জব্বারের বলীখেলার মেলা-মেলায়-খেলায় উৎসবের তিন দিন by মিঠুন চৌধুরী

মেলার ভিড়ে হঠাৎ বাঁশির সুর। বেজে ওঠে ‘কইলজার ভিতর গাঁথি রাইখ্যম তোঁয়ারে/ সিনার লগে বাঁধি রাইখ্যম তোঁয়ারে...’। প্রাণের সুর শুনে মেলায় আসা মানুষজন থমকে দাঁড়ান। জানতে চান বাঁশির আদ্যোপান্ত। কেউ কেউ উৎসাহী হয়ে বাঁশি কিনেও নেন।


জানতে চাইলে মো. হোসেন (২০) বলেন, ‘ঢাকার ডেমরা থেকে প্রায় ৪০ হাজার টাকার বাঁশি নিয়ে মেলায় এসেছেন। সঙ্গে বড় ভাই বারেক। ৪০ টাকা থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি করেছেন বিভিন্ন আকারের বাঁশের বাঁশি।’
গতকাল বুধবার দুপুরে জব্বারের বলীখেলা উপলক্ষে আয়োজিত বৈশাখী মেলায় কথা হয় হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘গত চার বছর ধরে এ মেলায় আসি। নিজেদের বাড়িতেই বাঁশি বানাই। বাঁশিতে চাটগাইয়া গানের সুর তুললে মানুষ খুশি হয়। হরতালে প্রথম দুই দিন বিক্রি কম হলেও পরে পুষিয়ে গেছে।’
হোসেনের মতোই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা পণ্য নিয়ে মেলায় অংশ নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। জব্বারের বলীখেলা আর মেলাকে ঘিরে নগরজুড়ে এখন উৎসবের আমেজ। গত মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া মেলা চলবে আজ (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত। নগরবাসীর আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল জব্বারের বলীখেলা।
গতকাল বুধবার দুপুরে স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে মেলায় আসেন শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘জব্বারের বলীখেলা আমাদের ঐতিহ্য। ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে মেলায় আসতাম। আজ ছেলেকে নিয়ে এসেছি। এই শহরে অনেক কিছুই বদলে গেছে। কিন্তু বলীখেলা ও মেলা এখনো আগের মতোই টানে।’
নগরের আন্দরকিল্লা মোড়, লালদিঘীর পাড়, কেসি দে রোড, সিনেমা প্যালেস মোড়, বদরপাতি ও জেল রোডের আশপাশের এলাকায় ফুটপাত ও সড়কের বিশাল অংশজুড়ে বসেছে মেলা। পণ্যের পসরায় দেখা মিলেছে মাটির খেলনা, পুতুল, হাতি-ঘোড়া, তালপাতার পাখা, ফুলের টব, ফুলদানি, হাঁড়ি-পাতিল, পাটি, প্লাস্টিকের খেলনা, মুড়ি, নাড়ু, মোয়া, দেশীয় ফল ও জীবন্ত পশুপাখি।
চাঁদপুরের বাসিন্দা রইস মোহাম্মদ ২০ বছর ধরে মেলায় আসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কুষ্টিয়া থেকে মাটির জিনিস কিনে আনি। টানা ২০ বছর মেলায় আসছি। এখন আমার সাথে আমার ছেলেও এসেছে। আশা করি আট থেকে ১০ হাজার টাকা লাভ হবে।’
কলেজ ফাঁকি দিয়ে মেলায় ঘুরতে এসেছিলেন দুই বান্ধবী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ দুজন বলেন, ‘আমাদের শহরে এত বড় মেলা হবে আর আমরা দেখব না! তাই একটা ক্লাস করেই চলে এসেছি।’
চট্টগ্রামের সিংহভাগ বাসিন্দাই এই মেলায় একবারের জন্য হলেও ঢুঁ মারেন। বছরের প্রয়োজনীয় হাতপাখা, মোড়া, কুলা, পাটি, দা-ছুরিসহ বিভিন্ন গৃহস্থালি সামগ্রী কেনেন এ মেলা থেকেই।
দেওয়ানহাট এলাকার বাসিন্দা গৃহিণী সালমা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারা বছর অপেক্ষায় থাকি কখন এ মেলা শুরু হবে। মনে মনে ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসের তালিকা করতে থাকি। মেলায় ঘুরে ঘুরে সব কিনে নিই।’
শুধু নগর নয়, চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা থেকে মানুষজন মেলায় আসেন। পটিয়ার বাসিন্দা সুরজিত সেন বলেন, ‘মেলার অনেক কিছুই হয়তো বাজারে পাওয়া যায়। কিন্তু মেলা ঘুরেই সেসব পণ্য কেনাটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। বৈশাখ মাস শুরু হলেই অপেক্ষায় থাকি কখন মেলা শুরু হবে।’
বলীখেলাকে ঘিরেও আগ্রহের কমতি ছিল না নগরবাসীর মধ্যে। গতকাল বুধবার সকাল থেকেই মেলার মাঠের চারপাশে ছিল উৎসুক জনতার ভিড়। অনেকে মাঠে ঢুকে এক নজর দেখেছেন কুস্তি প্রতিযোগিতার মঞ্চ। আর বুধবার বিকেলে হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে, ঢাকঢোল বাজিয়ে উৎসবের মেজাজে অনুষ্ঠিত হয়েছে চট্টগ্রামের মল্লযুদ্ধের সেরা আসর।

No comments

Powered by Blogger.