প্রতিক্রিয়া-প্রসঙ্গ টিআইবির দুর্নীতি প্রতিবেদন

সাম্প্রতিক প্রকাশিত টিআইবির খানা জরিপ নিয়ে পত্রপত্রিকায়, টিভিতে এবং নানা মহলে নানা রকম আলোচনা হচ্ছে। আমরা এই আলোচনাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি এবং প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক এনজিও হিসেবে খানা জরিপে এনজিও-সম্পর্কিত অংশের ওপর আলোকপাত করতে চাই।


দারিদ্র্যের কারণে সমাজের ম্লান-মূঢ়-মূক মুখে ভাষা দিতে, কণ্ঠে ধ্বনি ও শক্তি জোগাতে এবং দারিদ্র্য নিরসনে আমরা কাজ করি। বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের একটি মূল চ্যালেঞ্জ হলো দুর্নীতি; এবং দুর্নীতি দমনের একটি অন্তরায় হলো দুর্নীতির ব্যাপকতা বুঝতে না পারা। সেদিক থেকে টিআইবির খানা জরিপ অনেক উপযোগী তথ্য দিয়েছে। টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী ১০ শতাংশ খানা এনজিও কার্যক্রমে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছে। এই শতকরা হার ২০০৭ সালের জরিপে ছিল ১৩ দশমিক ৫ ভাগ। এনজিওতে দুর্নীতির শতকরা হার সেবা খাতের মধ্যে সবচেয়ে কম হলেও এবং ২০০৭ সালের তুলনায় কমে এলেও এতে সন্তুষ্ট হওয়ার কিছু নেই। খানা জরিপে এনজিও কার্যক্রমের মূলত যে দুটি বিষয়ে দুর্নীতির প্রশ্ন উঠেছে তা হলো ক্ষুদ্রঋণ ও ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম। এনজিও সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে ৭ দশমিক ২ শতাংশ গ্রহীতা ঋণ গ্রহণের জন্য ঘুষ প্রদানে বাধ্য হয়েছেন এবং ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ গ্রহীতা ঋণের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় সেবা গ্রহণে বাধ্য হওয়াসহ আরও কিছু বিষয়ে বলেছেন। টিআইবি প্রাক্কলন করে দেখিয়েছে যে মাঠপর্যায়ে ক্ষুদ্র ঋণদানকারী কর্মচারীরা প্রায় ৪২ কোটি টাকার দুর্নীতি ও অনিয়ম করেছে; কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষুদ্রঋণ খাতে। এই পরিমাণ যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, ক্ষুদ্রঋণ সেবায় নিবেদিত হাজারো মাঠকর্মীর সৎ প্রচেষ্টা ও হাড়ভাঙা খাটুনিকে তা ম্লান করে দেয়। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ গঠন করেছে এবং কর্তৃপক্ষ ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থাকে নিবন্ধন দিচ্ছে, সুদের হার বেঁধে দিয়েছে, তা সত্ত্বেও অবশ্যপালনীয় আচরণ বা করণীয় এবং বর্জনীয় সম্পর্কে মানদণ্ড বেঁধে দেওয়া, তা প্রতিপালন এবং পরিবীক্ষণ করার ক্ষেত্রে এখনো দুর্বলতা রয়ে গেছে। তবে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের ভূমিকাই এখানে মুখ্য হতে পারে না। এনজিওর নিজস্ব দায়িত্ব, সামাজিক লক্ষ্য ও দায়বদ্ধতা এখানে মুখ্য হওয়া উচিত।
ক্ষুদ্রঋণ ছাড়াও ত্রাণবিষয়ক কার্যক্রমের অনিয়মের চিত্রও এতে তুলে ধরা হয়েছে। এনজিও থেকে যাঁরা ত্রাণ নিয়েছেন তাঁদের উল্লেখযোগ্য অংশ ত্রাণ গ্রহণে নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের শিকার হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে অর্থ দিয়ে ত্রাণ গ্রহণ, ঘুষ, স্বজনপ্রীতি এবং কম পরিমাণে ত্রাণ পাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।
এসব অভিযোগকে অস্বীকার না করে আমরা একে সতর্কসংকেত হিসেবে বিবেচনা করছি। আমরা সরকারের কাছে, জনগণের কাছে এবং আমাদের দাতাদের কাছে জবাবদিহি করি। আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনার ভিত্তি এতটাই মজবুত যে প্রতিটি টাকার যথাযথ ব্যয় যাচাই করা সম্ভব। সরকার ও দাতারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমাদের প্রকল্প অনুমোদন করে। আমাদের ব্যয় প্রতিবছর সরকার অনুমোদিত অডিটর দ্বারা অডিট করা হয় এবং বাৎসরিক প্রতিবেদন ও অডিট সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়। অডিট গৃহীত হলেই কেবল পরবর্তী বছরের জন্য সরকার অর্থ ছাড়ের অনুমতি দেয়। আমাদের বাৎসরিক প্রতিবেদন ও অডিট যে কেউ চাইলে দেখতে পারেন।
টিআইবির খানা জরিপে আমরা পক্ষ কি বিপক্ষ, এর নমুনায়ন বিশুদ্ধ না স্বল্প শুদ্ধ; জরিপে যাঁরা অংশ নিয়েছে তাঁরা কারা বা কোন এলাকার—ইত্যাদি বিতর্কে বা খোঁজে না জড়িয়ে আমরা মনে করি যে খানা জরিপের প্রতিবেদন আমাদের নিজেদের সংস্থার ভেতরে, আমাদের পার্টনারদের আরও অনুসন্ধানী এবং আত্মসমালোচনা করার সুযোগ এনে দিয়েছে। আমরা মনে করি, আমাদের নিজস্ব সংস্থার ভেতর এবং আমাদের পার্টনার সংস্থাগুলোকে দুর্নীতি নিরসনে আরও সক্রিয় হতে হবে। জনগণের কাছে আমাদের অনুরোধ, আমাদের সংস্থাগুলোর কার্যক্রমে কোনো প্রকার দুর্নীতির খবর পেলে অনুগ্রহ করে আমাদের জানাবেন। আমাদের পার্টনার এনজিওগুলোকেও একই কাজ করার অনুরোধ জানাই। দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার জন্য সরকারি প্রচেষ্টা ও নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে নিজ নিজ সংস্থাকে এবং সংস্থার সব তহবিলপ্রবাহ ও কর্মকাণ্ডকে দুর্নীতিমুক্ত রাখার ব্যাপারে আমাদের অঙ্গীকার রইল।
লেখক: ফারাহ কবীর, গ্যারেথ প্রাইস জোন্স, এ কে এম মুসা, পলাশ দাস, খায়রুল ইসলাম, নিকোল মোমেন্টে, জাভেদ আমির, হাসিনা ইমাম, হেলেনা জিলার্ড, নৃপেণ বৈদ্য ও আনোয়ার হোসেন শিকদার।
লেখকেরা যথাক্রমে অ্যাকশন এইড, অক্সফাম, কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড, ক্রিশ্চিয়ান এইড, ওয়াটার এইডের, এইডা, ইসলামিক রিলিফ, ড্যানচার্চ এইড, সলিডারিটিস ইন্টারন্যাশনাল, ওয়েসিস ইন্টারন্যাশনাল ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ অফিসের প্রধান।

No comments

Powered by Blogger.