সমাপনী পরীক্ষা-মানোন্নয়নে যা করা দরকার by মোহাম্মদ কায়কোবাদ

এই দ্বিতীয়বারের মতো খুদে ছাত্রছাত্রীরা প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে আনন্দ-উল্লাস করতে পারছে। আর করবেই বা না কেন, প্রায় ৪৮ শতাংশ পরীক্ষার্থী সর্বোচ্চ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছে। আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগে পাবলিক পরীক্ষায় শতকরা ১০ ভাগ পরীক্ষার্থী প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত হতো কি না সন্দেহ। অবশ্য আগে প্রাথমিক কিংবা জুনিয়র শ্রেণীর জন্য পাবলিক পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল না।


তবে ইদানীং আমাদের কোমলমতি ছাত্রছাত্রী নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষণ হচ্ছে। সৃজনশীল পদ্ধতির সূচনা, সংস্কার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাঠ্যপুস্তকে নানা ধরনের পরিবর্তন, গ্রেডিং ব্যবস্থার সূচনা, সমাপনী পরীক্ষা ইত্যাদি নতুন যেকোনো পদ্ধতি সাফল্যসহকারে বাস্তবায়নের জন্য অভিজ্ঞতা ও পদ্ধতির চেক অ্যান্ড ব্যালান্স উভয়ই প্রয়োজন। ৩০ লাখ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা এর আগে একসঙ্গে নেওয়া হয়নি। এতগুলো পরীক্ষার খাতা স্বল্পতম সময়ে মূল্যায়ন করতে অসংগতি এবং ভুলভ্রান্তি থাকা মোটেই অসম্ভব নয়। তা ছাড়া প্রতি এলাকার খাতা যদি ওই এলাকার শিক্ষকেরাই দেখে থাকেন, তাহলে নম্বরস্ফীতির সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফলে এমনকি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভর্তি পরীক্ষায় রাজধানীর স্কুল-কলেজগুলোর আধিপত্য প্রায় একচ্ছত্র। আর হবেই বা না কেন। রাজধানীর স্কুল-কলেজগুলো ভৌত অবকাঠামোতে রাজধানীর বাইরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অধিকতর সমৃদ্ধ, শিক্ষকেরা শিক্ষার উৎকর্ষ ও অভিজ্ঞতায় শ্রেয়তর, শিখনসামগ্রীও অধিকতর। উপরন্তু রয়েছে নানা ধরনের কোচিংয়ের সুযোগ। আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগে গ্রামের ছেলেমেয়েরা উল্লেখযোগ্যভাবে মেধা তালিকায় স্থান পেত। সেই যুগের আজ অবসান হয়েছে, শিক্ষা এখন পণ্য হিসেবে বিবেচিত, অর্থ দিয়ে শিক্ষা কেনা যাচ্ছে। তাই অবহেলিত জনপদ থেকে শিক্ষার উৎকর্ষ অর্জন করা কঠিন হয়ে গেছে। এমন একটি অবস্থায় উচ্চশিক্ষায় গ্রামের উপস্থিতি যখন ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে, তখন প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার ফলাফলে রাজধানীর ভরাডুবি এবং গ্রামের সাফল্য যুক্তিতর্ক দিয়ে মেলানো যাচ্ছে না। রাজধানীর নামীদামি স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রস্তুতিতেও অনেক সময় দু-তিন বছর সময় লেগে যায়। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ছাত্রদের বয়স যেমন বেশি থাকে, ঠিক তেমনি বেশি থাকে জ্ঞানের পরিমাণ। উপরন্তু রয়েছে অধিকতর শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলী দ্বারা পাঠদান, শিক্ষার উপকরণ সমৃদ্ধি। তার পরও মেধা তালিকার ৫৭ জনের মধ্যে গোটা রাজধানী থেকে যেখানে মাত্র পাঁচজন, শুধু টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে নয়জন! মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত স্কুলগুলোর ছাত্রছাত্রীরা। এটা নিঃসন্দেহে একটি আশাজাগানিয়া ধারা। এই ফলাফল যদি স্বাভাবিক মাত্রায় ত্রুটিবিচ্যুতিমুক্ত হয়ে থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে আমাদের দেশটি অবহেলিত জনপদ ও সুবিধাবঞ্চিত জনগণের জন্য এটা একটি আশার বাণী।
তবে প্রায় ৩০ লাখ ছাত্রের পরীক্ষার খাতাগুলো এত অল্প সময়ের মধ্যে মূল্যায়ন, তার ব্যবস্থাপনা, সৃজনশীল পদ্ধতির সূচনা, সম্ভবত এলাকাভিত্তিক খাতার মূল্যায়ন—এসব কিছুর ফলে অগ্রণযোগ্য মাত্রায় ভুলের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে। সুতরাং নতুন পদ্ধতি যাতে ত্রুটিমুক্ত হয়ে গ্রহণযোগ্য হয়, তার জন্য চেক অ্যান্ড ব্যালান্স থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বিকল্প পদ্ধতির মাধ্যমে যদি এই নতুন প্রবর্তিত পদ্ধতির মূল্যায়ন করা যায়, তাহলে এর ত্রুটিবিচ্যুতি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনা হয়তো সম্ভব হবে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশ এই ফলাফলের ভিত্তিতেই নাকি প্রাথমিক বৃত্তি দেওয়া হবে। সব ছাত্রকে আমরা পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দিয়েছি। তাই বলে উৎকর্ষ অর্জনের প্রতিযোগিতায় সবাই আসবে না এটাই স্বাভাবিক—এমনকি সব সুযোগ-সুবিধাসংবলিত দেশেও তা হয় না। আমার মনে হয় বরং প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষা আয়োজন করে তার ফলাফল দিয়ে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করা যেতে পারে। টাঙ্গাইলের যে ছেলে ৬০০ নম্বরের মধ্যে ৫৯৮ পেয়েছে তাকে অভিনন্দন জানাই। সারা দেশের ছেলেমেয়েদের শিক্ষায় উৎকর্ষ অর্জনে উৎসাহিত করতে এই ছেলেটির উত্তরপত্র জাতীয় কোনো দৈনিকে ছাপিয়ে দেওয়া উচিত, তাতে অন্যরা জানতে পারবে শিক্ষায় কী মাত্রায় শুদ্ধতা ও উৎকর্ষ অর্জন করতে হয়। পশ্চিমবঙ্গে ভালো ভালো উত্তরপত্র পত্রিকায় ছাপিয়ে দেওয়ার একটি রেওয়াজ চালু রয়েছে।
প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষাকে শ্রেয়তর ও সমৃদ্ধ করতে কয়েকটি প্রস্তাব উপস্থাপন করা হলো। ১. শতকরা ৫০ ভাগ নম্বর নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের জন্য বরাদ্দ থাকা উচিত, যাতে বিভিন্ন এলাকার ছাত্রদের আপেক্ষিক পারফরম্যান্স মাপা যায়। নির্ভুলভাবে কাজটি করার জন্য জুতসই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। ২. একই এলাকার পরীক্ষার খাতা ভিন্ন এলাকার পরীক্ষকদের দিয়ে মূল্যায়ন করার বিষয়টি বাস্তবসম্মত হলে তা বিবেচনায় রাখা উচিত, যাতে এলাকাপ্রীতির বিষয়টি নম্বরস্ফীতির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। ৩. এই পরীক্ষার শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হাজার বিশেক ছাত্রের জন্য বৃত্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত। সংখ্যার তুলনামূলকভাবে কম বলে এখানে মূল্যায়ন অধিকতর নির্ভুল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফল যদি সমাপনী পরীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তাহলে আমাদের বর্তমান পদ্ধতির যথার্থতায় আমরা অধিকতর আস্থাবান।
শিক্ষায় উৎকর্ষ অর্জন করতে হলে প্রতিযোগিতার কোনো বিকল্প নেই। সুতবাং বৃত্তি পরীক্ষাকে আরও আনন্দদায়ক করে আমাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় উৎসাহিত করতে হবে।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বুয়েট; ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।

No comments

Powered by Blogger.