গৌরব-অশ্রুত সব কণ্ঠের সুরধ্বনি by মফিদুল হক

ইতিহাসের বিচিত্রগামিতা ও বহুমুখিতা বিবেচনায় নেওয়া ছাড়া ছাত্র ইউনিয়নের ইতিহাস রচনা সার্থকতা পেতে পারে না। কোনো সুখপাঠ্য ইতিহাস নয়, সংগঠিত অনুমোদিত ভাষ্য নয়, নানা শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত হয়ে ওঠা প্রকৃতির রঙ-রূপ-রস তো এই অনন্য ছাত্র গণসংগঠনের সার্থকতার ছবি মেলে ধরে।


সেই বোধ ধারণ করেই হদিস করে ফিরতে হবে ছাত্র ইউনিয়নের অবদান



ছাত্র ইউনিয়ন বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পরিবর্তন ও বিকাশের ইতিহাসের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছাত্র গণসংগঠন। কীভাবে কোন পটভূমিতে গঠিত হয়েছিল এই প্রতিষ্ঠান, কোন তাগিদ থেকে ছাত্রসমাজের মধ্যে এমন এক সংগঠন গড়ার ভাবনা দানা বেঁধেছিল, কী কারণে ছাত্র ইউনিয়ন ব্যাপক ছাত্রসমাজের মধ্যে দৃঢ়মূল হয়ে উঠতে পেরেছিল এবং জাতীয় রাজনীতির বিকাশে তা কোন অবদান রচনা করেছিল সেসব নানা বিশেল্গষণ দাবি করে।
ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে তথ্যমূলক কাজের বড় ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন মোহাম্মদ হাননান। প্রায় একক প্রচেষ্টায় কয়েক খণ্ডে তিনি যে গ্রন্থ রচনা করেছেন তা এ ক্ষেত্রে পথিকৃৎ হয়ে আছে। সম্প্রতি পুরনো বন্ধু মাহফুজউল্লাহ জানিয়েছেন, তিনি ছাত্র ইউনিয়নের দালিলিক ইতিহাস প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করেছেন এবং অচিরেই হাজার পৃষ্ঠার সেই গ্রন্থ প্রকাশিত হবে। দীর্ঘদিনের শ্রম ও নিষ্ঠা নিয়ে মাহফুজউল্লাহ তথ্য সংগ্রহে স্থিত ছিলেন এবং আশা করা যায় তার এই গ্রন্থ ভবিষ্যৎ বিশেল্গষকদের কাছে আকর হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে আকর তো ইতিহাস নয়, ইতিহাস হচ্ছে তথ্যের বিন্যাস, বিশেল্গষণ, পর্যালোচনা ও উপস্থাপন, যেখানে বিশেল্গষক বা ঐতিহাসিকের উদার ও সমগ্র দৃষ্টি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে।
ভাষা আন্দোলন যে ব্যাপক সামাজিক শক্তির পরিচয় মেলে ধরেছিল সেই দীক্ষা গ্রহণ করে প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক ছাত্র গণসংগঠন হিসেবে ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম। বিভিন্ন চিন্তা-চেতনা ও সামাজিক অবস্থান থেকে আগত ছাত্র প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত এই প্রতিষ্ঠানে নানা ধারা-উপধারার মিলন ঘটেছিল কতক সর্বজনীন মৌলিক উপলব্ধির ভিত্তিতে। ইতিপূর্বে মুসলিম লীগের প্রভাবাধীন ছাত্র সংগঠন নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের বাইরে রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির অস্বীকৃতি ঘটিয়ে স্বতন্ত্র সংগঠন হিসেবে জন্ম নিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। নামে প্রায় সমস্বর হলেও কার্যক্রমে তা ছিল মুসলিম লীগের নবাববাড়ি-কেন্দ্রিক নেতৃত্বের বিপরীতমুখী সংগঠন। অন্যদিকে কমিউনিস্ট পার্টি প্রভাবিত ছাত্র ফেডারেশন নবগঠিত পাকিস্তানে শাসকগোষ্ঠীর চরম নিপীড়নের কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ প্রায় হারাতে বসেছিল। দুশ' বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে যে নতুন অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল উপমহাদেশে, তাতে নানা সীমাবদ্ধতা ও জটিলতা ছিল, কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে যে বিচক্ষণ রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ ছিল জরুরি তা অস্বীকার করে সশস্ত্র বিপল্গবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের হঠকারী ডাক দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি চরম বিপদের মধ্যে সদস্যদের ফেলে দেয়। এর ফলে শাসকগোষ্ঠীর নেমে আসা পীড়নে পার্টির ভগ্নদশা ঘটে, ছত্রখান হয়ে পড়ে দলের সমর্থক গোষ্ঠী। ছাত্র ফেডারেশনের কাজের ক্ষেত্র একেবারে সংকুচিত হয়ে যায়। তদুপরি ১৯৫০ সালের দাঙ্গা এবং সংখ্যালঘু বিতাড়ন পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে। ক্রমান্বয়ে পূর্ব বাংলা থেকে হারিয়ে যায় ছাত্র ফেডারেশন নামের অমন শক্তিশালী সংগঠন, তবে হারিয়ে গেলেও একেবারে মুছে যায় না।
দেশভাগ-পরবর্তী সংকট থেকে উত্তরণের দিশা জাতি খুঁজে পায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে এবং ভাষা আন্দোলনের পরপর জন্ম নেয় ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশনের পিছুটান মোচন করে নতুন ধারার সংগঠন, প্রগতিশীলতার সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনার সম্পৃক্তি যেখানে পেয়েছিল বিশেষ গুরুত্ব। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় ইতিহাসের উপাদান আহরণে সদাব্রতী তাজুল মোহাম্মদের উপলব্ধি। তিনি আমাকে বলেছিলেন সিলেটের তারা মিয়ার কথা। মুসলিম ছাত্রলীগের এই অগ্রণী সদস্য ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন গঠনের অন্যতম প্রস্তাবক। তার সাদামাটা অথচ তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য ছিল, আমার হিন্দু বন্ধু করবে ছাত্র ফেডারেশন, আমি করব মুসলিম ছাত্রলীগ, অথচ দরকার এমন সংগঠন যেখানে আমাদের পারস্পরিক মিলন ঘটবে। এহেন উপলব্ধি থেকে জন্ম নিয়েছিল ছাত্র ইউনিয়ন, জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে ভূমিকা পালনের উপাদান যা যাত্রাকালেই আহরণ করেছিল, যে উপাদানের তাত্তি্বক স্বীকৃতি প্রদানে নেতৃত্ব তত পারগ না হলেও জীবন-বাস্তবতা ছাত্র ইউনিয়নকে সংগঠন হিসেবে করে
তুলেছিল তাৎপর্যময়।
ইতিহাসের বিচিত্রগামিতা ও বহুমুখিতা বিবেচনায় নেওয়া ছাড়া ছাত্র ইউনিয়নের ইতিহাস রচনা সার্থকতা পেতে পারে না। কোনো সুখপাঠ্য ইতিহাস নয়, সংগঠিত অনুমোদিত ভাষ্য নয়, নানা শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত হয়ে ওঠা প্রকৃতির রঙ-রূপ-রস তো এই অনন্য ছাত্র গণসংগঠনের সার্থকতার ছবি মেলে ধরে। সেই বোধ ধারণ করেই হদিস করে ফিরতে হবে ছাত্র ইউনিয়নের অবদান। উদাহরণত উল্লেখ করা যায় ১৯৬১ সালের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদযাপনের ইতিকথা। আইয়ুব খানের লৌহকঠিন সামরিক শাসনে পদানত দেশে তখন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের কোনো অধিকার ছিল না, বাকস্বাধীনতা ছিল অস্বীকৃত এবং শাসকগোষ্ঠী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিহ্নিত করেছিল পাকিস্তানের মতাদর্শের বিরোধী ভারতীয় 'হিন্দু' কবি হিসেবে, যার জন্মশতবর্ষ পাকভূমি পাকিস্তানে পালিত হতে পারে না। এর বিপরীতে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক কর্মীদের উদ্যোগ ব্যাপক সামাজিক রূপ অর্জন করে এবং ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, ময়মনসিংহসহ নানা স্থানে সাড়ম্বরে পালিত হয় রবীন্দ্র জন্মোৎসব। ঢাকায় ব্যাপকভিত্তিক একাধিক জাতীয় কমিটি গঠিত হয়, যার একটির নেতৃত্বে ছিলেন সুফিয়া কামাল, অন্যটির বিচারপতি এসএম মুর্শেদ। দুই সংগঠনের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা প্রতিযোগিতা ছিল না, ছিল বহুতর আকুতিকে গতিমুখ দেওয়ার সহযাত্রী প্রয়াস। সুফিয়া কামালের পৌরোহিত্যে গঠিত কমিটির সদস্যরা পরে ছায়ানট গঠন করে নবআবিষ্কৃত সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তিকে স্থায়ী রূপদান করেন এবং ছায়ানট ক্রমান্বয়ে যে মহীরুহে পরিণত হয়, সে আরেক ইতিহাস। ছায়ানটের উদ্যোগের সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের নবীন কর্মীদের সম্পৃক্তি উভয়ের জন্য হয়েছিল সহায়ক। সেই সম্পৃক্তি নিয়ে অনেক কথা বলা হয়ে থাকে, বাগাড়ম্বর প্রকাশের তাগিদও দুর্লক্ষ্য নয়, তবে যা অবহেলিত ও বিস্মৃত হয়ে আছে সেটা রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদযাপনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসুর উদ্যোগে আয়োজিত ছাত্রসমাজের বিশাল কর্মকাণ্ড। কার্জন হলে অনুষ্ঠিত তিন দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা ছিলেন ডাকসুতে নির্বাচিত সহ-সভাপতি ছাত্র ইউনিয়নের আমিনুল ইসলাম তুলা। এ ক্ষেত্রে ছাত্র ইউনিয়নের ভূমিকা আলাদাভাবে উল্লেখের দাবি রাখে অথচ উল্লেখ তো দূরের কথা, সামান্য পাদটীকা হিসেবেও সেই অবদানের স্থান আমরা দেখি না। এ ঘটনার প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন অগ্রজ কাজী আজিজুল হক, আমাদের কাজী ভাই, পরমাণু বিজ্ঞানী হিসেবে দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী। নেতৃত্বে তিনি হয়তো ছিলেন না, কিন্তু ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস তাকে ছাড়া পরিপূর্ণতা পেতে পারে না। পরবর্তী বছর ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের বেগম জাহান আরা এবং তিনি ও আমিনুল ইসলাম তুলা পরস্পর বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিলেন। ইতিহাসের এক বিশেষ মুহূর্তে তারা ঝলসে উঠেছিলেন, ছাত্র ইউনিয়নের পতাকাবাহক হয়ে ইতিহাসের দায় মোচন করেছিলেন, তারপর সেই পতাকাবাহী হয়েছে আরও কত তরুণ-তরুণী। কিন্তু একদা কোনো এক বিশেষ সময়ে যাঁরা হয়েছিলেন ইতিহাসের পথযাত্রী তাদের হদিস করা ছাড়া আমরা বুঝতে সক্ষম হবো না অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ছাত্র গণসংগঠন হিসেবে ছাত্র ইউনিয়নের ভূমিকা।
যখন আমি ভাবি ছাত্র ইউনিয়নের কথা, কত শত মুখ ভেসে ওঠে মানসপটে। তারা কেউ ঢাকায়, মিছিলের একজনরূপে রাজপথে পদস্বাক্ষর রেখেছেন, কর্মী হিসেবে ৩১/১ হোসেনি দালানের দীনতাময় অথচ শ্রীমণ্ডিত দফতরের সব দাবি মিটিয়েছেন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে টগবগ করে ফুটে উঠেছেন, এরপর পাকিস্তানি বাহিনী সৃষ্ট রক্তগঙ্গায় ভাসতে ভাসতে যেখানে স্থিত হয়েছেন সেখানেই সক্রিয় হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। আরও অনেক তরুণের কথা মনে পড়ে, দূর মফস্বলে তারা হয়তো পড়ে আছেন কিন্তু স্বপ্নের বুনটে ধারণ করেন অগ্রসর এক পৃথিবী। তাদের সদাকাঙ্ক্ষার অতল খুঁজে পাওয়া ভার, জীবনের শত বঞ্চনার মধ্যেও স্বপ্নতাড়না তাদের ফুরোয় না, কোথা থেকে আহরণ করেন এত শক্তি কে জানে। আমি বুঝি, আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বাইরে আগেও ছিলেন অগণিত তরুণ এই পথের যাত্রী, পরেও এসেছেন আরও অনেকে। জীবনের চাপে তারা হয়তো ক্রমান্বয়ে হারিয়ে গেছেন, কোনো স্বীকৃতি তো তাদের মেলেনি, তার প্রত্যাশাও তারা কখনও করেননি, কিন্তু তারা তো ইতিহাস থেকে মুছে যাওয়ার নন।
ছাত্র সংগঠনের অবস্থান থেকে জাতীয় বিকাশের ক্ষেত্রে যে বহুমুখী অবদান রেখেছে ছাত্র ইউনিয়ন, তার প্রকৃত মূল্যায়ন কখনোই গণ্ডিবদ্ধ নীরক্ত তত্ত্বভাবনা দিয়ে করে ওঠা যাবে না। কেননা ছাত্র ইউনিয়ন বিশাল গণসংগঠনের রূপ নিয়ে বহু চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির যেমন সমন্বয় ও সংহতি ঘটিয়েছে, তেমনি তাকে এক সৃজনী গতিমুখও প্রদান করেছে। হাজারো ঘটনায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে ছাত্র ইউনিয়নের পথচলার ইতিহাস, আছে হাজারো নবীন-নবীনার কত বিচিত্র ও বহুমুখী অবদান। তাদের সবার কথা জানা, বোঝা ও তার স্বরূপ উপলব্ধির মধ্য দিয়েই আমরা জানতে পারব কীভাবে এমন ব্যতিক্রমী ও প্রভাবশালী সংগঠন হয়ে উঠতে পেরেছিল ছাত্র ইউনিয়ন।
পথ ভাবতে পারে আমি দেব, রথ ভাববে আমিই দেব, কিন্তু অন্তর্যামী জানেন কত বহুমুখী সাধনা ও সাধকের সম্মিলনে জন্ম নিয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন, অকীর্তিত অস্বীকৃত সেসব মানুষের কথা জানানোর জন্য এখনও আমরা রয়েছি কান পেতে।

মফিদুল হক :ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

No comments

Powered by Blogger.