রাজনীতি-গণতন্ত্রই কি চ্যালেঞ্জের মুখে? by মোঃ আনোয়ার হোসেন

দেশের কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য সবাই মিলে কাজ করুক, এটাই দেশবাসী দেখতে চায়। কিন্তু পরপর তিনদিন হরতাল পালন এবং আরও কঠোর কর্মসূচির হুমকি শঙ্কা জাগায়। আর এ কারণেই ধারণা তৈরি হয়_ পরিকল্পিতভাবে কোনো মহল পর্দার আড়ালে সক্রিয় নেই তো? হয়তো একদিন আমরা সবকিছু জানতে পারব।


কিন্তু তখন যে দেরি হয়ে যাবে। আমরা ষড়যন্ত্রের ফাঁদে যেন কোনোভাবেই পা না দেই



রাজনৈতিক পরিস্থিতি যথেষ্টই উত্তপ্তস্ন। সরকার ও বিরোধী পক্ষ পরস্পর মুখোমুখি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে কোনো পক্ষই ছাড় দিতে রাজি নয়। বিএনপি জোট ১২ মার্চের সমাবেশ থেকে তিন মাসের আলটিমেটাম দিয়েছে। এর মধ্যেই ঘটেছে সাবেক সংসদ সদস্য ও সিলেট জেলা বিএনপি সভাপতি ইলিয়াস আলীর 'নিঁখোজ' রহস্য। এ ঘটনায় ইতিমধ্যে টানা তিনদিন হরতাল পালিত হয়েছে এবং দেশের নানা স্থান থেকে সহিংস ঘটনার খবর মিলছে। কয়েকটি প্রাণ ঝরে গেছে। যে বা যারাই এর পেছনে থাকুক, এমন ঘটনা কেউ সমর্থন করতে পারে না। সরকার বলেছে, তারা বিব্রত। বিরোধীরা দায়ী করছে সরকারকে। তিনদিনের হরতাল শেষে এসেছে চারদিনের আলটিমেটাম। জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা চরমে।
আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কূল-কিনারা করতে পারছে না। রাজধানীর অভিজাত এলাকাতেই নিহত হয়েছেন সৌদি আরবের একজন দূতাবাস কর্মকর্তা। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী বাচ্চু রাজাকারকে বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালের সামনে হাজির করা হতে পারে, এটা আগেই জানা ছিল। তাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে, এটা ধরে নেওয়া যায়। কীভাবে তিনি পালাতে পারলেন? এসব ঘটনায় আমাদের দুশ্চিন্তা বাড়ে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি করে। ইলিয়াস আলীর ঘটনা উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দেয়। কেউ অপরাধ সংঘটিত করে যদি নিরাপদে বা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যেতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে যে তার অবস্থান খুবই শক্তিশালী। এতে সরকার বিব্রত হয়। জনগণ ক্ষুব্ধ হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাই শঙ্কা স্বাভাবিক।
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু এখানে গণতন্ত্র বারবার হরণ করা হয়েছে। সেনাশাসন জারি হয়েছে দফায় দফায়। একাত্তরের পরাজিত শক্তিকে মাথা তুলতে দেওয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গণতান্ত্রিক অভ্যাস, সহনশীলতা_ এসবের বড়ই অভাব। রাজনৈতিক দল এমনকি সুশীল সমাজের মধ্যেও সহনশীল আচরণ লক্ষ্য করা যায় না। কিন্তু তারপরও বলব, বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্র নয়। বরং অপার সম্ভাবনার দেশ। এখানের মানুষ গণতন্ত্রকামী। তারা শ্রমে-সৃজনে পরান্মুখ নয়। বরং অসাধ্য সাধনের ক্ষমতা রাখে এবং বারবার সে শক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর জনগণের অনেক ভরসা। তার সরকারের যে কোনো ব্যর্থতা গণতন্ত্রকামী মানুষকে উদ্বিগ্ন করে। অপশক্তি পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে, এমন শঙ্কা জাগায়। ২০০২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের ঘটনা আমাদের স্মরণে রয়েছে। ছাত্রীদের হলে রাতে পুলিশ হামলা চালিয়ে অনেককে আটক করে রমনা থানায় নিয়ে যায়। শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা মিলিতভাবে এ অমানবিক ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করেছি। এ ঘটনায় আমি নিজেও পুলিশি নির্যাতনের শিকার হই। পুলিশি নির্যাতনে আমার হাত ভেঙে যায় এবং সাড়ে তিন মাস শয্যাশায়ী থাকতে বাধ্য হই। ওই আমলেই আমাদের সহকর্মী হুমায়ুন আজাদ একুশের বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার সময় সন্ত্রাসী হামলায় গুরুতর আহত হন। দেশ-বিদেশে চিকিৎসায় তিনি পুনরুজ্জীবন লাভ করেন। কিন্তু বেশিদিন তাকে আমাদের মাঝে ধরে রাখা যায়নি। আরেকজন আলোকিত মানুষ ছিলেন অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া। তিনি সফল মন্ত্রী ছিলেন। দুর্নীতির কোনো অভিযোগ ছিল না। সীমিত রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জন্য যথেষ্ট স্বস্তির জীবন নিশ্চিত করতে সচেষ্ট ছিলেন। তাকে জীবন দিতে হলো নিজের নির্বাচনী এলাকায় সন্ত্রাসী হামলায়। সুচিকিৎসা হলে তাকে বাঁচানো সম্ভব হতো। কিন্তু সরকার তাকে দ্রুত ঢাকা নিয়ে আসার জন্য হেলিকপ্টার দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউর সমাবেশে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের গোটা নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টাও বিস্মৃত হওয়ার উপায় নেই। এর সঙ্গে সরকারের নীতিনির্ধারক মহল জড়িত ছিল। তদন্তে দেখা যায়, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রীর পুত্রের সংশ্লিষ্টতারও প্রমাণ মিলছে।
ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার পর সরকার পতনের আন্দোলনের আহ্বান শোনা যাচ্ছে। তিনি একজন প্রভাবশালী নেতা। ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকায় বিএনপি সরকারের আমলেই তাকে জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু আমরা এক গণতান্ত্রিক সমাজে বাস করি। আর এ কারণেই কেউ এমনকি অপরাধী হলেও তাকে আইনের আশ্রয় থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ নেই। এ ব্যবস্থায় হত্যা-গুম-অপহরণকে খাটো করে দেখা হয় না। বিএনপি জোট তাকে 'ফিরিয়ে দেওয়ার' দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে। সুশীল সমাজ সোচ্চার হয়েছে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কঠোর মনোভাব গ্রহণ করেছেন।
২০০৭ সালে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আড়ালে অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য পথে নামি। এ জন্য অনেককে নির্যাতিত হতে হয়। আমি নিজেও দীর্ঘ সময় জেলে থাকতে বাধ্য হই। এ পরিস্থিতি আমরা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হই গণতান্ত্রিক শক্তির দৃঢ় অবস্থানের কারণেই। আর এ কারণেই প্রত্যাশা করতে চাই নাগরিক অধিকার রক্ষায় সরকার বলিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণ করুক। ইলিয়াস আলীর মুক্তির জন্য লাগাতার হরতাল পালনে জনদুর্ভোগ বাড়ে। ঘুমন্ত বাসচালককে পুড়িয়ে হত্যা কিংবা সাধারণ আইন-শৃঙ্খলা অবনতির চেষ্টা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। আন্দোলনের কর্মসূচি প্রণয়ন করতে গিয়ে এটা অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে।
গণতন্ত্র কতটা শক্তিশালী তার মাপকাঠি হতে পারে সাধারণ মানুষকে সরকার কতটা সুরক্ষা দিতে পারল কিংবা নাগরিক অধিকার কতটা নিশ্চিত করা গেল। এ বিচারে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভিত যথেষ্ট দুর্বল। কিন্তু এর মধ্যেও গণতন্ত্রের উপস্থিতিই আমাদের জন্য আশার আলো। এ কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কাদেরের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল যে পুলিশ কর্মকর্তা তার স্থান হয়েছে কারাগারে। খুলনায় ছাত্রদলের নেতার ওপর নির্যাতন পরিচালনাকারী পুলিশ কর্মকর্তার জন্যও দ্রুত শাস্তি বিধান করা সম্ভব হয়েছে। এ গণতন্ত্র যেন কোনোভাবেই আমরা হারিয়ে না ফেলি সে বিষয়ে গণতান্ত্রিক শক্তির সর্বোচ্চ সতর্কতা কাম্য। আমরা এমন কোনো অবস্থার সৃষ্টি করতে পারি না যাতে গণতন্ত্রের প্রতি হুমকি বাড়ে। আমরা যখন দেখি বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা ইলিয়াস আলীকে ফিরে পেতে সহায়তার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের সঙ্গে আলোচনায় বসেন, তখন ভালো লাগে। দেশের কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য সবাই মিলে কাজ করুক, এটাই দেশবাসী দেখতে চায়। কিন্তু পরপর তিনদিন হরতাল পালন এবং আরও কঠোর কর্মসূচির হুমকি শঙ্কা জাগায়। আর এ কারণেই ধারণা তৈরি হয়_ পরিকল্পিতভাবে কোনো মহল পর্দার আড়ালে সক্রিয় নেই তো? হয়তো একদিন আমরা সবকিছু জানতে পারব। কিন্তু তখন যে দেরি হয়ে যাবে। আমরা ষড়যন্ত্রের ফাঁদে যেন কোনোভাবেই পা না দেই। দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেসব অর্জন তা হারিয়ে ফেলা যাবে না।
দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে দল ক্ষমতায় আসুক, সবাই মেনে নেবে। তারা পূর্ববর্তী সরকারের ভুল থেকে শিক্ষা নেবে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করায় সচেষ্ট হবে_ এসবই কাম্য।
বর্তমান সরকার ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনের পর সরকার গঠন করতে তাকে জাতীয় পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সমর্থন নিতে হয়েছিল। কিন্তু এবারে আওয়ামী লীগের রয়েছে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। এ বিবেচনায় বর্তমান সরকার শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে। কিন্তু কখনও কখনও তাদের কর্মকাণ্ডে মনে হয়, পূর্ববর্তী সরকারের চেয়েও দুর্বল অবস্থানে রয়েছে তারা। এ জন্য বাইরের শক্তির ওপর দোষ চাপিয়ে লাভ নেই। নজর দিতে হবে ভেতরে। ক্ষমতায় বসতে না বসতেই পিলখানায় 'বিডিআর বিদ্রোহ' সংঘটিত হলো এবং তাতে সেনাবাহিনীর অনেক মেধাবী অফিসারকে প্রাণ দিতে হয়েছে। ওই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভাবনীয় সাহস ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। এটা সবাই স্বীকার করেছে যে, তার রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকার কারণেই দেশ এমনকি গৃহযুদ্ধের মতো বিপর্যয় থেকে রেহাই পেয়েছে। কিন্তু এখন কেন যেন অনেকেই মনে করছেন, দেশ সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের খপ্পর থেকে মুক্ত হতে পারছে না। এ কারণেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের কাজে নানা অসঙ্গতি ও ব্যর্থতা ধরা পড়ে। যেসব ক্ষেত্রে সরকারের মধ্যে সর্বোচ্চ সমন্বয়ের প্রয়োজন, বাস্তবে দেখা যায় তার বিপরীত চিত্র। অনেক সময় মনে হয়_ ভেতর থেকেই অন্তর্ঘাত পরিচালিত হচ্ছে না তো? সরকারের কাজে গতি আনতে, ব্যর্থতাজনিত ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারকেই সক্ষম হতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কন্যা। ২০০৭ সালের শুরুতে ওয়ান-ইলেভেন সংঘটিত করে যখন গণতন্ত্র হরণ করা হয় তখন রাজনীতিবিদদের মধ্যে কেবল তিনিই এককভাবে অসম সাহসিকতায় রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। মহাজোট তাকে সামনে রেখেই নির্বাচন করেছিল। জনগণ তার ওপর বিপুল আস্থা রাখে। সরকার জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করতে না পারায় জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে, সেটা স্পষ্ট। তিনি শক্ত হাতে পরিস্থিতি সামাল দেবেন, কঠিন সময় পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবেন, এটাই কামনা করব।
বিএনপি কয়েক দফায় দেশ শাসন করেছে। এখন তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র জামায়াতে ইসলামী। বিএনপি অনেক সময় একাত্তরের মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে সরাসরি সংশ্লিষ্ট দলটি দ্বারা পরিচালিত হয়, এমন ধারণা জনমনে রয়েছে এবং তা অমূলক নয়। বর্তমানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। এ বিচারকে ভণ্ডুল করার জন্য নানামুখী তৎপরতা চলছে তাতে সন্দেহ করা চলে না। বিএনপি এ পরিস্থিতি উপলব্ধি করবে, এ প্রত্যাশা রয়েছে। এ দলে গণতন্ত্রমনা অনেক লোক রয়েছেন। ওয়ান-ইলেভেনের পর জেলখানায় তাদের অনেক নেতাকে দেখেছি। সামরিক পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের নানাভাবে হয়রানি ও নিগৃহীত করেছে। তারা গণতান্ত্রিক ও সহনশীল হবে, এটাই চাইব। আমাদের গণতন্ত্র যেন কোনোভাবেই হারিয়ে না ফেলি। যে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে তা দ্রুত দূর হয়ে যাবে নিশ্চয়ই।

অধ্যাপক ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন : সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষক সমিতি

No comments

Powered by Blogger.