দেখার ভেতরে বাইরেঃ কেমন আছেন মতিন ভাই? by মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান

কেমন আছেন মতিন ভাই? হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি, পাগলা মতিন, ভাষা মতিন আবদুল মতিন, আপনাকে। না, আমি এমন কেউ নই, যার নাম শুনলে বা দেখা হলেই চিনে ফেলবেন। স্মৃতি হাতড়ালে মনে পড়বে, তেমন কেউও আমি নই। তবে আমার জন্য স্মরণীয়, আপনার জন্য হওয়ার কোনো কারণ নেই।
ছোটবেলায় আর একজনকে দেখেছিলাম। বলা যায়, দেখতেই থাকতাম। প্রতিবেশী আত্মীয় আবদুল হক। হ্যাঁ, কমরেড আবদুল হকের কথা বলছি। লোকমুখে তার সংগ্রামী জীবনের নানা কথা শুনতে শুনতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমার মানসে কিংবদন্তির নায়ক। সেই স্কুলপড়ুয়া জীবনে সেসব শোনা কথার কতটা খাঁটি, কতটা রং লাগানো তা আমি জানতাম না। আজও জানি না। কলেজ জীবনে পা দিয়েই সমাজতন্ত্র, বাম রাজনীতি ইত্যাদি শব্দে রোমাঞ্চিত হয়েছি। নিজ থেকেই নিজেকে সেই দলভুক্ত করে ফেলেছি। কাউকে ডাকতে হয়নি, কাউকে সমাজতন্ত্রের বীজ বুনে দিতে হয়নি বুকে। মার্কস-অ্যাঙ্গেলস, লেনিন, স্ট্যালিন, মাওয়ের যত বই পেয়েছি, গিলেছি গোগ্রাসে। বীজ আপনাআপনিই বপিত হয়ে গেছে বুকে। কিন্তু আমার মনভূমি সম্ভবত তেমন উর্বর ছিল না, তাই অঙ্কুরোদ্গম ঘটলেও শাখা-প্রশাখায় মহীরুহ হতে পারেনি সে অঙ্কুর। তারপরও কেন জানি না, এখনও মনে হয় অঙ্কুরটা জীবিত আছে। বাম রাজনীতিতে কত বিভাজন এসেছে, তা আপনি আমার চেয়ে ভালো জানেন। এসবের কোনটা ভুল, কোনটা ঠিক তা আমি নির্ণয় করতে পারিনি কখনও। এমনকি একাত্তরে হক ভাইয়ের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল একথা বার বার মনে হলেও কোথায় যেন একটু দ্বিধাও ছিল। এর আগে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর উভয় দেশেই আওয়াজ উঠতে শুনেছি—‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়—লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়।’ আর পাকিস্তানে তো আমরা নিজেরাই দেখেছি, শুধু পূর্ববাংলায় নয়, সিন্ধুে, বেলুচিস্তানে, সীমান্ত প্রদেশে বঞ্চিত-লাঞ্ছিত-ভূমিহীন সর্বহারার হাহাকার বেড়েছে দিনে দিনে। শাসক-শোষকদের করতলে চলে গেছে মানুষের রক্ত-ঘামে উত্পাদিত-অর্জিত সব সম্পদ। জনগণ শ্রেণী শোষণের স্বরূপ ঠিকমত চেনা এবং তা প্রতিহত করার শক্তি অর্জনের আগেই এ দেশ স্বাধীন হলে—স্বাধীনতার ফল জনগণের কাছে পৌঁছানো তো দূরের কথা, ফলদ গাছটিই চলে যাবে শাসক-শোষকদের একান্ত প্রাচীর ঘেরা আঙ্গিনায়, এমন ভাবনা থেকেই হয়তো হক ভাইসহ বামপন্থীদের কোনো কোনো গ্রুপ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু জনগণকে নিয়েই তো রাজনীতি। জনস্রোতের বিপরীতে গিয়ে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন—দুর্বল হয়ে গেছেন। বামপন্থীদের বিশাল অংশই অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন এবং সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণও করেছেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে, এই আত্মতুষ্টির বাইরে তারা কী তাদের সাম্যবাদী আদর্শের প্রতিষ্ঠায় বিন্দুমাত্র পথও অতিক্রম করতে পেরেছেন? আজ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধশক্তির উত্খাত নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। খুবই ভালো কথা। কিন্তু স্বাধীনতার পর পর দু’বছরের অধিককাল ধরে রক্ষীবাহিনীর হাতে সম্পূর্ণ বিনাবিচারে যারা নিহত হয়েছিলেন তাদের প্রায় শতভাগই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তাদের একটাই অপরাধ ছিল, তারা বামপন্থী। তাদের কেউই রাজাকার, আলবদর ছিল না।
মতিন ভাই, এসব কথা আপনাকে শোনানো আমার উদ্দেশ্য নয়। এ প্রসঙ্গে আপনার মতো অভিজ্ঞজনের কাছে একটিই প্রশ্ন, তাহলো—বাংলাদেশের ইতিহাস রচনায় এগুলো কী উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে স্থান পাবে? বহু কিছুই তো নতুন করে প্রতিস্থাপিত হচ্ছে, যা আমরা নিজে শুনে বা দেখে বিশ্বাস করেছি তা মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে তৈরি করা মিথ্-এর নিচে চাপা পড়ে। হতভম্ব হয়ে বলতে হচ্ছে, ‘তাই সত্য যা রচিবে তুমি’। আর চারদিন পর একুশে ফেব্রুয়ারি। তারিখটির আগে ‘ঐতিহাসিক’ শব্দটি লিখতে গিয়েও লিখতে পারলাম না। কারণ ইতিহাস যথাপূর্ব থাকবে—না প্রতিনির্মিত হবে তা বলা কঠিন। এই দ্বিধার জন্ম এরই মধ্যেই হয়ে গেছে বলে প্রথমেই প্রশ্ন করেছিলাম—কেমন আছেন! একুশে ফেব্রুয়ারি, ভাষা আন্দোলন, এ নিয়ে বহু বারই আপনি বলেছেন। আপনি বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সঙ্গে। তাই আপনার কথাকে আমি প্রামাণ্য হিসেবে, দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছি। আপনার লেখা, ‘বাঙালি জাতির উত্স সন্ধান ও ভাষা আন্দোলন’ বইটি আমি পুনঃপুন পড়েছি। পড়েছি বদরুদ্দীন উমর সাহেবের ‘পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলন ও তত্কালীন রাজনীতি’ বইটির তিনটি খণ্ডই মনোযোগ দিয়ে। কোথাও, ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ’ বা ‘বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’তে বঙ্গবন্ধুর নাম পর্যন্ত নেই। মতিন ভাই, আপনি তো ১৯৫২’র জানুয়ারি থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট প্রত্যাহার পর্যন্ত দিনপঞ্জী আকারে প্রতিদিনের ঘটনাবলীর উল্লেখও করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠিত সত্য কী বদলে যাবে! বহু কিছুরই তো বদল ঘটছে। কোথায়—কী পরিস্থিতিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠের অমত সত্ত্বেও ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তা সেদিনের নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি ও প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রায় সবার বক্তব্যেই এ যাবত্ একই তথ্য পাওয়া গেছে। এখন আবার কেউ ডিগবাজি দেবেন না তো? আপনার মনে কী এমন সংশয় উদিত হয়? গত ৪ ফেব্রুয়ারি ‘আমার দেশ’ পত্রিকায় জনাব বদরুদ্দীন উমর অবশ্য তার ‘একুশে ফেব্রুয়ারিতে শেখ মুজিবুর রহমান’ নিবন্ধটি শেষ করেছেন, “সত্যের ‘বদঅভ্যাস’ই হচ্ছে মিথ্যাকে পরাস্ত করা” এই বাক্যটি দিয়ে। আপনিও কী আজ তেমনটাই বিশ্বাস করেন? মতিন ভাই, সবশেষে প্রার্থনা করি, অন্তত সত্য বলার জন্য হলেও আপনি দীর্ঘদিন জীবিত থাকুন, সুস্থ দেহ-মনে। জীবিত থাকুন মিথ্যাকে পরাজিত করার জন্য।
লেখক : কবি, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.