ছাত্র ইউনিয়ন-শিক্ষাঙ্গন ও সমাজের বাতিঘর by মাহফুজা খানম

ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী অবশ্যই চলনে-বলনে, চিন্তা-চেতনায়, পোশাকে অন্য যে কোনো ছাত্র সংগঠনের কর্মী থেকে আলাদা_ তা সহজেই অনুমেয়। একজন ছাত্র বা ছাত্রী ছাত্র ইউনিয়নের নীল পতাকাতলে সমবেত হলে তার চিন্তার জগতে পরিবর্তন ঘটবেই, এ ধ্রুব সত্য।
ছাত্র ইউনিয়ন একজন ছাত্রকে জীবনকে ভালোবাসতে শেখায়, শেখায় দেশপ্রেমিক হতে, অসাম্প্রদায়িক হতে, বিশ্বমানবতায় বিশ্বাসী হতে, সত্যনিষ্ঠ ও সংগ্রামী হতে, ত্যাগী হতে



ছাত্র ইউনিয়নের হীরকজয়ন্তী এক আনন্দের মুহূর্ত। একটি অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, বিজ্ঞানমনস্ক ছাত্র সংগঠন ঐক্য, শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি স্লোগান নিয়ে পথ চলছে ষাট বছর, সময়ের আবর্তেও তার অন্তর্নিহিত আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়েও; এ কম কথা নয়।
বাংলাদেশে আজ ছাত্র সংগঠন মানেই চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, মাস্তানি, আদর্শবিবর্জিত পথচলা, সেখানে ছাত্র ইউনিয়ন তার আদর্শকে ঊধর্ে্ব তুলে আজও নানা প্রতিকূলতার পরও পথ চলছে, তারুণ্যকে পথ দেখাচ্ছে, এ তো ছাত্র ইউনিয়নের গৌরবের কথা।
১৯৫৯ সাল। আমি ঢাকার বাংলাবাজার গার্লস হাইস্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। স্কুলের পাশেই ছিল খ্রিস্টান মিশনারি ছাত্রদের হোস্টেল। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন কর্তৃক প্রচারিত একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে কিছু লিফলেট দিয়ে গেল ওই হোস্টেলের কিছু ছাত্র। সেই প্রথম 'ছাত্র ইউনিয়ন' নামের সঙ্গে পরিচিত হলাম। এরপর থেকে গত ৫৩ বছর কমবেশি নানাভাবে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তখন থেকে আজ পর্যন্ত একটি ছাত্র সংগঠন হিসেবে এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আজও অটুট ও অক্ষুণ্ন রয়েছে, এখানেই ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষত্ব, অনন্যতা ও কৃতিত্ব। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী অবশ্যই চলনে-বলনে, চিন্তা-চেতনায়, পোশাকে অন্য যে কোনো ছাত্র সংগঠনের কর্মী থেকে আলাদা_ তা সহজেই অনুমেয়। একজন ছাত্র বা ছাত্রী ছাত্র ইউনিয়নের নীল পতাকাতলে সমবেত হলে তার চিন্তার জগতে পরিবর্তন ঘটবেই, এ ধ্রুব সত্য। ছাত্র ইউনিয়ন একজন ছাত্রকে জীবনকে ভালোবাসতে শেখায়, শেখায় দেশপ্রেমিক হতে, অসাম্প্রদায়িক হতে, বিশ্বমানবতায় বিশ্বাসী হতে, সত্যনিষ্ঠ ও সংগ্রামী হতে, ত্যাগী হতে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা ছাত্র ইউনিয়ন করেছে। এদেশের সব ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়ন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। রবীন্দ্রচর্চা আন্দোলন, পহেলা বৈশাখ উদযাপনের আন্দোলন এক কথায় এদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়নের উল্লেখযোগ্য অবদান অনস্বীকার্য। ছাত্র ইউনিয়ন তার নিজস্ব ব্যানারে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল ও স্বাধীনতা আন্দোলনে ইতিবাচক অবদান রেখেছিল। এদেশে বিশ্ব প্রগতির সুবাতাস বইয়েছে যে সংগঠন তার নাম_ ছাত্র ইউনিয়ন। ষাটের ও সত্তরের দশক ছিল ছাত্র ইউনিয়নের স্বর্ণযুগ। প্রতি হলেই ছিল ছাত্র ইউনিয়নের কেবিনেট। 'ডাকসু'তেও ছিল ছাত্র ইউনিয়ন।
এবার ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততার কথা বলি। বাংলাবাজার স্কুল ছেড়ে ঢাকায় ইডেন গার্লস কলেজে ঢুকলাম ১৯৬১ সালে। দেশে (পূর্ব পাকিস্তান) আইয়ুব-মোনায়েমবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে। সভা-মিছিলে কলেজ থেকে যাওয়া শুরু করলাম মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে। তখন সভা হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় (যা এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অংশ)। বক্তৃতা করতেন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা বদরুল হক, সাইফুদ্দিন মানিক, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, নুরুল ইসলাম, রাশেদ খান মেনন, কাজী জাফর আহমেদ, মোস্তফা জামাল হায়দার প্রমুখ। ছাত্রী সংসদ নির্বাচন করলাম ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেল থেকে, পুরো প্যানেল আমরা পেলাম ছাত্রলীগকে হারিয়ে।
১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম সম্মান শ্রেণীতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ছাত্র ইউনিয়নের একজন কর্মী হিসেবে আরও সক্রিয় হলাম। রোকেয়া হলে তখন জলি আপা, চপলা আপা, ফাহমিদা আপা (রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী) ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃস্থানীয় কর্মী ছিলেন। প্রথম বছর রোকেয়া হল সংসদে সংসদ সদস্যা, দ্বিতীয় বছর সহকারী ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হই। চতুর্থ বছর অর্থাৎ ১৯৬৬-৬৭ শিক্ষাবর্ষে 'ডাকসু' সহ-সভানেত্রী নির্বাচিত হই।
১৯৬৩ থেকে ১৯৬৬ সালে একজন সক্রিয় ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী হিসেবে যে দক্ষতা অর্জন করেছিলাম তা অবশ্যই পরবর্তী সময়ে ডাকসুর সহ-সভানেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনে আমাকে সাহায্য করেছে। এ সময়টি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রস্তুতির পূর্বকাল। জাতীয় রাজনীতিতে ছয় দফার আন্দোলন এবং ছয় দফার আন্দোলনে ছাত্র সমাজ এক বিরাট ভূমিকা রাখে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজের মুখপাত্র হিসেবে, ডাকসুর সহ-সভানেত্রী হিসেবে আমার ওপর যে দায়িত্ব বর্তেছিল, তা যথাযথ পালনের চেষ্টা আমি করেছিলাম। সেই উত্তাল দিনগুলোর প্রতিদিনই ছিল মিটিং, মিছিল, লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস, গুলি, লাশ, প্রতিবাদ সভা, গায়েবি-জানাজা, বিবৃতি দেওয়ার দিন। সেদিন আইয়ুব-মোনায়েমের তখতে-তাউসে কাঁপন জাগিয়েছিল ডাকসু। তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফে মিটিং-মিছিল করেছি। আজ থেকে সাড়ে চার দশক আগে একটি মেয়ে হয়েও এ দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয়েছিল ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী ছিলাম বলেই।
ছাত্রত্ব শেষে পরবর্তী জীবনযাপনে ছাত্র ইউনিয়ন আজও আমাকে প্রভাবিত করে রেখেছে। আমি অবশ্যই বলব, ছাত্র ইউনিয়নের কাছে আমি ঋণী। যে সুন্দর-সুখী ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় আমরা একদিন ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ছিলাম, সে প্রত্যাশায় আজকের ছাত্র ইউনিয়ন প্রজন্ম আরও সংগ্রামী হোক, আরও জঙ্গি হোক। ছাত্র ইউনিয়ন চিরঞ্জীব হোক। ছাত্র ইউনিয়ন আজকের অপ-রাজনীতিকে সঠিক পথ দেখাক বাতিঘর হিসেবে এ প্রত্যাশা আজকের দিনে।

মাহফুজা খানম : সাবেক ভিপি, ডাকসু ও চেয়ারম্যান কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর

No comments

Powered by Blogger.