গোয়েন্দা নজরে ১২ মামলার নথি আর ৯ কারণ by পারভেজ খান

পুলিশসহ সরকারের একাধিক সংস্থা বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী আর তাঁর গাড়িচালক আনসারের সন্ধান অব্যাহত রেখেছে। তবে মূল কাজটি করছে র‌্যাব। এই এলিট ফোর্স জানায়, বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মাঠ পর্যায়ে অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি তারা ওই দুজনের নিখোঁজ হওয়ার সম্ভাব্য কারণ খুঁজে বের করতে পৃথক টিম গঠন করে নানান নথিপত্র পর্যালোচনা করছে।


একই নথিপত্র নিয়ে কাজ করছেন সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারাও।
এসব নথিপত্রের মধ্যে রয়েছে নিখোঁজ হওয়ার নেপথ্যে থাকতে পারে এমন ৯টি সম্ভাব্য কারণ আর ইলিয়াস আলীর বিরুদ্ধে থাকা ১২টি মামলা। গোয়েন্দারা নথিপত্র ঘাঁটতে গিয়ে ইতিমধ্যে দুজন সাবেক সংসদ সদস্যসহ রাজনীতি সম্পৃক্ত শতাধিক ব্যক্তিকে তাঁদের কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। গোয়েন্দা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, তাঁরা যে ৯টি সম্ভাব্য কারণ আর ১২টি মামলার নথি নিয়ে কাজ করছেন, এর যেকোনো একটির মধ্যেই নিখোঁজ-রহস্য লুকিয়ে আছে বলে তাঁদের মনে হচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্র থেকে পাওয়া সম্ভাব্য কারণগুলো হচ্ছে-
এক. সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করা বা সরকারকে বিপর্যস্ত অবস্থায় ফেলার জন্য সরকারের কোনো সংস্থার বিপক্ষমনা লোকজনই পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এর পেছনে ওই সংস্থার একটি ইসলামী মৌলবাদী-মনা গোষ্ঠী থাকতে পারে, যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না। সম্প্রতি সেনা অভ্যুত্থানের একটি অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এ চক্রের সঙ্গে সেনাবাহিনীরই একটি অংশ ছিল, যাদের সরকার কঠোর হাতে দমন করে। সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা আল খালাফ খুন হন কিছুদিন আগে। তাঁর হত্যাকাণ্ডটি সরকারকে কিছুটা হলেও বিব্রত করেছে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের এখনো কোনো কূল-কিনারা হয়নি। পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থা ডিবি এ মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য বের করতে পারেনি। ফলে এসব ঘটনার সঙ্গেও এই নিখোঁজ ঘটনার নেপথ্য নায়কদের একটা যোগসূত্র থাকাটা স্বাভাবিক। বিশেষ করে উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবলে এই সন্দেহ জোরালোভাবে দানা বাঁধে।
দুই. সিলেটে বিএনপি একাধিক গ্রুপে বিভক্ত। তবে এর মধ্যে দুটি গ্রুপ আবার জোরালোভাবে বিভক্ত। এ দুই গ্রুপের একটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডা. শাহরিয়া এবং অন্য গ্রুপের নেতৃত্ব দেন ইলিয়াস আলী। শাহরিয়া গ্রুপ আগে বিএনপির প্রয়াত নেতা সাইফুর রহমানের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এই দুই গ্রুপের বিরোধও গোয়েন্দারা খতিয়ে দেখছেন।
তিন. ইলিয়াস আলী যে গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করছিলেন সেই গ্রুপও আবার দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। একটি ভাগ নিয়ন্ত্রণ করতেন ইফতেখার আহমেদ দিনার। আরেক গ্রুপ অ্যাডভোকেট শামসুজ্জামান। সম্প্রতি দিনারও নিখোঁজ। অ্যাডভোকেট শামুজ্জামান সিলেট জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি। দিনার ও জামান গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে প্রায়ই সংঘর্ষ বাধত। এ দুই গ্রুপের অনেকের বিরুদ্ধেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজি ও হুন্ডি ব্যবসার অভিযোগ গোয়েন্দাদের কাছে জমা পড়েছিল। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে শওকত নামে জামান গ্রুপের একজন এই অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরে খুন হন। ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ-রহস্য উদ্ঘাটনে গোয়েন্দারা এ বিরোধকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন।
চার. সিলেট-১ আসনের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়ার জন্য ইলিয়াস আলী দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন। কিন্তু শমসের মবিন চৌধুরীর বিরোধিতার কারণে তিনি তা পেরে উঠছিলেন না। এতে শমসের মবিন চৌধুরীর সঙ্গে ইলিয়াস আলীর একটি বিরোধ দেখা দেয়। গোয়েন্দারা এদিকেও নজর দিচ্ছেন।
পাঁচ. বিএনপি নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত সাইফুর রহমানের ডান হাত হিসেবে চিহ্নিত সিলেটে বিএনপির আরেক প্রভাবশালী নেতা আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি। ইলিয়াস আলীর সঙ্গে এই আরিফুল হকের প্রকাশ্য বিরোধ আছে। এ বিষয়ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা খতিয়ে দেখছেন।
ছয়. সম্প্রতি সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুক অর্থ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন। একটি মহল থেকে জানা গেছে, ইলিয়াস আলীর গাড়িচালক আনসারের সঙ্গে ওমর ফারুকের গাড়িচালক আলী আজমের অতি-ঘনিষ্ঠতা ছিল। একই মহল বলছে, ইলিয়াস আলীই তাঁর গাড়িচালক আনসারের মাধ্যমে ওমর ফারুকের গাড়িতে ৭০ লাখ টাকা থাকার খবর জানতে পেরে তাঁদের ধরিয়ে দেন। ওই ঘটনাটি যাঁরা তদন্ত করছেন তাঁদের কাছ থেকে এ-সংক্রান্ত নথিপত্র সংগ্রহ করে গোয়েন্দারা খতিয়ে দেখছেন।
সাত. সিলেট জেলায় বিগত সময়ে কয়েকটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে আছে বিশ্বনাথ উপজেলা যুবদল নেতা নুর আলম হত্যাকাণ্ড, বিশ্বনাথ উপজেলা যুবদল নেতা হরমুজ আলী হত্যাকাণ্ড, বিশ্বনাথ থানা ছাত্রদল নেতা ফয়েজ আহমেদ অনু হত্যাকাণ্ড, শিল্পপতি হাবিবুর রহমান হত্যাকাণ্ড। এ ছাড়া লিটন নামে এক ছাত্রদল নেতাকে মারধর করে পঙ্গু করে ফেলা হয়েছে। এসব ঘটনায় করা মামলার নথিগুলোও দেখছেন গোয়েন্দারা।
আট. সিলেটে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ইলিয়াস আলীর সম্পর্ক ভালো ছিল না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে জামায়াতের আন্দোলনে সেখানকার জামায়াত নেতারা ইলিয়াস আলীর কাছ থেকে প্রত্যাশিত সহযোগিতা পাননি। এসব নিয়ে সিলেট জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতার সঙ্গেও ইলিয়াস আলীর সম্পর্ক খারাপ যাচ্ছিল। সম্প্রতি খালেদা জিয়া সিলেট সফরে গেলে এক জনসভায় ইলিয়াস আলীর সঙ্গে জামায়াত নেতাদের কথা-কাটাকাটি হয়। এসবও গোয়েন্দারা ভাবছেন।
নয়. বর্তমান সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে বা সরকার হঠাও আন্দোলনের ইস্যু তৈরি করতে বিএনপির একটি সুবিধাবাধী চক্রও ইলিয়াস আলীকে গুম করে রাখতে পারে। গোয়েন্দারা সরকারদলীয় রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে আসা এ ধারণাকেও কম গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ইলিয়াস আলীর বিরুদ্ধে দায়ের করা ১২ মামলার নথিপত্র সংগ্রহ করে তাঁরা সেগুলোও পর্যালাচনা করছেন। এ ১২টি মামলার মধ্যেও নিখোঁজ ঘটনার কোনো রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে বলে তাঁদের ধারণা। মামলাগুলোর মধ্যে আছে কোতোয়ালি থানায় দায়ের করা দ্রুতবিচার আইনের দুটি মামলা। মামলা নম্বর ২২ ও ২৩। দক্ষিণ সুরমা থানায় দ্রুতবিচার আইনে দায়ের করা একটি মামলা, যার নম্বর ১১। জালালাবাদ থানায় করা মামলা নম্বর ৭ এবং শাহ পরান থানার মামলা নম্বর ১২। এসব মামলা গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর দ্রুতবিচার আইনে দায়ের করা হয়। অন্য মামলাগুলো হচ্ছে কোতোয়ালি থানায় করা মামলা নম্বর ৪৪; তারিখ ১১ (০৫) ২০০৭, মামলা নম্বর ৬৭; তারিখ ২১ (০৭) ২০০৮, দক্ষিণ সুরমা থানার একটি হত্যা মামলা, নম্বর ১২; তারিখ ১৮ (১২) ২০১১, বিশ্বনাথ থানার আরো চার মামলা। যেগুলোর নম্বর যথাক্রমে ৫, ১৫, ১০ ও ১১। তারিখ মামলার নম্বরক্রমে ১৪ (০১) ২০০৯, ২৭ (০৪) ২০০৭ এবং শেষের দুটির তারিখ ১৮ (০৪) ২০১২।
এদিকে নিখোঁজ ঘটনার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে র‌্যাবের পরিচালক কমান্ডার সোহায়েল গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, আসলে অগ্রগতি শব্দটার অনেক ব্যাখ্যা আছে। তদন্তে যথেষ্ট অগ্রগতি আছে। তাঁর নিখোঁজ হওয়ার নেপথ্য কারণ খুঁজে বের করতে র‌্যাব অনেক অনুসন্ধানী তৎপরতা চালাচ্ছে। পাশাপাশি তাঁকে উদ্ধারের জন্যও চেষ্টা চলছে। সম্ভাব্য অনেক স্থানেই অভিযান চালানো হয়েছে। তাঁদের প্রচেষ্টার কোনো কমতি নেই। তবে এখন পর্যন্ত তাঁর অবস্থান বা কারা তাঁকে গুম করেছে সে ব্যাপারেও স্পষ্ট কোনো ধারণা তাঁরা পাননি।

No comments

Powered by Blogger.