বৈরী প্রকৃতি মোকাবেলা-সাহসী মানুষের জয়গাথা by রেজা শাওন

১৯৫৩ সালের বন্যার দুঃসহ স্মৃতি ডাচরা এখনও ভুলতে পারেনি। তারা সমুদ্রের বুকে পৃথিবীর সেরা সব বাঁধ বানিয়েছে, তারপরও তাদের ধারণা তাদের সাহস কম। সাহস বেশি বাংলাদেশিদের। ১৯৭০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে বন্যায় যত মানুষ মারা গেছে, সারা পৃথিবীতে বন্যায় এত মানুষ আর কোথাও মারা যায়নি।


তারপরও এই দেশের মানুষরা বন্যা নিয়ে খুব একটা দুঃখিত না। প্রতিবছর নিয়ম করে বন্যা আসে, সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বাংলাদেশ কিন্তু
থেমে থাকে না


মিডিয়া এক্সপেল্গারেশন নামে আমাদের একটা বিষয় পড়ানো হয়। পড়তে খুবই বিরক্তিকর এবং ঘুমবান্ধব। বড় একটা গ্যালারিতে তিন সেকশনের একসঙ্গে ক্লাস হয়। শীতের দিন সকালবেলা এই ক্লাসে গিয়ে ঘুমানোর আনন্দ সীমাহীন। গত বল্গক ঘুম দিয়ে বেশ ভালোভাবেই পার করেছি। সমস্যা হয়েছে এই বল্গকে এসে। 'ডরিক গ্রিট' নামের এক ভদ্রলোক এই বিষয় পড়ান। চমৎকার একজন মানুষ। একদিন কী মনে করে এই লোক আমাকে ক্লাসে দাঁড় করিয়ে বলেন, 'তোমার দেশের খবরের ধরনের সঙ্গে এই দেশের (হল্যান্ড) খবরের ধরনের পার্থক্য বলো।' ঘুমের ভেতরে ছিলাম। হঠাৎ করে মাথা শূন্য মনে হলো। কিন্তু শূন্য মাথায় মনে হয় মাঝে মধ্যে দামি উত্তর বের হয়ে আসে। আমি উত্তর দিলাম, 'আমার দেশের অধিকাংশ খবরই চাঞ্চল্যকর। আর এই দেশের অধিকাংশ খবর খুবই বিরক্তিকর।' ক্লাসজুড়ে হো হো, হা হা রব উঠল। পরে সবাই ঠাণ্ডা হলে ব্যাপারটা আমাকে ব্যাখ্যা করতে হয়েছে। ডাচদের আবার ইগো একটু বেশি। আমার দেশের তুলনায় তাদের দেশের খবর কেন বিরক্তিকর, সেই ব্যাপারটা তাদের বুঝানোর জন্য একদিন বাংলাদেশের প্রধান তিনটি খবর তাদের পড়ে শোনালাম।
খবর ১_ 'শেয়ারবাজারে অব্যাহত দরপতনের প্রতিবাদে বিনিয়োগকারীরা আমরণ অনশন শুরু করেছেন এবং দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এতে তাদের সঙ্গতি প্রকাশ করেছে।'
খবর ২_ 'বেসরকারি খাতে পরিচালিত দেশের সবচেয়ে বড় টেলিযোগাযোগ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, তারা সরকারি টেলিযোগাযোগ কমিশনের দাবি করা অর্থ পরিশোধ করবে না।'
খবর ৩_ 'দেশের ক্ষমতাসীন দলের এক সাংসদ তার এলাকার একটি স্কুলে তালা দিয়ে রেখেছেন। বাচ্চারা ৩৮ দিন ধরে স্কুলে যেতে পারছে না (ছবিসহ প্রতিবেদন)।'
নানাবিধ আলোচনার পর তারা সবাই মাথা নাড়িয়ে একমত হয় যে, প্রথম খবরটা বেশি চাঞ্চল্যকর। অনেকগুলো মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা মরে যাবে। চোখ বড় বড় করে অনেকেই বিভিন্ন ইমো দিতে লাগল। আহারে! এরপর সপ্তাহখানেক গেছে। লাইব্রেরি করিডোরে ডরিকের সঙ্গে দেখা। কফি হাতে কোথায় যেন যাচ্ছে। দৌড়ের ওপর আছে, বোঝা যায়। আমি পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছি। ডরিক পেছন থেকে ডাক দিল।
_ হাই! রেজা কেমন আছো?
_ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
_ এই তো ভালো আছি। আচ্ছা তোমার দেশের ওই মানুষগুলোর কী খবর? যারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তারা মরে যাবে। আমি কয়দিন ধরে খুব ব্যস্ত। খবরটা ঠিকমতো ফলো করতে পারিনি।
আমি একটু অবাক হলাম। তৃতীয় বিশ্বের গরিব একটা দেশের কিছু মানুষ মরে যাওয়ার খবর, এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। ডাচরা বরাবরই 'বিজনেস পিপল' ধরনের। নিজের দরকার না থাকলে, সচরাচর যেচে কারও খবর তারা নেয় না। ডরিক আমাকে কফি অফার করল। কফি খেতে খেতে সেদিন ডরিকের সঙ্গে আমার কিছু চাঞ্চল্যকর বিষয়ে আলোচনা হলো।
ডরিকের নয় বছর বয়সী ছেলে স্তিভান একজন বাংলাদেশি হতে চায়। আমি ডরিকের কথা শুনে চোখ কপালে তুললাম এবং অনেকক্ষণ সে চোখ কপালেই থাকল। ডরিক পুরো ব্যাপার ব্যাখ্যা করল। স্তিভানের পছন্দের টিভি প্রোগ্রাম হলো 'ইধহমষধ ইধহমবৎং.'
যেখানে লিপু নামের এক বাংলাদেশি, বার্নি নামের এক ব্রিটিশ মেকানিককে নিয়ে বিস্ময়কর সব সুপার কার বানায়। মজার ব্যাপার হলো, লিপু কোনো ইঞ্জিনিয়ার নয়। লিপুর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই এবং সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর বিষয় হচ্ছে, লিপু গাড়ির পুরো ডিজাইনটা রাখে তার মাথায়। তার কোনো ড্রয়িং লাগে না। মোটামুটি আবর্জনা ধরনের গাড়িকে সুপার কার বানাতে লিপুর লাগে চার সপ্তাহ। লিপুর কথা আমিও জানতাম। বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেল লিপুকে নিয়ে একবার একটা প্রতিবেদন করেছিল। এরপর লিপুকে দেখেছি ডিসকভারি চ্যানেলে। লিপুর সম্পর্কে আমার জ্ঞান ওই পর্যন্তই। ডরিক আমাকে জানাল, অধিকাংশ ইউরোপিয়ান টিনএজার লিপুর নাম জানে। লিপুর নাম শুনলে ক্লাসে আড্ডা জমে যায়। তারা চোখ বড় বড় করে লিপু নামের এক বাংলাদেশি কীভাবে একের পর এক সুপার কার বানিয়ে ফেলে সেসব গল্প করে। লিপু গাড়ি বানানো শেষ হলে, দুই হাত তুলে ঢেউ তোলার মতো একটা ভঙ্গি করেন। লিপু হয়তো জানেন না, বঙ্গোপসাগর থেকে তার তোলা ঢেউ বাংলাদেশ ছাড়িয়ে আছড়ে পড়েছে ইউরোপে। এখানকার বাচ্চারা লিপুকে ডাকে, 'ক্রেইজি ডুউড' বলে।
দূরে থাকার একটা অসুবিধা আছে। সাত হাজার মাইল দূরে ফেলে আসা গরিব এই দেশটির কথা শুনলেই অনেক সময় চোখে পানি চলে আসে। এর জন্য খুব একটা দেশপ্রেমিক হতে হয় না। এটা একান্তই মানবীয় একটা অনুভূতি। হঠাৎ করে আবেগতাড়িত হলাম বোধহয়। খেয়াল করলাম, চোখ ভিজে আসছে। ডরিক বোধহয় ব্যাপারটা খেয়াল করল। ডরিক আরও কিছু তথ্য আমাকে দিল। অধিকাংশ ডাচ লোকজনের ধারণা, বাংলাদেশের লোকজন বাড়াবাড়ি রকমের সাহসী। বন্যা-খরা তাদের কাছে কোনো ব্যাপার নয় এবং আমাদের এই সাহসী মানসিকতা দেখে তারা প্রতি মুহূর্তে অবাক হয়। একটা ব্যাপার বলে রাখা ভালো, নেদারল্যান্ডস এবং বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে একই ঘরানার দেশ। ১৯৫৩ সালের এক বন্যায় এই দেশের সব বাঁধ ভেঙে যায়। উত্তর সাগরের আকস্মিক ঢেউ এক হাজার ৮০০ মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এই দুঃসহ স্মৃতি ডাচরা এখনও ভুলতে পারেনি। তারা সমুদ্রের বুকে পৃথিবীর সেরা সব বাঁধ বানিয়েছে, তারপরও তাদের ধারণা তাদের সাহস কম। সাহস বেশি বাংলাদেশিদের। ১৯৭০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে বন্যায় যত মানুষ মারা গেছে, সারা পৃথিবীতে বন্যায় এত মানুষ আর কোথাও মারা যায়নি। তারপরও এই দেশের মানুষরা বন্যা নিয়ে খুব একটা দুঃখিত নয়। প্রতিবছর নিয়ম করে বন্যা আসে, সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বাংলাদেশ কিন্তু থেমে
থাকে না।
ডরিক আমাকে জানাল, বর্ষায় বাংলাদেশের একটা ছবি দেখেছিল সে। আকাশের অনেক ওপর থেকে তোলা একটা ছবি। ওপর থেকে দেখে মনে হচ্ছে, পুরো দেশটা সমুদ্র হয়ে গেছে। শুধু বিন্দুর মতো ছোট ছোট কিছু সবুজ জেগে আছে। আমি বললাম, ওই সবুজটুকু থাকলেই হবে। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য ওইটুকু
সবুজই যথেষ্ট।

রেজা শাওন : শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সাংবাদিকতা ইউনিভার্সিটি অব ইউটরেক্ট, নেদারল্যান্ডস

No comments

Powered by Blogger.