গদ্যকার্টুন-ঢাকা আছে খুল না? by আনিসুল হক

ঢাকায় যানজট নিরসনের লক্ষ্যে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় কতগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। এই প্রস্তাবগুলো এখন বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে আছে: ১. চারজনের চেয়ে কম যাত্রী নিয়ে কোনো প্রাইভেটকার রাস্তায় চলতে দেওয়া হবে না।


এটি অত্যন্ত উত্তম প্রস্তাব। এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশে আর কেউ বেকার থাকবে না। কারণ তখন বড়লোক গাড়িওয়ালারা রাস্তার টোকাই থেকে শুরু করে বেকার লোকজনকে একটা নতুন পেশায় নিয়োগ করবে। এই পেশার নাম হবে: প্যাসেঞ্জারগিরি। এই পেশাজীবীদের আমরা ‘পেশাদার যাত্রী’ বলে অভিহিত করতে পারব।
এই পেশাজীবীদের কাজ হবে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে গাড়ির যাত্রী হিসেবে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাওয়া।
ধরা যাক, আবদুল করিমের একটা গাড়ি আছে। তিনি থাকেন লালমাটিয়ায়। তাঁর মেয়ে মতিঝিল গার্লস স্কুলে পড়ে। চালক এই মেয়েকে সকালবেলা স্কুলে নিয়ে যায় ও দুপুরে স্কুল থেকে নিয়ে আসে। এখন যেহেতু চারজনের কমে যাত্রী নিয়ে গাড়ি চলতে পারবে না, আর আবদুল করিম সাহেব ও তাঁর স্ত্রী উভয়েই কর্মজীবী, তাই তাঁদের গাড়িতে মেয়ে ছাড়াও আরও দুজন যাত্রী তুলতে হবে। এই দুজন যাত্রী হিসেবে দুজন টোকাইকে তাঁরা ভাড়া করবেন। টোকাই দুজন টাকার বিনিময়ে লালমাটিয়া থেকে মতিঝিল বালিকা বিদ্যালয়ে যাবে-আসবে।
এর মধ্যে যদি এমন হয় যে আবদুল করিম সাহেব সকালে মেয়ের সঙ্গে একই গাড়িতে মতিঝিলে তাঁর অফিসে যান, তাহলে হিসাবটা বেশ মুশকিল হবে। সকালবেলা লালমাটিয়ার বাড়িতে প্যাসেঞ্জার টোকাই আসবে একজন। আবদুল করিম, তাঁর চালক, তাঁর মেয়ে আর পেশাদার প্যাসেঞ্জার—মোট চারজন যাত্রী নিয়ে গাড়ি বাসা থেকে বের হবে। মেয়েকে স্কুলে নামানোর ফলে তাঁদের গাড়ির যাত্রীসংখ্যা একজন কমে যাবে। তখন ওই স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রেজিস্টার্ড প্যাসেঞ্জারদের মধ্য থেকে কাউকে তাঁরা তখন গাড়িতে তুলে নেবেন। করিম সাহেবকে মতিঝিলে তাঁর অফিসে নামিয়ে দেওয়ার পর আরও একজন পেশাদার যাত্রীকে চালক গাড়িতে তুলবে। তারপর গাড়ি আসবে স্কুলে। স্কুলে এসে আবার একজন পেশাদার যাত্রীকে নামিয়ে দিয়ে মেয়েকে তোলা হবে। তারপর গাড়ি যাবে লালমাটিয়ায়। সেখানে মেয়েকে নামিয়ে গাড়ি যাবে ফের মতিঝিল। কারণ সাহেবকে তুলতে হবে। এ সময় তিনজন ভাড়াটে যাত্রী দরকার হবে। মতিঝিলে গিয়ে একজন যাত্রীকে নামিয়ে দিয়ে বাকি দুজন ও সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে চালক বাড়ি ফিরবে।
এই পেশাদার যাত্রীদের মজুরি কী হবে, সেটা জাতীয় মজুরি কমিশন ঠিক করতে পারে। আর তারা যে গাড়ি ও গাড়ির মালিক আর তাঁর মেয়ের জন্য নিরাপদ হবে, সেটা নিশ্চিত করার জন্য এক বা একাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে। তারা এই যাত্রীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও পোশাক দেবে এবং তাদের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশন সনদ জোগাড় করবে। হাজার হোক, যাকে-তাকে তো আর আপনি আপনার গাড়িতে আপনার পাশে বসাতে পারেন না।
এই পেশাদার যাত্রীরা ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারবে কি পারবে না, সেটা পরের বিবেচ্য। তবে তারা যে তাদের মজুরি বাড়ানোর দাবিতে ধর্মঘট করবে এবং মাঝেমধ্যে গাড়ি ভাঙচুরও করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই পেশাদার যাত্রীদের দাবি-দাওয়া গাড়িওয়ালারা মেনে নিতে বাধ্যই থাকবেন। নইলে আপনি এয়ারপোর্টে আপনার স্বজনকে নামিয়ে দিয়ে খালি গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবেন না। কারণ গাড়ির যাত্রী আপনি একা। চারজন আরোহী গাড়িতে না থাকলে ঢাকার রাস্তায় যে গাড়ি চলতে পারবে না।
প্রস্তাব-২
ঢাকা শহরের রাস্তায় এক দিন জোড় নম্বরের গাড়ি, এক দিন বিজোড় নম্বরের গাড়ি চলতে পারবে।
ঢাকার বড়লোকেরা এ সমস্যারও সমাধান বের করে ফেলতে পারবেন বলে আশা করা যায়। তাঁরা দুটো গাড়ি রাখবেন। একটার নম্বর হবে জোড় আরেকটার বিজোড়। ফলে তাঁরা এক দিন এই গাড়ি, আরেক দিন ওই গাড়ি চালাবেন।
তবে মাঝেমধ্যে মুশকিল হবে। ধরুন, আপনি রাত ১১টায় একটা জোড় নম্বরের গাড়ি নিয়ে জরুরি কাজে বেরিয়েছেন। কাজ সেরে ফিরতে ফিরতে রাত একটা। এর মধ্যে দিন গেছে পাল্টে। আপনি আর আগের গাড়ি নিয়ে ফিরতে পারবেন না। কারণ পর পর দুই দিন একই নম্বরপ্লেটের গাড়ি নিয়ে ঢাকার রাস্তায় পথচলার নিয়ম নেই। তখন আপনি ওই গাড়িটা কোথাও ফেলে রেখে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বা গণপরিবহনব্যবস্থার সাহায্য নেবেন। (চালাক বাঙালি গাড়ি না বদলে নম্বরপ্লেট দুটো ব্যবহার করার দুই নম্বরি বুদ্ধি বের করে ফেলতে পারে)।
যাঁরা এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, তাঁরা সবাই বিশেষজ্ঞ। আমি তাঁদের অভিনন্দন জানাই। বিদেশে এ ধরনের নিয়মকানুন আছে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রে আছে যে একজনের বেশি যাত্রী থাকলে সেই গাড়িকে ফাস্ট ট্র্যাক দিয়ে চলতে দেওয়া হয়। আমাদের দেশে ফাস্ট ট্র্যাকই বা কই, স্লো ট্র্যাকই বা কই!
জোড়-বিজোড় নম্বরপ্লেটের গাড়ি চলাচলের নিয়মও কোনো কোনো দেশে থেকে থাকতে পারে। কিন্তু সবার আগে দরকার গণপরিবহনব্যবস্থা। সেটা কি ঢাকা শহরে আছে?
ঢাকা থেকে যানজট নিরসনের জন্য আশুকরণীয় পদক্ষেপ কী হতে পারে? ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতার চর্মকারের মতো আমি কিছু নিবেদন করি:
১. ফুটপাতগুলো মানুষের চলাচলের উপযোগী করা। ফুটপাত থেকে দোকানপাট, হকার সরিয়ে দেওয়া। নির্মাণসামগ্রী ইত্যাদি থেকে ফুটপাত বা রাস্তা দখলমুক্ত করা। ফুটপাতের মানুষ ফুটপাতে চলতে পারে না বলে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয় এবং বহু রাস্তা অচল করে রাখে।
২. যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্কিং করতে না দেওয়া। আমাদের রাস্তাগুলো অবৈধ পাকিংয়ের কারণেই অনেক জায়গায় অচল হয়ে থাকে।
৩. বহুসংখ্যক ফুটওভারব্রিজ ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়ে ঢাকা শহরের সর্বত্র নির্মাণ করে দেওয়া। হোটেল সোনারগাঁওয়ের মোড়টা অচল করে রাখে অনেকটাই মানুষের ক্রমাগত রাস্তা পারাপার।
৪. নতুন গাড়ি রাস্তায় নামানো নিরুৎসাহিত করা। অধিক পুরোনো গাড়িগুলো তুলে নেওয়া।
দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ:
১. ঢাকা শহরসহ পুরো বাংলাদেশে যোগাযোগব্যবস্থা সড়কনির্ভর না করে রেলনির্ভর করে গড়ে তোলা। রাস্তা ও গাড়ির সংখ্যাবিষয়ক একটা সূত্র আছে: ‘তোমরা যত পরিমাণেই রাস্তা বাড়াও না কেন, গাড়ির সংখ্যা সব সময়ই রাস্তার ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি হবে।’ কাজেই রেলযোগাযোগই একমাত্র সমাধান। মহানগরের জন্য মেট্রোরেলব্যবস্থা দরকার হবেই। ঢাকা-চট্টগ্রাম যোগাযোগ কেন দ্রুত ও সংক্ষেপিত রেলপথের মাধ্যমে করা হবে না?
২. ঢাকা থেকে মানুষ সরানো। বিকেন্দ্রীকরণ। পোশাকশিল্প কারখানাগুলো ঢাকার বাইরে সরিয়ে নেওয়া হলে অন্তত ৩০ লাখ লোকের ভার কমবে। ঢাকার বাইরে পরিকল্পিত চিকিৎসাশহর, শিক্ষাশহর, বাণিজ্যনগর, আইটিনগর ইত্যাদি গড়ে তোলা।
৩. ঢাকার মোড়ে মোড়ে ছোট ছোট উড়ালসেতু বানিয়ে মোড়গুলো বিরতিহীনভাবে সচল রাখা।
৪. আজ হোক কাল হোক রিকশা তুলে দিতেই হবে এ শহর থেকে। মানুষ একটু হাঁটুক। তাতে স্বাস্থ্য খাতেও ব্যয় কমবে, আর অন্তত ৩০ লাখ মানুষের চাপ থেকে শহরটা বাঁচবে। কিন্তু তাদের বিকল্প পেশা কী হবে, সেটা আমার ঠিক জানা নেই। কিন্তু ব্যবস্থা একটা করতেই হবে।
যা-ই হোক, গদ্যকার্টুন গুরুগম্ভীর তত্ত্বালোচনার জন্য নয়। এটা হালকা কৌতুক পরিবেশনের জন্য। এবার একটা গল্প বলি (অবশ্যই পুরোনো আর এই কলামে অন্তত তিনবার পরিবেশিত)। রাজার প্রাতরাশের থালায় মাছি পড়েছে। রাজা বললেন, ‘আজ আমি কার মুখ দেখে উঠেছি। তার গর্দান নেব। রানির মুখ? ও তো রোজ দেখি। প্রহরীদের মুখ? তাও তো নতুন নয়। আজকে প্রাতর্ভ্রমণে গিয়ে একটা চাষির মুখ দেখেছিলাম। তাকে ধরে আনো আর শূলে চড়াও।’ চাষিকে ধরে আনা হলো। চাষি তখন রাজাকে বলল, ‘মহারাজ, আপনি আমার মুখ দেখেছিলেন বলে আপনার পাতে মাছি পড়েছে। আর আমি আপনার মুখ দেখেছিলাম বলে আজ আমার প্রাণ যাচ্ছে। তাহলে কে বেশি অপয়া?’
ঢাকার যানজটের আরেকটা কারণ হলো ভিভিআইপিদের রাস্তা বন্ধ করে চলাচল। তাঁরা একবার যে পথ দিয়ে যান, তার আগে-পরে দুই ঘণ্টা সেই পথে সবকিছু থমকে থাকে। একই ঘটনা ঘটান জনসভাওয়ালারা। তাঁরা যখন একটা রাস্তা বন্ধ করে সভা করেন, তার ধকল পড়ে পুরো ঢাকার ওপর। এখন বলুন, কারা বেশি অপয়া? ওই রিকশাওয়ালা বা পোশাকশ্রমিকেরা, নাকি ভিভিআইপিরা।
ছোটবেলায় একটা মজার ধাঁধা শুনতাম। ‘ঢাকা আছে খুল না! খুললে কি পাব না?’ এই বাক্য দুটোতে দেশের তিনটা জেলার কথা আছে। বলো। উত্তর: ঢাকা, খুলনা আর পাবনা। আজকে যানজট নিয়ে লিখতে বসে মনে আসছে, ঢাকার যানজটটা খোলার কথা ভাবতে গিয়ে আমরা কি পাবনা যেতে বসেছি?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.