কটূক্তির পুনরাবৃত্তি সংসদকে অকার্যকর করছেঃ আসল মতলবটা কি!

কার্যকর জাতীয় সংসদ তথা সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়ে মানুষের আশা ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির আশঙ্কা জাগছে জনমনে। গণতন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু জাতীয় সংসদের ঘটনাবলীই এমন ধারণা ছড়াতে ইন্ধন জোগাচ্ছে বলাটা মোটেই বাড়াবাড়ি হবে না।

নবম জাতীয় সংসদের চলতি অধিবেশনে যোগ দিয়ে বিরোধী দল বেশিদিন সংসদে থাকতে পারেনি। দীর্ঘ ৬৪ কার্যদিবসের পর গত বৃহস্পতিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) সংসদে ফিরেছিল তারা। অনেক প্রচেষ্টার পর সংসদ অধিবেশনে ফিরে আসায় সরকারি দলের সদস্যরা টেবিল চাপড়ে তাদের স্বাগত জানিয়েছিলেন। বিরোধী দলের অংশগ্রহণে অধিবেশন জমে উঠতে সময় লাগেনি। কিন্তু শুরুতেই ছন্দপতনের মতো অবস্থা সৃষ্টি করলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংঘর্ষ ও হত্যার ঘটনা নিয়ে বক্তব্যদানকালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে খুনি বলায় এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ওয়াক আউট করে বিরোধীদল। এর দু’দিন পর রোববার সংসদে বিরোধী দলের ফিরে আসায় যে আশার সঞ্চার হয়েছিল তাও যে ক্ষণস্থায়ী হবে সেটা কেউ ভাবতে পারেনি। সাবেক মন্ত্রী ও সরকার দলীয় প্রবীণ সদস্য শেখ সেলিম পয়েন্ট অব অর্ডারে ফ্লোর নিয়ে আবারও জিয়াউর রহমানের লাশ নিয়ে কটূক্তি করায় বিক্ষুব্ধ বিরোধদলীয় সদস্যরা অধিবেশন থেকে ওয়াক আউট করেন। এ যেন পা বাড়িয়ে ঝগড়া বাধানো। এর আগে ২ ফেব্রুয়ারি সংসদ অধিবেশনে বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে তিনি জিয়াউর রহমানের লাশ নিয়ে অশালীন বক্তব্য দেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী সম্পর্কেও কুরুচিপূর্ণ উক্তি করেন তিনি। একাধিকবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য হয়েও সংসদীয় ভাষা ও শিষ্টাচারবহির্ভূত বক্তব্য দেয়ার পেছনে কোনো দুরভিসন্ধি কাজ করছে কিনা সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। সরকার কি চাইছে না বিরোধী দল সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়ে যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করুক? খোঁচা মারা, অশালীন কথাবার্তায় ক্ষিপ্ত করে বিরোধী দলকে সংসদের বাইরে রাখতেই কি শেখ সেলিমের এমন অভব্য বক্তব্য! তারপরও যখন বিরোধীদল ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সংসদে যোগ দিল, তখনও তিনি থেমে থাকলেন না। অদৃশ্য সুতার টানে চালিত পুতুলের মতোই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটালেন। ওয়াক আউটে বিরোধী দলকে বাধ্য করলেন।
এমন এক সময়ে জাতীয় সংসদে এসব ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে, যখন দেশজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাঙ্গন ও বিভিন্ন জেলায় হত্যা-সন্ত্রাস অব্যাহত থাকলেও শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্মী হত্যা নিয়ে শুরু হয়েছে তাণ্ডবলীলা। দেশজুড়ে চিরুনি অভিযান চালিয়ে শত শত ছাত্র ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার ও নির্যাতন চালানো হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে আবারও কেঁপে উঠেছে সারাদেশ। একের পর এক হামলা-মামলায় বিরোধী মত ও শক্তিকে নির্মূল করতে মরিয়া হয়ে লাগার পেছনে কোনো সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনা কাজ করছে কিনা, সেটা ভাবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এ অবস্থায় আজ থেকে রাজধানীতে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের বৈঠক। যেখানে যোগ দিয়েছেন উন্নয়ন সহযোগী ও ঋণদাতা ৩২ দেশ ও সংস্থার দুই শতাধিক প্রতিনিধি। এর মধ্যেই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ঢাকা সফর করে গেছেন। এমন সময় দেশে সৃষ্ট ভীতিজনক পরিস্থিতি ও জাতীয় সংসদে অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা থেকে তাদের কি ধারণা হবে সেটা অনুমান করা কঠিন নয়। এর পাশাপাশি অতি সম্প্রতি সরকারি ও সরকার সমর্থক প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের মুখে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে নেতিবাচক এবং একদলীয় বাকশালী ব্যবস্থার প্রশংসাসূচক বক্তব্য চলমান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অক্ষুণ্ন থাকা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি না করে পারে না। দীর্ঘ প্রত্যাশিত গণতন্ত্রের পরিবর্তে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র চাপিয়ে দেয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্যই কি সংসদের ভেতর-বাইরে মহল বিশেষ উঠেপড়ে লেগেছে?
এক্ষেত্রে না বলে পারা যায় না, সরকার ও সরকারি দলের ভূমিকা জনমনে গভীর সন্দেহ ও আশঙ্কা সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংসদ ও সংসদীয় গণতন্ত্র অকার্যকর করে তোলার পেছনে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য কাজ করছে কি? এ অবস্থাকে নিঃসন্দেহে ঘর পোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘ দেখার সঙ্গে তুলনা করা যায়।

No comments

Powered by Blogger.