন্তু সম্প্রতি আমার মনে কৌতূহল জেগেছে বিচার বিভাগের ক্ষমতার চৌহদ্দি নিয়ে। কোনো বিচারক কি দেশের ইতিহাস নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে আদালতের রায়ের মাধ্যমে নিয়মনীতি বেঁধে দিতে পারেন? ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করবেন ইতিহাসের গবেষকেরা।

নিশ্চয় দেশের বিচারকেরা নয়। বিচারকদের কাজ দেশে সংঘটিত দুর্নীতির বিচার, জমিজমার স্বত্ব নিয়ে বিচার, খুন-খারাবির বিচার, স্বামী-স্ত্রীর বনিবনা নিয়ে বিচার। কিন্তু কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে কোনো দেশের আদালত কি কোনো রায় দিতে পারে? রুদ্ধ করতে পারে ইতিহাস নিয়ে গবেষণার পথ! এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন ঘটনার বিভিন্ন ধরনের মূল্যায়ন করে থাকেন। তাদের মতামতের মধ্যে দেখা যায় পার্থক্য। কিন্তু বিভিন্ন মতপার্থক্যের মধ্যে মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে কিছু সাধারণ সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে, যাকে আমরা বলি ঐতিহাসিক সত্য। এক্ষেত্রে বিচার বিভাগের কোনো হস্তক্ষেপের প্রয়োজন আছে বলে মনে করা যায় না। এটা হলো জ্ঞানচর্চার, ইতিহাসচর্চার, স্বাধীনতার প্রশ্ন; সত্যকে খুঁজে দেখার স্বাধীনতার প্রশ্ন। এক্ষেত্রে আদালতের হস্তক্ষেপ কতটা বাঞ্ছিত সেটা নিয়ে ইতিহাসের ছাত্রদের মনে দেখা দিচ্ছে নানা প্রশ্ন। তারা বলছেন, আসলে আদালতের পরিধি কতটা। আমাদের আদালত কি সত্যকে খুঁজে বের করার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে চাচ্ছে? এরকম মনোভাবকে আর যাই বলা হোক, মুক্ত চিন্তার অনুকূল বলা যায় না। শেখ মুজিব আসলে কী চেয়েছিলেন, ইতিহাসের ছাত্রদের কাছে সেটা এখনও স্বচ্ছ নয়। কারণ, শেখ মুজিব আসলে ১৯৭০-এ নির্বাচন করে বিজয়ী হন বিপুল ভোটে। কিন্তু এই নির্বাচন হয়েছিল ‘ লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’ ১৯৭০-কে নির্ভর করে। যে হুকুমনামায় বলা হয়েছিল, পাকিস্তানের ভাবি সংবিধান রচিত হতে হবে ইসলামী মূল্যবোধকে নির্ভর করে। দেশের রাষ্ট্রপতি হতে হবে সব সময় মুসলমান। অমুসলমান দেশের রাষ্ট্রপতি হতে পারবে না। দেশের সংবিধান হতে হবে ফেডারেল সরকার গঠনের জন্য। পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশন বা রাষ্ট্র সমবায়। শেখ মুজিব এসব শর্ত মেনে নিয়ে করেছিলেন ১৯৭০-এর নির্বাচন। আর দেশের মানুষ তাকে দিয়েছিল ভোট। বিদেশি সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার বহুলপঠিত ‘বাংলাদেশ : এ লিগ্যাসি অব ব্লাড’ বইতে বলেছেন, শেখ মুজিব পাকিস্তানের জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ৮ জানুয়ারি ১৯৭২-এ যান বিলাতে। লন্ডনে তিনি মাসকারেনহাসকে বলেন, তিনি পাকিস্তান ভেঙে দেয়ার পক্ষে নয়। তিনি চাচ্ছেন, একটা আলাদা ধরনের ফেডারেশন গড়তে (২য় অধ্যায় দ্রষ্টব্য)। এর আগে ১৯৭১ সালে নিউইয়র্কে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ নভেম্বর প্রদত্ত একটি বক্তৃতাতে শ্রীমতি গান্ধী বলেন, বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিটি উঠেছে শেখ মুজিব গ্রেফতার হওয়ার পর, তার আগে নয়। ইন্দিরা গান্ধী বলেন, তিনি যতদূর জানেন, শেখ মুজিব এখনও স্বাধীনতার দাবি করছেন না। তাই আপসরফার পথ এখনও রুদ্ধ হয়ে যায়নি (ওহফরধ ংঢ়বধশং, ঢ়ঢ়.৯৩-৯৬, গরহরংঃত্ু ড়ভ ওহভড়ত্সধঃরড়হ ধহফ ইত্ড়ধফপধংঃরহম, এড়াবত্হসবহঃ ড়ভ ওহফরধ, উবপবসনবত্-১৯৭১)। শেখ মুজিব ঠিক কী চেয়েছিলেন তা অনেক কারণেই হয়ে আছে অস্পষ্ট। শেখ মুজিব দেশে ফিরে পাকিস্তানে যান ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (ঙওঈ) ডাকা সভায় যোগ দিতে। গ্রহণ করেন ঙওঈ’র সদস্যপদ। সমর্থন করেন, মুসলিম উম্মাহর ধারণাকে। দেশে ফিরে তিনি করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা। শেখ মুজিবের জাতীয়তাবাদের ধারণার মধ্যে ইসলাম ছিল সম্পৃক্ত। সেটার কথা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এখন যাওয়া হচ্ছে এড়িয়ে।
এবার আসা যেতে পারে, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রসঙ্গে। রাষ্ট্রপতি জিয়া কখনোই দাবি করেননি তিনি হলেন স্বাধীনতার প্রথম ঘোষক। এটা দাবি করা হয়েছে, তার সমর্থকদের পক্ষ থেকে। জিয়া ক্ষমতায় এসে যান নয়াদিল্লি, ১৯৭৭ সাল নাগাদ। এ সময় ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন নিলম সঞ্জীব রেড্ডি। তিনি দিল্লি বিমানবন্দরে রাষ্ট্রপতি জিয়াকে স্বাগত জানান। তিনি তার এই স্বাগত ভাষণে জিয়াকে উল্লেখ করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম ঘোষক হিসেবে। এরপর থেকেই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে এদেশেও বলা হতে থাকে স্বাধীণতার প্রথম ঘোষক। কিন্তু রাষ্ট্রপতি জিয়া নিজে কখনোই এ দাবি করেননি। বাংলাদেশ এখন একটা পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র। কে প্রথম ম্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে চলতে পারে বিতর্ক। কিন্তু এখন বিশেষভাবে যা প্রয়োজন তা হলো এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আত্মনিয়োজন। স্বাধীনতা যিনিই ঘোষণা করে থাকুন না কেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আজ এসে পড়েছে বিপদসীমার সন্নিকটে। যেটা উপলব্ধি করে আমাদের দেশের রাজনীতিকদের করতে হবে রাজনৈতিক নীতিনির্ধারণ। ব্যক্তিগতভাবে আমি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না, কিন্তু এ দেশের রাজনীতির ঘটনা প্রবাহ আমাকেও করেছে মাঝে মাঝে আলোড়িত।
বর্তমানে চলছে ফেব্রুয়ারি মাস। এই মাসকে ধরা হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মাস। ১৯৫২ সালে আমি ছিলাম ছাত্র। এই আন্দোলনকে দেখেছি অনেক কাছে থেকে। এই আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের কারও কারও নাম আমি শুনেছিলাম। এদের মধ্যে একটি নাম হলো অলি আহাদ। যার নাম এখন আর বিশেষ শোনা যায় না। আমি এ সময় শেখ মুজিবের নাম শুনতে পাইনি। তবে এখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, ভাষা আন্দোলন হয়েছিল শেখ মুজিবের নেতৃত্বে। যেটা কোনো ঐতিহাসিক সত্য নয়। কিন্তু তথাপি বিনা যুক্তিতে ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে শেখ মুজিবকে করে তুলতে চাচ্ছেন একজন নেতা। জানি না এই দাবিও একদিন আদালতে গড়াবে কি-না। আর আদালত কি রায় দেবে এর পক্ষে? ভাষা আন্দোলন করেছিল ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামের একটি ইসলামী সংগঠন। আর আন্দোলন করেছিল তখনকার বামপন্থী ছাত্ররা। শেখ মুজিব এদের কারও সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। এ কথা আমি বলতে পারি ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আমার নিজের জ্ঞান থেকেই। বাংলাদেশের সুুপ্রিমকোর্টের এক সময়ের প্রধান বিচারাপতি হাবিবুর রহমান (সেলী) অংশ নিয়েছিলেন ভাষা আন্দোলনে, গিয়েছিলেন জেলে। তাকে আমি কিছুটা চিনতাম। কিন্তু তার মুখে ১৯৫২ সালে আমি শেখ মুজিবের নাম উচ্চারিত হতে শুনিনি। কিছু কিছু ভাষাসৈনিক এখনও বেঁচে আছেন। তারা বলছেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব অংশগ্রহণ করেননি। সে যাই হোক, ইতিহাসে অনেক রং চলে। মিথ্যা ইতিহাসও লিখা হয়েছে অনেক। এসব থেকে চেষ্টা করেন ইতিহাস নিয়ে গবেষকরা প্রকৃত সত্যকে খুঁজে পেতে। এটাতেই তাদের আনন্দ। নেপোলিয়ন এক সময় বলেছিলেন, ইতিহাস ঐতিহাসিকদের আবিষ্কার মাত্র। তার এই কথা অনেক পরিমাণে সত্য হলেও নিশ্চয় সর্বতোভাবে নয়। শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলনে যোগ না দেয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। তার মধ্যে একটি কারণ ছিল, আওয়ামী লীগ স্থির করতে পারছিল না, রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে তার নীতি। শেখ মুজিবের রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মাতৃভাষা ছিল উর্দু। প্রথম দিকে তার সমর্থন ছিল উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার। শেখ মুজিব চাননি তার রাজনৈতিক গুরুর অবাধ্য হতে। এটা ইতিহাস।

No comments

Powered by Blogger.