গল্প বিক্রেতার খাতা by পাবলো শাহী

বশ্যই, মানসিক গঠনের দিক থেকে যারা জীবসত্তাকে মর্যাদা দিতে পেরেছে বলে মনে করে, আমি তাদেরই একজন; এটা দৈহিক গঠনগত মনুষ্য প্রাণী হিসেবে আমার বড় পরিচয়। একটা সংস্কৃতির পূর্ণ পরিণতি ঘটে যেসব মানুষের মধ্যে, তাঁদের কেবল শিল্পী আখ্যা দেওয়া চলে। তার জীবসত্তার মধ্যে যুগ ও সমাজ দীর্ঘায়িত হয়, ফলে সাহিত্য ও দর্শন কী অনন্তর এষণা_এ কথা আমি ভাবি।
আমার স্ত্রী বলে, 'পৃথিবীর ধর্মতত্ত্ব, ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা, বিবাহের তীরধনু আর আধুনিক রাইফেল_সব কিছুই নারীর দিকে তাক করা, নারীর ভ্রূণ নিয়ে ছেলেখেলা; নিরন্তর করুণ কৌতুক। অপসৃয়মাণ পুরুষ এই লণ্ঠনের বীজ বপন করে উদীয়মান পুরুষের জীবকোষের মধ্যে।
এসব ভাবতে ভাবতে আমার স্ত্রী বলে, 'আমাদের জীবনের সবচেয়ে হীন কার্যকরণটা কী?'
আমি বলি, 'প্রবঞ্চিত অবস্থার মধ্যে বাস করা।'
'তাহলে মুহাম্মদ, রুশো, তলস্তয় ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ চেয়েছেন এ জন্য যে পুরুষরা নারীকে সম্পত্তি মনে করে।'
আমি বললাম, 'হয়তো, সত্যকে গোপন করে মিথ্যাচারকে সঙ্গী করলে যা হয়, তাইতো একটা পুরুষের বক্ষপীড়া হয়ে ওঠে।'
আমার স্ত্রী বলল, 'তার মানে বল প্রয়োগ করে পুরুষরা সুখী হতে চায়।'
আমি বললাম, 'কিন্তু বহুগামিতা তো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।'
'তা ঠিক, এ কথার আইনি ফাঁকে পুরুষ নারীকে দখল করে অথবা বিবাহিত ধর্ষণকে আইনি রূপ দেয়।'
এ রকম তর্ক আর খুনসুটি আমাদের চলে সকাল-সন্ধ্যা। আসল বিষয়কে পাশ কাটানোর জন্য আমি বলি, 'মানুষের সব কিছুর মধ্যে মনটা চিন্তাপূর্ণ; হয়তো মৃত্যু-আতঙ্ক মানুষকে ধর্ম বানাতে সাহায্য করেছিল।'
এসব কথার মধ্যে একটা বাদামের গন্ধ আমাদের বক্ষের এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত ঢেউ খেলে যাচ্ছিল। আমার স্ত্রীর রক্তিম ঠোঁট থেকে যে শব্দ উচ্চারিত হচ্ছিল, আমি তার ভেতরে বোতলের ছিপির মতো পাক খাচ্ছিলাম। এত কিছুর পরও জীবনটা নিজের মতো করে ভালোমতোই কাটছিল আমার। কিন্তু বেশ কয়েক বছর পরের কথা। বিবাহিত জীবনে পা রেখে রোমান্সের পেছনের বনের ঢাল বেয়ে হেঁটে হেঁটে যখন আমি কর্কট নারীর কাছে গল্প শুনতে যাই, তখন জীবন অন্য রকম মনে হয়। যেন নুন দিয়ে তুলসী চা খাওয়ার মতো, স্বপ্নের ঘ্রাণশক্তি পুরোপুরি চেখে দেখার সুযোগ হয়। ছোটবেলা থেকে আমি জ্যোতিষচর্চা নয়, সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম। সেটাকে এখন আবিষ্কার করি বন্ধু-স্বজনদের মধ্যে। কিন্তু আমার স্ত্রীর রজঃস্রাবের মধ্যে যে রহস্য আছে, তা কখনো সংখ্যাতত্ত্ব সূত্রে বলতে পারিনি আমি। তা ছাড়া আরো অনেক সহজ বিষয় জটিল মনে হয় আমার।
আমার স্ত্রী বলে, 'টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের চটপটে অর্থহীন ভাষাগুলো শিখে নিতে পারো তুমি।'
আমি বলি, 'এগুলো আমার গল্পের বিষয়ও নয়, নাটকীয় ডায়ালগের ভাষাও নয়।'
'তা ঠিক, তুমি যে গল্পের নামে খাতাগুলো কালো কালো পাথরের লিপি দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছ, তার ওজন অনেক, তবে তা নিষ্প্রাণ, হয়তো বিজ্ঞাপনের ভাষা তোমাকে তা থেকে মুক্তি দিতে পারে।'...
পাঠকের আর ধৈর্যচ্যুতি না ঘটিয়ে লিখতে লিখতে আমার পরিচয়টা তুলে ধরা যাক। আমি গল্প লেখক হতে চেয়েছিলাম। ভাষা ঘনসংবদ্ধ করে, জীবনবোধকে পরিতাপ ও পরিহাসের সঙ্গে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার জীবনপাঠ মানুষের মহিমাকে হাজির করতে পারেনি কিংবা ক্ষুণ্ন করেনি বেদনার উৎসারণকে। ফলে যে পরিহাসের পরিমিতি আমি গল্পে নির্মাণ করতে চেয়েছিলাম, তার কৃশকায় শব্দমালা আমার ডায়েরির পাতা ঘিরে আছে। আমার স্ত্রী জানে সে কথা। সে বলে, 'পাবলো, যে যা ভাবুক, আমি তোমাকে ভালোবাসি।'
ফলে তার দিকে লক্ষ রেখে একটি আত্মজীবনীমূলক কথামালা বিবেচনা করে_গল্প বিক্রেতার খাতা ভরিয়ে তুলতে চেয়েছি। তার কথা ও ইতিহাসের ক্ষমতা_এই দুয়ের মাঝখানে সংশয়কালে আমার অবস্থান। এসব কারণে জীবনের যা কিছু অলীক ও অগোছালো, তার তালিকা আমার গল্পের খাতায় ভরে আছে। কিন্তু আমার স্ত্রী আবিষ্কার করেছে আমার লেখার মূল গোলকধাঁধা_বাঘ, আয়না, ছোরা, নিদ্রা, মুখোশ, রজঃস্রাব_শব্দগুলোর মধ্যে লুক্কায়িত। শুধু তা-ই নয়, এই শব্দগুলোর বিশেষণ ও ক্রিয়াপদের এক স্বকীয় ভাবনা নাকি আমার গল্পকে তার বুকের ধড়ফড়ানি বাড়িয়ে দেয়।
আমার স্ত্রী বলে, 'বুদ্ধিজীবী ও বামপন্থীদের তত্ত্ব ও আদর্শ আজ কেবল পরিহাসের বিষয়।
আমি বলি, 'পৃথিবীর সব মহাবিপ্লবকেই পরাজিত মতবাদের পক্ষে অবস্থান নিতে দেখেছি আমরা।'
সে বলে, 'তুমি কী পারো না আদি পৃথিবীর ক্ষতগুলোর দায়ভার নিতে?'
আমি বলি, 'গল্পের নামে আত্মজীবনী লিখতে এসে আমি কি একেবারে শূন্য কলসির বাজনা হয়ে উঠেছি, ন্যায়বোধসম্পন্ন ইতিহাস কি আমার প্রগতিশীল চিন্তা বা গল্পে উঠে আসেনি?'
সে বলে, 'পৃথিবীতে যত আছে জল্লাদে কুঠার, পেশাদার জুয়াচোরের তিন তাস, জাদুকরের ব্ল্যাক আর্ট_তা তোমার গল্পকে প্রস্তুত করেছে কতখানি।'
সে আরো বলে, 'আমি গোড়া পিউরিটানের মতো আত্মসমর্পণ করতে চাই না, শরীরী প্রলোভন পরিহার করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তবু তোমার লেখার অদৃশ্য সম্মোহনের মধ্যে আমি পৃথিবীর প্রবঞ্চনাকে দেখতে চাই।'
সে আরো বলে, 'আমেরিকা যে ব্যভিচারী অনুভূতি নির্মাণ করেছে পৃথিবীতে।' যেমন_ইথিওপিয়া, যা মুহাম্মদের আমলে ছিল স্বর্ণোজ্জ্বল আবিসিনিয়া, তার উপজাতি নিরন্ন সম্প্রদায়কে নিয়ে সোনা উত্তোলন করে মিশেল ওবামার গয়না বানাচ্ছে তারা। বয়ঃসন্ধিকালেও এসব উপজাতি নারী নেংটি আর পুরুষ কোনো পোশাক পায় না পরতে। আর কুকুরের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমেরিকানরা এদের সঙ্গে সারছে সব কিছু। এমন সমাজ বানিয়েছে এখানে, ডাকলেই খেলার সঙ্গী হয়ে ওঠে এরা। তোমার মার্জিত রুচি ও মধ্যবিত্তসুলভ আত্মসম্মান_এগুলোকে গল্পের বিষয় করে না।
আমি আমার স্ত্রীর এই চিন্তাকে দেখতে পাই পৃথিবীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছোরাযোদ্ধার মতো। ফলে গল্পের মধ্যে যে অধিবিদ্যা আমি রচনা করি, তা নির্ভেজাল কল্পনায় পরিণত হয়েছে মাত্র।
আমার স্ত্রী বলল, 'এই হীনম্মন্যতাবোধের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করো। আর এই পৃথিবী গোলার্ধে বিস্তৃত করো প্রাচ্যের বেদনাময় কিংবদন্তি।'
তার পর থেকে আমার খাতায় গল্পের বদলে যা লেখা হয়েছে, তা আমাদের নিমগ্নতা ও ব্যক্তিগত ভূগোলকে একটা দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে পরিশোধিত করে ভাষায় রূপ দেওয়া।
আমার স্ত্রী আরো বলে, 'তোমার শব্দের তাপ ও সংগীত ইতিহাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ।'
আমি বললাম, 'মানুষের পক্ষে তত্ত্বকে শরীর, যৌনতা আর আত্মহত্যা থেকে আলাদা করা কঠিন। জগৎটা এক অসাধারণ তত্ত্ব দ্বারা নির্মিত। হয়তো, সে নির্মাতা মানুষ_শিল্প তাই ইন্টেলেকচুয়াল ডিসকোর্স।'
তারপর আমরা তত্ত্বে অপ্রয়োজনীয় পোশাক চড়ানো অবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত করলাম। সে বলল, 'তোমার চিন্তায় একটা বৌদ্ধিক দূরত্ব আছে, যা আমি স্পর্শ করতে পারিনি।'
আমি বললাম, 'জীবন তো অভিজ্ঞতার পুনর্গঠন।' আমি আরো বললাম, 'জীবন তো ছোরা, অপরাধ, নির্যাতন আর আত্মজীবনীতে ভরা।'
সে বলল, 'তোমাকে জাদুকর, অমর ও পণ্ডিত_এর চেয়ে বেশি কিছু মনে হয় না।'
আমি তার কথার চিহ্নকে খুঁজতে থাকি। কাল্পনিক জগতে বাঘ আর ছোরার মধ্যে মিল খুঁজে পাই।
আমি বলি, 'জীবনটা অলীক বলে আমাদের সব সময় অস্বাভাবিক ঘটনা ও দায়িত্বহীন জগৎকে প্রত্যাখ্যান করতে শিখতে হবে।'

No comments

Powered by Blogger.