ইউরোপের চিঠি-সমরবাজির বিশ্বায়ন by পিটার কাস্টার্স

গত ২০-২১ ডিসেম্বর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ নয়াদিল্লিতে দুই দিনের সফর করে গেলেন। এই সফরকালে তিনি ভারতের মনমোহন সিং সরকারের সঙ্গে একগাদা চুক্তিতে সই দিয়েছেন। সংবাদমাধ্যমগুলোর বরাতে জানা গেল, এসব চুক্তির মধ্যে অস্ত্রের বিক্রিবাট্টা আর পারমাণবিক চুল্লিবিষয়ক চুক্তিই সব থেকে গুরুত্ববাহী।


একটি চুক্তিতে কমপক্ষে ৩০০ উন্নত মানের যুদ্ধবিমানের বিরাট এক চালানের কথা রয়েছে। ১০ বছর মেয়াদে এই কেনাবেচায় রাশিয়া ভারতের কাছে ‘পঞ্চম প্রজন্মে’র যুদ্ধবিমান বিক্রি করছে, এখন যার মূল্য ২৫ বিলিয়ন ইউরোরও বেশি। আরেকটি চুক্তির অধীনে রাশিয়া ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যে যে দুটি চুল্লি নির্মাণের কাজ করছে, তার বাইরে আরও দুটি পারমাণবিক চুল্লি বানাতে সহায়তা দেবে।
আপাতদৃষ্টিতে এসব চুক্তিকে খুব চাঞ্চল্যকর মনে হবে না। ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সামরিক ও পারমাণবিক সম্পর্কের ইতিহাস বেশ পুরোনো, সেই সোভিয়েত আমল থেকেই। নব্বইয়ের দশকের শুরু অবধি ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী যেসব সমরযন্ত্র ব্যবহার করত, তার ৮০ শতাংশই তৈরি হতো সোভিয়েত ইউনিয়নে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর কিছুকালের জন্য তাদের এই মাখামাখি কিছুটা কমে গিয়েছিল। ভারতের কাছে রাশিয়ার পাওনা নিয়ে তখন দুই পক্ষে বিবাদ চলছিল। রাশিয়ার দাবি ছিল ১৬ বিলিয়ন ডলার। তবে ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে তাদের সামরিক-বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনরায় সংহত হয়। আজ ভারতীয় সামরিক বাহিনী যেসব সমরাস্ত্র ব্যবহার করছে, তার বড় অংশ আসছে রাশিয়া থেকে।
এদিক থেকে মেদভেদেভের দিল্লি সফর তেমন আহামরি কোনো ঘটনা নয়। সাম্প্রতিক কালে পরাশক্তিগুলোর নেতাদের মধ্যে মেদভেদেভই একমাত্র নেতা নন, যিনি নয়াদিল্লি সফরকে সবার ওপরে গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রকৃত ঘটনা হলো, তাঁর এই সফরের ঠিক কিছুদিন আগেই কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা দিল্লি ঘুরে গেছেন। নভেম্বরে এসেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সারকোজি এলেন ডিসেম্বরের শুরুর দিকে, আর এই ডিসেম্বরেই এসেছিলেন চীনের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও। জিয়াবাও দিল্লি এসে পৌঁছেন ১৯ ডিসেম্বর, মেদভেদেভের একেবারে কাছাকাছি সময়ে। আন্তর্জাতিক সামরিক ও পারমাণবিক বিক্রিবাট্টার ব্যাপারে ভারতের বর্তমান কর্মপন্থা যদি কেউ আঁচ করতে চান, তবে এই তিন নেতার দিল্লি সফরের মধ্যে ওবামা আর সারকোজি আসার ঘটনাটিকেই বিশেষ মূল্য দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। যেহেতু এই সফরকালে আমেরিকার সেলসম্যান-প্রেসিডেন্ট নতুন দিল্লিতে প্রতিরক্ষাবিষয়ক দুটি লেনদেন চূড়ান্ত করতে পেরেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ১০টি সামরিক পরিবহন বিমানের বিক্রি, যার মধ্যে আছে সি-১৭ গ্লোবমাস্টার থ্রি মডেলের পণ্যবাহী উড়োজাহাজ। যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং করপোরেশনের তৈরি এই উড়োজাহাজটি ট্যাংক ও যুদ্ধফৌজকে পেটে পুরে আড়াই হাজার নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত নিয়ে যেতে সক্ষম। আবার, ফ্রান্সের সেলসম্যান-প্রেসিডেন্ট ফরাসি ও ইউরোপীয় সমরাস্ত্র করপোরেশনের জন্য যে বিরাট চুক্তি বাগিয়ে নিয়েছেন, সেটাও কিছু কম লোভনীয় নয়। ফরাসি দৈনিক লঁ মঁদ যেসব চুক্তির কথা জানাচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে থালেস ও ডাসলট কোম্পানি দুটির জন্য ৫১টি ‘মিরেজ’ যুদ্ধবিমানের আধুনিকায়নের চুক্তি। এর জন্য খরচ পড়বে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ইউরো। আরেকটি চুক্তি হয়েছে ইউরোপের প্রধান ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ‘এমবিডিএ’র পক্ষে। এটি তৈরি করে দেবে ভূমি থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে জনাকীর্ণ মুম্বাই শহরের কাছাকাছি এলাকায় দুটি বেসামরিক পারমাণবিক চুল্লি বানানোর চুক্তি। এই কাজটি করবে ফ্রান্সের পারমাণবিক প্রতিষ্ঠান অ্যারেভা।
কাজেই, বৈদেশিক সামরিক ও পারমাণবিক কেনাকাটা এবং চুক্তিতে দিল্লির এ মৌসুমটি সাদা চোখে দেখলেও নজিরবিহীন মানতে হচ্ছে। এই পর্যন্ত মালুম হওয়ার পর চুপচাপ বসে থাকা আর অন্য অদ্ভুত কাকতালগুলোকে শনাক্ত করতে না পারাটা হবে মোটা দাগের ভুল। আগেই বলেছি, দীর্ঘকাল ধরে ভারত সরকার সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (আজকের রাশিয়া) সঙ্গে হরিহর সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। তা সত্ত্বেও উপরিউক্ত সামরিক ও পরমাণু চুক্তিগুলোর তাৎপর্য বোঝার সবচেয়ে ভালো পন্থা হলো ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বদলে যাওয়া সম্পর্কে দৃষ্টি দেওয়া। ২০০৫ সালের জুলাইয়ে তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং পারমাণবিক সহযোগিতাবিষয়ক একটি কাঠামোগত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির মধ্য দিয়েই আণবিক শক্তি হিসেবে ভারতের উত্থানের ব্যাপারে পশ্চিমের প্রবল আপত্তি ও প্রতিরোধের পরিসমাপ্তি ঘটে। এই নতুন চুক্তির আনুষ্ঠানিক লক্ষ্য ছিল ইউরেনিয়াম ও আন্তর্জাতিক বেসামরিক পরমাণুপ্রযুক্তি ভারতের আওতার মধ্যে এনে দেওয়ার মাধ্যমে এর পরমাণু শক্তিবৃদ্ধিতে সহায়তা করা। ২০০৮ সালে ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্যানুসারে, ভারত ও বিদেশি উদ্যোক্তাদের মধ্যকার এই চুক্তির ফলে মোট ৪০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হতে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও এই পরমাণু চুক্তিটি যখন প্রস্তুত হচ্ছিল, তখন ভারত সরকারের বামপন্থী মিত্র ও শান্তিকামী নাগরিকেরা এর প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁদের তরফ থেকে যে বিষয়টিকে বড় করে দেখা হয়েছিল সেটা হলো, এই বিতর্কিত চুক্তির মাধ্যমে পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে ভারত বৈধতা পাবে।
এযাবৎকাল ভারতের সর্বসাধারণের মধ্যে চলমান বিতর্কে যে সন্দেহের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছিল সেটা হলো, এই চুক্তিকে সামরিক-পারমাণবিক শক্তি হিসেবে ভারতের আবির্ভাবে ব্যবহার করা হবে। কিন্তু ভারতীয় গণমাধ্যম এই চুক্তি সম্পাদনকালে চুক্তির ভিন্নধর্মী ব্যবহারের দিকে মনোযোগ দেয়। কাকতালীয়ভাবে, ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে আমি নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর কাজে গিয়েছিলাম। সেই সময়টায় যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত সরকার পরমাণু চুক্তির মূল ব্যাপারগুলো খোলাসা করে নিচ্ছিল। ভারতের প্রধান জাতীয় দৈনিকগুলোতে সেদেশে আমেরিকান সমরাস্ত্র রপ্তানি করার চুক্তি কোন কাজে লাগবে, সে বিষয়ে অনুমানগুলো পড়ে আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধের কথাই ধরা যাক। এখানে সামরিক ব্যয়ের কিছু পরিসংখ্যান ছাপা হয়েছিল। যেমন—কারগিল যুদ্ধের সময়কাল থেকে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অস্ত্র কিনতে ভারত কত টাকা ব্যয় করেছে (২৫ বিলিয়ন ডলার), আগামী পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে ঢাল-তলোয়ার কিনতে তারা কত টাকা খরচ করার হিসাব কষেছে (আরও ৩০ বিলিয়ন ডলার)। এ রকম বলা হয়েছিল, অস্ত্র রপ্তানি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সংযুক্ত লক্ষ্য। অস্ত্রের বিক্রিবাট্টার একটি চুক্তি ইতিমধ্যে বিতর্কের মাধ্যমে চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল, যাকে বলা হয়েছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সবচেয়ে বড় লেনদেন। এই চুক্তি অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রের তাবড় এক বোয়িং কোম্পানি ভারতীয় বিমানবাহিনীকে অভিযান চালানোর উপযোগী আটটি উড়োজাহাজ দেবে। গত নভেম্বরে ওবামা যখন দিল্লি সফর করেছেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি করপোরেশন, যথা—বোয়িং, লকহিড মার্টিন এবং জিই অ্যাভিয়েশনের সঙ্গে আরও কয়েকটি প্রতিরক্ষা চুক্তি চূড়ান্ত হয়েছে। দিল্লির সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত আমেরিকান সূত্রগুলোর বরাতে জানা গেছে, সাম্প্রতিক কালে ভারত যেসব সামরিক-বাণিজ্যিক চুক্তি করেছে, তার ৪০ ভাগই বাগিয়ে নিয়েছে আমেরিকা।
পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, আমেরিকান, ফ্রেঞ্চ ও রাশিয়ান সেলসম্যান-প্রেসিডেন্টদের সঙ্গে যেসব চুক্তি তাঁদের এই নভেম্বর-ডিসেম্বর দিল্লি সফরে চূড়ান্ত হলো, সেগুলো যৌথভাবে পাঠ করলে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের পরমাণু চুক্তির একটি ‘উল্টো পিঠ’ আছে। এর লক্ষ্য নিছক ভারতের পরমাণু শক্তি বৃদ্ধি নয়, প্রকৃত প্রস্তাবে এই চুক্তির মধ্য দিয়ে দুই দিক দিয়ে ভারত বৈধতার ছাড়পত্র পেয়ে যাচ্ছে। এটি একদিকে ভারতকে পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে বৈধতা দিচ্ছে, যা ইন্দো-পাক উপমহাদেশে পরমাণু ধ্বংসযজ্ঞের ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেবে। অন্যদিকে এটি আন্তর্জাতিক সামরিক-বাণিজ্যিক লেনদেনের ক্ষেত্রে দিল্লি সরকারকে এক নতুন কেতার বৈধতা দেবে। স্নায়ুযুদ্ধের দিনগুলোতে ভারত সরকারকে বিদেশি অস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে খুবই সাবধানে চিকন দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটতে হয়েছে। এযাবৎকাল ভর এবং ভারসাম্য বজায় রাখতে সামরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছে সোভিয়েত ইউনিয়নকে। পাশাপাশি ভারতের অভিলাষ ছিল পশ্চিমের ইউরোপীয় আড়তদারদের কাছ থেকেও অস্ত্র কেনাকাটা করার। এই পরমাণু চুক্তি ভারতকে বিশ্বের বিভিন্ন শক্তির সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক আরও কৌশলগত করে তোলার সুযোগ দেবে। এই চুক্তির মাধ্যমে ভারত পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাবে; তা-ই শুধু নয়, এটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে যৌথ নির্মাণের ভিত্তিতে উন্নততর সমরাস্ত্র কেনার ক্ষেত্রেও সব বেড়াজাল তুলে দেবে।
তাই যুক্তরাষ্ট্র-ভারত পরমাণু চুক্তিকে সালাম! কেউ হয়তো ওবামাকেও এই ফাঁকে সালাম জানিয়ে রাখতে চাইবেন, যিনি জুনিয়র বুশের নীতিনির্ধারণের পথ ভক্তিভরে অনুসরণ করে চলছেন। আর তাঁরই বদৌলতে ভারত আজ বিশ্ব অর্থনীতির সামরিকায়নের মাঠে ষোলোআনা বিকশিত এক পূর্ণবয়স্ক খেলোয়াড়।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ তৈমুর রেজা
ড. পিটার কাস্টার্স: গবেষক ও বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ; প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.