বিপন্ন সুন্দরবনঃ দস্যুদের কবল থেকে বাঁচান

‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে সুন্দরবনকে ভালোবাসুন’—এ স্লোগানকে সামনে রেখে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উদযাপনের মধ্য দিয়ে সুন্দরবন দিবস পালিত হলো গতকাল। বাংলাদেশের গৌরব সুন্দরবনকে ‘বিশ্ব প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য’ নির্বাচন করতে এদিনে আহ্বান জানায় সুন্দরবন একাডেমি ও সুন্দরবন দিবস উদযাপন পরিষদ।

এ ক্যাম্পেইন চলবে মাসব্যাপী পর্যায়ক্রমে দক্ষিণাঞ্চলের ১২টি জেলায়। কিন্তু হায়! শত শত নদীর ঝংকারে চঞ্চলা চিরযৌবনা সুন্দরী এ বন আজ বিস্তর উপদ্রবে ম্লান। বৃক্ষের ঘন সবুজ মুকুট পরা বনের রানী নানাভাবে বিপন্ন এখন। ডোরাকাটা বাঘ আর চিত্রা হরিণের জন্য খ্যাত এ বনের প্রাণী বৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে। নামেমাত্র বন প্রশাসন সুন্দরবন সুরক্ষায় তেমন সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে পারছে না। ফলে গোটা বনভূমিতে চলছে বনদস্যু ও জলদস্যুদের রাজত্ব। বন সীমান্তে চোরাচালানের নিরাপদ ঘাঁটি গড়ে তুলেছে তারা। নদী পথে বাংলাদেশ-ভারতের চোরাচালানিরা দীর্ঘকাল ধরে এই দুষ্কর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে ক্রমে বন থেকে কেটে নেয়া হচ্ছে মূল্যবান কাঠ এবং পাচার হচ্ছে নদীপথে। বনরক্ষীদের নাগের ডগায় হরিণ শিকার করে দুষ্কৃতকারীরা তার মাংস বিক্রি করছে পার্শ্ববর্তী হাটবাজারে। ‘জীবন্ত চিড়িয়াখানা’ বলে পরিচিত বিশ্বের বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলকে যথাযথ সুরক্ষা দিতে সরকারি উদ্যোগ যথেষ্ট নয়—এ অভিযোগ বহুদিনের। এরই পরিণতি হিসেবে চিরসবুজ এই বনভূমি মানুষের লালসার শিকারে পরিণত হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিলুপ্তির দিকে।
দু-দুটি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড সুন্দরবন ধীরে ধীরে স্বরূপ পাওয়ার সময়টিতে বন বিভাগ যথেষ্ট সজাগ থাকলে ‘বিশ্ব প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য’র তালিকায় সুন্দরবনের নাম লেখানো তেমন কোশেশের ব্যাপার ছিল না। কিন্তু এই সংরক্ষিত বনে যে ধরনের শুশ্রূষার দরকার বন বিভাগ তা দিতে পারেনি। বনদস্যু, জলদস্যু, চোরা শিকারি, অসাধু বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্মিলিত আক্রমণে বনের প্রাচুর্য কেবলই বিনাশ হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিডর-আইলার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সুন্দরবনকে নিরুপদ্রব রাখতে হবে বেশ কয়েক বছর। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। এ অবস্থায় খাদ্যাভাবে ভুগছে বনের প্রাণীরা। বহু পাখি বন ছেড়ে পালিয়েছে। খাবার জন্য বাঘ মারা পড়ছে লোকালয়ে এসে। এ ছাড়া বাড়তি ঝুঁকি হচ্ছে, বনের প্রধান গাছ সুন্দরী এখন টপ ডায়িং বা আগামরা রোগে আক্রান্ত। পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে বনের ছোট নদী ও খালগুলো। পাশাপাশি স্বাদু পানির অভাব এবং লবণাক্ততা বাড়ছে। এর জন্য দৃশ্যত দায়ী মরণফাঁদ ফারাক্কার বাঁধ। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন বিপন্ন সুন্দরবন। বনের ওপর নির্ভরশীল ছয় জেলার প্রায় ৪০ লাখ মানুষের জীবিকার ওপরও পড়ছে এর বিরূপ প্রভাব। এ অবস্থায় যদি মানুষের বহুমুখী উত্পাত বন্ধ করা না যায় তাহলে সুন্দরবনকে ঘিরে আমাদের ভালোবাসা ও আবেগই শুধু মূল্যহীন হয়ে পড়বে না, বদলে যাবে আমাদের নিসর্গ, বৃক্ষ ও প্রাণীর অনন্য প্রাকৃতিক ভাণ্ডার। এতে পরিবেশ-প্রতিবেশ দ্রুত এগিয়ে যাবে ঝুঁকির মুখে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুন্দরবনের অবদান বিশাল। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে এর সম্ভাবনা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। এর রূপবৈচিত্র্য সম্পর্কে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন বিশ্বের প্রকৃতিপ্রেমীরা। সে তুলনায় আমরাই বরং পিছিয়ে।
জানা গেছে, সুন্দরবনকে দেখভাল করার জন্য যে অপর্যাপ্ত জনবল রয়েছে তার মধ্যে খালি রয়েছে অসংখ্য পদ। সরকারি সিদ্ধান্তের অভাবে বাড়ানো হচ্ছে না মঞ্জুরিকৃত পদের সংখ্যা। এই জনবল দিয়ে চোরাচালানিদের নেটওয়ার্কের মোকাবিলা করা আক্ষরিক অর্থেই অসম্ভব। বনদস্যু, জলদস্যু এবং চোরাকারবারিদের দমন করতে দরকার অধিক জনবলসহ সীমান্তের রাস্তাঘাট উন্নয়ন, টহলগাড়ি ও আধুনিক নৌযান এবং আরও বেশি সীমান্ত ফাঁড়ি। এমনও শোনা যায়, অনেক সময় চোরাচালানিদের সেলাম দিয়ে প্রাণ বাঁচাতে হয় বনকর্মীদের।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বনদস্যু ও জলদস্যুদের উত্পাত বন্ধ করে সুন্দরবন অঞ্চলে যদি পরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো স্থাপন করে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা যায় তাহলে সুন্দরবন হতে পারে সারা দুনিয়ার পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ কেন্দ্র। কাজেই এই বেহাল অবস্থা থেকে সুন্দরবনকে বাঁচাতে হবে। এ জন্য সরকারের কাগুজে পরিকল্পনায় কোনো কাজ হবে না, হাতে-কলমে সুরক্ষার বিশাল প্রকল্প নিয়ে তা ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশবাসীকেও এ ব্যাপারে হতে হবে আরও সচেতন। তাহলে নিশ্চিত, বিশ্ব প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের তালিকার শীর্ষ ভাগে লেখা হবে সুন্দরবনের নাম। আমাদের আহ্বান—সুন্দরবনকে ভালোবাসুন, সুন্দরবনকে বাঁচান।

No comments

Powered by Blogger.