কালের পুরাণ-শেয়ারবাজারে হচ্ছেটা কী by সোহরাব হাসান

রকারের মেয়াদ দুই বছর বাকি থাকতেই নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন নেতা-নেত্রীরা। গত মঙ্গলবার মানিকগঞ্জে জনসভা করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। একই দিন তিস্তা অভিমুখে লংমার্চ শেষে নীলফামারীতে জনসভা করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।


১৯ জানুয়ারি জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকীতে ঢাকায় এক শিক্ষক সমাবেশে ভাষণ দেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনজনের কণ্ঠেই ছিল নির্বাচনী সুর।
মানিকগঞ্জের জনসভায় শেখ হাসিনা উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচনে তাঁরা ক্ষমতায় আসতে না পারলে আওয়ামী লীগ-সূচিত উন্নয়নের ধারা ব্যাহত হবে।’
নীলফামারীতে এরশাদ বলেছেন, বড় দুই দল দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছে। অতএব, আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি সৈনিক ছিলাম। আমি জানি, কখন অ্যাকশন নিতে হয়।’ অবশ্য এরশাদ কার বিরুদ্ধে, কখন অ্যাকশন নেবেন, সে সম্পর্কে খোলাসা করে কিছু বলেননি। তবে দিল্লি থেকে ফিরে এরশাদের তিস্তা ও টিপাইমুখ অভিমুখে লংমার্চের উদ্দেশ্য নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন।
আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এরশাদ এখন নানা হিসাব-নিকাশ করছেন। দলের একাংশ চাইছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্য অটুট থাকুক। আরেক অংশ মনে করছে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সুবিধা করতে পারবে না। অতএব বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধাই হবে উত্তম। অন্যদিকে দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি না হতে পারার মনোবেদনা এরশাদ বিরোধী দলের নেতা হয়ে পুষিয়ে নিতে চাইছেন। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলে এরশাদের জন্য তা সুবর্ণ সুযোগ হয়ে দেখা দিতে পারে। এরশাদ কোনো বিকল্পই বাদ দিতে চাইছেন না।
এবার আসি বিএনপির নেত্রীর কথায়। খালেদা জিয়া বরাবর এককথার মানুষ। তিনি এরশাদের সঙ্গে আপস করেননি, কিন্তু আপস করেছেন মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে, জঙ্গিবাদ, বোমাবাজদের সঙ্গে। তাঁর দলের অনেকেই এখন জঙ্গিবাদের তোষণকারী হিসেবে পরিচিত। জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করলেও কখনো মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের সঙ্গে আপস করেননি। কিন্তু খালেদা জিয়া এখন করছেন।
জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকীতে শিক্ষকদের এক সমাবেশে বিএনপির চেয়ারপারসন বলেছেন, জনগণের সমর্থন নিয়ে ভবিষ্যতে তাঁরা সরকার গঠন করতে পারলে বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ করা হবে। বেসরকারি শিক্ষকদের বেতনের শতভাগ সরকারি কোষাগার থেকে দেওয়া আর চাকরি জাতীয়করণ এক নয়—এ কথা নিশ্চয়ই তিনবারের প্রধানমন্ত্রীর অজানা নয়। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো ছাড়া সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা সব শ্রেণীর শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ করা হয়নি। খালেদা জিয়ার ঘোষণা বাস্তবায়ন করা হলে কেবল বেসরকারি প্রাথমিক বা মাধ্যমিক নয়, সর্বস্তরের শিক্ষকেরাই জাতীয়করণের আওতায় আসবেন।
বিএনপির চেয়ারপারসন যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা বাস্তবায়নের সামর্থ্য এ দেশের মানুষের আছে কি না, তা কখনো ভেবে দেখেছেন? না নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য জনগণের হাতে ছেলে-ভোলানো মোয়া তুলে দিতে চাইছেন তিনি। নির্বাচনের আগে এ রকম ছেলে-ভোলানো মোয়া অনেক দেখা যাবে। দুই দলের নেতা-নেত্রীরা মনপ্রাণ উজাড় করে জনগণকে প্রতিশ্রুতি দেবেন। নির্বাচনের পর সেই প্রতিশ্রুতি অবলীলায় ভাঙবেন। আবার প্রতিশ্রতি দেবেন। আবার ভাঙবেন। গণতন্ত্রের এই মহড়াই চলে আসছে ৪০ বছর ধরে।
এর আগে দুই নেত্রী প্রকৌশলীদের সম্মেলনের উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠানে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতেও নির্বাচনী আমেজ ছিল। শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রকৌশলীদের হাত দিয়েই যেহেতু উন্নয়ন প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ কাজ হয়, সেহেতু তাঁদের আরও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। খালেদা জিয়া বলেছেন, বর্তমান সরকারের আমলে রেন্টাল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে মহা দুর্নীতি হয়েছে। ভবিষ্যতে তাঁর দল ক্ষমতায় এলে সব দুর্নীতির বিচার হবে। দুই নেত্রী যাঁদের উদ্দেশে কথাগুলো বলেছেন, তাঁরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। প্রকৌশলীরা মিলেমিশে দুই নেত্রীকে তাঁদের সম্মেলনে আনতে পারলেও সাংবাদিকেরা পারেন না। তাঁদের এক পক্ষ এক নেত্রীর নামে জিন্দাবাদ দিলে অন্য পক্ষ মুর্দাবাদ দেয়।

২.
কিছুদিন ধরেই সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচি ও পদক্ষেপে চরম অস্থিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সকালে এক হুকুম দেয় তো রাতে তা বাতিল করে। আগের দিনের আদেশপত্র পরের দিন অলৌকিকভাবে প্রত্যাহার হয়ে যায়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বা সিএমএলএকে মানুষ ঠাট্টা করে বলত ‘ক্যানসেল মাই লাস্ট অ্যানাউন্সমেন্ট।’ এখন শেখ হাসিনার সরকারকেও সেই অস্থিরতায় পেয়ে বসেছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার প্রথম বছরে অর্থনীতির গতি চাঙা করতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তার বেশির ভাগই এখন পরিত্যক্ত। শিল্পের প্রসারে ব্যাংক ঋণের সুদের হার কম হওয়ার পক্ষে নানা যুক্তি দেখানো হয়েছিল। ব্যাংকগুলোর সুদের হার বেঁধে দিয়ে বলা হলো, ‘এর বেশি সুদ কেউ নিতে পারবে না।’ দ্বিতীয় বছরে সুদের হার আরও কমানো হলো। এমনকি অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীদের একমাত্র সম্বল সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপরও সরকার ভাগ বসাল। সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হলো। উৎসে কর কাটা হলো। অন্যদিকে বড় বড় ঋণখেলাপির টিকিটিও সরকার ধরতে পারল না। রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে কিছুদিন বেশ হইচই চলল। সংসদে আইন পাস করে বলা হলো, ‘এর বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না।’ রেন্টাল বিদ্যুতের জন্য বিদেশ থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করা হলো। ভর্তুকি সামাল দিতে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে প্রচুর ঋণ নিল। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। এরপর সরকার ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়িয়ে দিল। সরকারের পক্ষ থেকে এখন বলা হচ্ছে, নতুন রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কয়লা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রাখা হবে। গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে আসছে। তাহলে কীভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে? সরকার সে সম্পর্কে কিছু বলছে না। ২০২১ সালের রূপকল্প কি ২০১২ সালেই শেষ হয়ে যাচ্ছে?
সরকারের অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনায় যে চরম অস্থিরতা রয়েছে, তার সর্বশেষ নজির শেয়ারবাজার। এর আগে বলা হয়েছিল, শেয়ারবাজারে কেউ বিনিয়োগ করলে উৎস জানতে চাওয়া হবে না। ১০ শতাংশ হারে আয়কর দিলেই সবকিছু মাফ হয়ে যাবে। কিন্তু এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিং (এপিজি) আপত্তি জানিয়ে বলল, ‘এভাবে অবৈধ অর্থের লেনদেন চলতে পারে না। অর্জিত অর্থ কোথা থেকে এসেছে, তা তাদের জানা দরকার।’ এরপর এনবিআর তখন আগের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বলল, অন্য কোনো সংস্থা তাদের আইনে প্রশ্ন করতে পারবে। এনবিআর আয়কর আইনে প্রশ্ন করবে না।
শেয়ারবাজার নিয়ে গত সোমবার থেকে বুধবারের ঘটনাপ্রবাহ আরও চমকপ্রদ। আরও নাটকীয়। সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ জানান, ‘১৯৭৯ সালের আইন অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তারা সঞ্চয়পত্র ছাড়া অন্য কোনো ব্যবসায়িক কাজে যুক্ত হতে পারেন না।’
বুধবারের প্রথম আলোর খবর: ‘শেয়ারবাজারের অস্থিরতায় আবার বন্ধ হলো লেনদেন। গতকাল মঙ্গলবার দুই স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালনা পর্ষদ লেনদেন বন্ধ করে দেয়। লেনদেন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে বিষয়টি বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (এসইসি) অবহিত করা হয়। কালোটাকা বিনিয়োগ নিয়ে কয়েক দিন ধরে বাজারে দরপতন চলছিল। আর গত সোমবার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শেয়ারে বিনিয়োগ নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আতঙ্ক ছড়ালে গতকাল লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হয়।’
বৈঠক শেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ডিএসইর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের (সামরিক-বেসামরিক) পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে অস্পষ্টতা প্রতীয়মান হয়েছে।’ মোশাররফ হোসেন আরও বলেন, ডিএসই মনে করে, দেশের অর্থনীতি তথা পুঁজিবাজারের স্বার্থে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের (সামরিক ও বেসামরিক) পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ থাকা উচিত।
সরকারের পরস্পরবিরোধী ঘোষণা তখনই এল, যখন শেয়ারবাজারে চরম অস্থিরতা চলছে, যখন খুদে বিনিয়োগকারীরা রাজপথে বিক্ষোভ করছেন, যখন নেপথ্য কুশীলবেরা শেয়ারবাজার নিয়ে নানা খেলা খেলছেন।
প্রথম আলোর খবরে আরও বলা হয়: ‘এ ঘটনার পর শেয়ারবাজারে পতন অবশ্যম্ভাবী চিন্তা করে দুই স্টক এক্সচেঞ্জ মঙ্গলবার বাজারে লেনদেন বন্ধ করে দেয়। পরের দিন এসইসির চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেন জানালেন, ‘মন্ত্রিসভায় সরকারি কর্মকর্তাদের বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা হলেও সিদ্ধান্ত হয়নি।’ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে তাঁর বক্তব্য প্রচারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জনপ্রশাসন সচিবের বরাতে একটি পরিপত্র পাঠানো হয় বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে। যাতে বলা হয়: ‘ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, এক শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ফটকা কারবারের বিনিয়োগে অংশগ্রহণ করছেন। এ ধরনের বিনিয়োগ উক্ত বিধিমালা দ্বারা আরোপিত বিধিনিষেধের লঙ্ঘন। এছাড়াও বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোন কর্মচারীর ব্যবসায় জড়িত হওয়া আচরণ বিধির পরিপন্থি।’
এর দুই-আড়াই ঘণ্টা পর রাত আটটায় সরকারের তথ্য দপ্তর থেকে পাঠানো তথ্য বিবরণীতে আগের পরিপত্রটি প্রত্যাহারের কথা বলা হয়।
এতে কী প্রমাণিত হয়? প্রমাণিত হয় দেশটি শেখ হাসিনা চালালেও শেয়ারবাজারের মা-বাপ নেই। এখানে সকালে এক সিদ্ধান্ত হয়, বিকেলে আরেক সিদ্ধান্ত। এতে প্রমাণিত হয়, শেয়ারবাজারের অস্থিরতার পিছনে নীতিনির্ধারকদের তুঘলকি কর্মকাণ্ডই অনেকাংশই দায়ী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শেয়ারবাজারে অর্থের অভাব নেই, আস্থার অভাব আছে। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্ত বারবার পরিবর্তিত হলে বিনিয়োগকারীরা কীভাবে আস্থা ফিরে পাবেন? শেয়ারবাজারে সরকারের ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে মনে হচ্ছে, এতে সেই কুশীলবেরা কলকাঠি নাড়ছেন, যাঁরা এখান থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন; আদালতের কাঠগড়ায় যাঁদের দাঁড়ানো কথা, তাঁরাই হাকিম সেজে বসে আছেন।
এখনো সময় আছে, শেয়ারবাজারের কারসাজির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করুন। তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করুন। না হলে শেয়ারবাজারের আগুন সরকারের গায়ে লাগতে সময় লাগবে না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.