আইএমএফের ঋণ নেওয়ার যৌক্তিকতা কোথায়?-অর্থনীতি যখন চ্যালেঞ্জের মুখে

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দুই বছর অতিক্রম করার পর দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির দিকে আলোকপাত করলে শঙ্কিত হতে হয় বৈকি। কেননা, অর্থনীতির অগ্রগতি এখন অনেকগুলো বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। আর এসব চ্যালেঞ্জ বা প্রতিকূলতা তৈরির পেছনে বহুলাংশে সরকারের ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা দায়ী।


মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে, প্রবাসী-আয়প্রবাহ শ্লথ হয়ে পড়েছে, গ্যাস-বিদ্যুৎ তথা জ্বালানি খাতের সংকট উত্তরণের কোনো লক্ষণ নেই, বিনিয়োগে চলছে মন্দা। এ অবস্থায় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশে উন্নীত করা তো দূরের কথা, সাড়ে ৬ শতাংশের ওপরে নিয়ে যাওয়াটাই কঠিন হয়ে পড়ছে। এ রকম পরিস্থিতিতে সরকার আবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ নেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক।
জ্বালানিসংকট নিরসনের জন্য সরকারের দিক থেকে গত দুই বছরে তেমন বেগবান ও পরিকল্পিত প্রচেষ্টা দৃশ্যমান হয়নি। আর তাই গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে শিল্প খাতের কার্যক্রম খুব জোরালো নয়; বরং ব্যাংক থেকে নেওয়া শিল্পঋণের অর্থ বিভিন্নভাবে পুঁজিবাজারে প্রবেশ করে বাজারের অতস্ফীিতি ঘটিয়েছে। এই স্ফীতি যে টেকসই নয়, ইতিমধ্যে তার আভাসও মিলেছে। সবচেয়ে বড় কথা, শিল্প খাতে বিনিয়োগ ও উৎপাদন না বাড়লে এবং তা অব্যাহত না থাকলে অর্থনীতি এগিয়ে যেতে পারবে না। টেকসই কর্মসংস্থান হবে না। সম্পদ বণ্টনের অসাম্য প্রকটতর হবে। ফলে একটা পর্যায়ে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের এসব দিকে কতটা মনোযোগ আছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কেননা, আইএমএফ থেকে ঋণ নিতেই সরকারকে বেশি আগ্রহী মনে হচ্ছে।
অথচ গত কয়েক বছরে আইএমএফের ঋণ না নিয়ে বাংলাদেশ চলছিল। এমনকি সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আইএমএফের সঙ্গে পলিসি সাপোর্ট ইনস্ট্রুুমেন্ট-বিষয়ক যে চুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, নাগরিক সমাজের আপত্তির মুখে তা আর হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, আইএমএফের ঋণ কখনোই শর্তহীন নয়। অনেক অযৌক্তিক শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ এই ঋণ গ্রহণ শেষ পর্যন্ত কোনো সুফল বয়ে আনবে না। অভিজ্ঞতাও তা-ই বলে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) চলতি সপ্তাহেই দেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি পর্যালোচনা করতে গিয়ে একই অভিমত প্রকাশ করেছে। দুনিয়াজুড়ে যখন এ ধরনের ঋণ কমে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশকে কেন এই ঋণ নিতে হবে, সে প্রশ্নও তুলেছে সংস্থাটি। প্রশ্নটি যৌক্তিক। মনে হচ্ছে, নিজস্ব নীতি-ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে না পারার ব্যর্থতা ঢাকতে সরকার এখন আইএমএফের দ্বারস্থ হচ্ছে। একইভাবে ব্যয়বহুল সরবরাহকারী ঋণের দিকে আগ্রহও যেন প্রবল হয়ে উঠছে। এগুলো ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতিকে বড় ধরনের বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারে। সরকারের বরং উচিত হবে, এসব ঋণের দিকে না গিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে সম্পদ সংগ্রহে মনোযোগ দেওয়া। সে জন্য জরুরি হলো শিল্প খাতকে সমর্থন দেওয়া, পুঁজিবাজারে মূলধনি মুনাফাকে করের আওতায় আনা এবং সার্বিক রাজস্ব আদায়-প্রক্রিয়াকে দক্ষ করা।

No comments

Powered by Blogger.