রাজনীতি-গণতন্ত্র সংকোচনের নীতি by মাহবুব উল্লাহ

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের দুই বছর অতিক্রান্ত। মেয়াদ পূর্ণ করলে এই সরকার আরও তিন বছর ক্ষমতায় থাকবে। গত দুই বছরে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বৈদেশিক সম্পর্ক, জনজীবনে শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যে অবনতি ঘটেছে, তা শোধরানো না হলে পরবর্তী তিন বছরে ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হবে।


এমনকি রাষ্ট্র বিপর্যয়ের মতো পরিস্থিতিরও উদ্ভব ঘটতে পারে। বাংলাদেশের সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের একান্ত কামনা, এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যেন নিক্ষিপ্ত না হয়।
দুই বছরের মধ্যে বিগত বছরটি ছিল অত্যন্ত উদ্বেগজনক। রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশের সার্বভৌম অস্তিত্ব প্রচণ্ডভাবে সংকুচিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী দিল্লি সফরে গিয়ে ভারতের সঙ্গে তিনটি চুক্তি সম্পাদন করেছেন এবং ৫০ দফা সম্মত স্মারক ঘোষণা করেছেন। এই চুক্তি তিনটি কী, সে সম্পর্কে দেশের জনগণ কিছুই জানে না। জানতেও দেওয়া হয়নি।
সংবাদপত্র থেকে যেটুকু জানা গেছে, তা থেকে বোঝা যায়, চুক্তিগুলো ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতাসংক্রান্ত চুক্তি। এই চুক্তিগুলো স্বাক্ষরের পর ভারতীয় পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কিছু নেতাকে গ্রেপ্তার করে ভারতের কাছে সমর্পণ করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি অস্বীকার করা হলেও এই নিয়ে দেশবাসীর উদ্বেগ রয়েছে। সরকার এই দিকটি কতটুকু তলিয়ে দেখেছে, সেটাই ভাবার বিষয়। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সরকার বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির বিষয়াবলি জাতীয় সংসদে পেশ করতে বাধ্য। সংবিধান রক্ষার শপথ গ্রহণকারী সরকার এই কর্তব্যটি পালন করেনি। ৫০ দফার সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার এবং বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে করিডর সুবিধা পাবে। বাংলাদেশের সামুদ্রিক নৌবন্দরগুলো আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যেকোনো দেশের বাণিজ্যিক জাহাজের জন্য ব্যবহারযোগ্য। কিন্তু বিশেষভাবে বন্দর উন্মুক্ত করার সুযোগ দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো এটিকে করিডর সুবিধার সঙ্গে সম্পর্কিত করা। ভারতকে করিডর সুবিধা দিলে বাংলাদেশ অচিরেই সিঙ্গাপুরে পরিণত হবে কিংবা বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা উপার্জন করতে পারবে বলে করিডরের ওকালতকারীরা জনগণকে প্রলুব্ধ করতে চেয়েছেন। এখন দেখা যাচ্ছে, ভারত ট্রানজিট ফিও দিতে চাইছে না। তাহলে বাংলাদেশের কী লাভ হলো? ভারতকে করিডর সুবিধা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তুলতে ভারতের কাছ থেকে সাত হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। সুদ ও কমিটমেন্ট ফিসহ এই ঋণের শর্তগুলো অত্যন্ত কঠিন। ভারতের কাছ থেকে অবকাঠামো নির্মাণের উপকরণের ৮৫ শতাংশ ক্রয় করতে হবে। এর ফলে একটি কেপটিক মার্কেট থেকে উপকরণসামগ্রী ক্রয় করতে গিয়ে বাংলাদেশ প্রভূত অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হবে। বাংলাদেশের কৃষি জমি করিডর অবকাঠামোর জন্য চলে যাবে। শোনা যাচ্ছে, ভারতীয় যানবাহন চলাকালীন বাংলাদেশি যানবাহন করিডরের জন্য ব্যবহূত সড়ক ব্যবহার করতে পারবে না। এমনিতেই বাংলাদেশের মহাসড়কগুলোতেও যানজট সৃষ্টি হয়, ভারতের এই শর্তটি পরিপালন করা হলে যানজট পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেবে। ভারতের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ভারতের জন্যই সুবিধা সৃষ্টি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলা হয়, সুযোগ-ব্যয় (Opportunity cost)। সেই বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নিতে হবে। বাংলাদেশের জন্য কাম্য কোনো প্রকল্পে যদি সাত হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হতো, তাহলে বাংলাদেশ অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে সুবিধা পেত, ভারত নির্দেশিত প্রকল্প গ্রহণের ফলে বাংলাদেশ সেই সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হবে। ভারতীয় যানবাহনগুলো বাংলাদেশের ভেতরে জ্বালানি সংগ্রহ করলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ওপরও চাপ সৃষ্টি হবে। কারণ এই জ্বালানিতে রাষ্ট্রার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে আমদানি করা হয়। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে সরকার কার্যক্রম গ্রহণ করছে না। পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ভারতকে করিডরের সুবিধা দিলে অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতিগুলো কী হবে, সেটিরও মূল্যায়ন করা হয়নি। এভাবে দেশের ভালো-মন্দের দিকগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার-বিশ্লেষণ না করে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে বলেই আমাদের ধারণা।
ভারতকে একতরফা সুবিধা দিতে গিয়ে সরকার ভারতের কাছ থেকে সুবিধা আদায় তো দূরের কথা, অসুবিধাগুলো দূর করার কোনো দর-কষাকষি করেছে কি না, সেটাও দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট নয়। ভারত এখন পর্যন্ত বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যের ওপর শুল্ক ও অশুল্ক বাধা অপসারণ করেনি, শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পানির ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছে না। তিস্তার পানি ন্যায্যভাবে বণ্টনেরও কোনো অগ্রগতি নেই। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো আসছে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের তোড়জোড়। এমনকি গোমতী নদীর পানির প্রবাহও ভারত নিয়ন্ত্রণ করছে। বাংলাদেশি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সম্প্রচারও ভারতে সম্ভব হচ্ছে না। সীমান্তে বিএসএফ বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ সম্পর্কে যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, তা রীতিমতো ভয়াবহ। পৃথিবীর কোনো দেশের সীমান্তে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটে না। ভারতকে বেরুবাড়ী হস্তান্তর করা হলেও তিন বিঘা করিডরের বিষয়টি আজও সুরাহা হয়নি। একদিকে কানেকটিভিটির কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে সীমান্তব্যাপী কাঁটাতারের বেড়া ও ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করে বাংলাদেশের সাড়ে ১৬ কোটি মানুষকে অবরোধ করে ফেলা হয়েছে। এসব নিয়ে সরকারের কোনো প্রতিবাদ নেই। উল্লেখ্য, কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে একটি দেশকে অবরোধ করার নীতি অনুসরণ করে প্যালেস্টাইনের গাজার ক্ষেত্রে ইসরায়েল ও মেক্সিকোর ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র। ভারতের সঙ্গে যখন নতজানুনীতি অনুসরণ করা হচ্ছে, পাশাপাশি আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও সেনা পাঠানোর কথা বলেছিলেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। দেশপ্রেমিক নাগরিকদের প্রতিবাদের মুখে বিষয়টি সাময়িকভাবে ধামাচাপা পড়লেও শুধু বৈদেশিক আশীর্বাদে টিকে থাকার জন্য সরকার যেকোনো সময় এই পদক্ষেপ নিতে পারে বলে জনমনে শঙ্কা রয়েছে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ মারাত্মক আন্তর্জাতিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। এটি কোনোক্রমেই কাম্য হতে পারে না।
বিগত বছরটি মূল্যস্ফীতির ফলে জনজীবনে দুঃসহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। বাজারে যাওয়ার আগে ক্রেতার পক্ষে বোঝা কঠিন, কোন জিনিসের কী দাম হাঁকা হবে। সরকারের লক্ষ্য ছিল মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর প্রদত্ত হিসাব অনুযায়ী এই অঙ্ক ৮ শতাংশেরও বেশি। মূল্যস্ফীতিকে বাগে রাখা একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন গভর্নর। বাজার অর্থনীতিতে সরকার বাজারের ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে না বটে, কিন্তু সরকারকে অবশ্যই রেগুলেটরের ভূমিকা নিতে হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, সরকার কোনো টেকসই রেগুলেটরি পলিসি গ্রহণ করতে পারছে না। আমন ফসল ওঠা সত্ত্বেও চালের দাম কমেনি বরং বেড়েছে। এতে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী এবং দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি অবস্থানকারী মানুষের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকার নিরাপত্তাবেষ্টনী দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেও দীর্ঘ মেয়াদে এ ধরনের নিরাপত্তাবেষ্টনী অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। রাজধানীতে ওএমএসের ট্রাকগুলোকে ঘিরে লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। দেশ যে একটি কঠিন খাদ্যসংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে, এটি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রেও অগ্রগতি নেই। বাজার অর্থনীতি অনুসরণকারী একটি দেশে সরকার নিজে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে না। এ জন্য প্রয়োজন ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ। কিন্তু বিদ্যুৎ ও গ্যাস-সংকটের ফলে বিনিয়োগ হচ্ছে না। বিনিয়োগ হচ্ছে না বলে কর্মসংস্থানও হচ্ছে না। কর্মসংস্থান বাড়লে মূল্যস্ফীতি কিছুটা হলেও সহনীয় হয়ে উঠত।
পোশাকশিল্পে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা এই শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। শ্রম অসন্তোষের গভীরে প্রবেশ না করে তা ষড়যন্ত্রই হোক কিংবা ন্যায্য অসন্তোষই হোক, এই সমস্যার সমাধান হবে না। সেদিকে সরকারের কোনো মনোযোগ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের বক্তব্য অনুযায়ী বিদেশি রেমিট্যান্স প্রবাহ এখন নিম্নমুখী। বিদেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি শ্রমিকদের নতুন কোনো নিয়োগ হচ্ছে না। প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীর বহুল ভূষিত আশ্বাস ও আশার বাণীগুলো নিষ্ফল প্রমাণিত হচ্ছে।
বিগত বছরে সরকার একের পর এক নন-ইস্যুকে ইস্যুতে পরিণত করে বিরোধী দলকে ব্যতিব্যস্ত রাখতে চেয়েছে। সংসদ কার্যত অকার্যকর। সংসদে যে ভাষায় নন্দিত নেতাদের চরিত্রহনন করা হচ্ছে, তা নজিরবিহীন। বিরোধী দলকে সংসদে আনারও বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নেই। গত ৩৯ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিরোধী দল সরকারের প্রতি সহযোগিতার কথা বললে সেই বিরল সুযোগ গ্রহণ করেনি সরকার। দমন-পীড়নের পথ বেছে নেওয়াই সরকার শ্রেয় মনে করেছে। সংসদে সরকারের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। কিন্তু এই সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে গঠনমূলকভাবে ব্যবহারের কোনো উদ্যোগ নেই। অন্যদিকে ড. ইউনূসের মতো বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিকে হেয় করতে গিয়ে সরকার নিজেই হেয় হয়েছে। আমাদের জাতীয় গর্বের প্রতীকগুলো একে একে ধ্বংস করা হচ্ছে। মনে রাখা দরকার, গণতন্ত্র মানে সংখ্যালঘিষ্ঠের সম্মতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। গণতন্ত্রের এই গূঢ় অর্থটির প্রতি বারবার অবজ্ঞা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ আজ সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র সংকোচনের সংকটে নিপতিত। দেশবাসী এই সংকট থেকে পরিত্রাণ চায়। চায় ন্যায়বিচার ও সুশাসন।
ড. মাহবুব উল্লাহ: চেয়ারম্যান, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.