বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৮০ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। জহিরুল হক খান, বীর প্রতীক প্রবল প্রতি-আক্রমণে বিধ্বস্ত হলো শত্রুসেনা পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল জহিরুল হক খানের প্রতিরক্ষা অবস্থানের দিক দিয়ে। তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালাচ্ছেন। তাঁর ত্বরিত তৎপরতায় পাকিস্তানি সেনাদের পালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল।


মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে অধিকাংশ পাকিস্তানি সেনাই নিহত হলো। মুক্ত হলো বিরাট এক এলাকা। এ ঘটনা কানাইঘাটে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে।
কানাইঘাট সিলেট জেলার অন্তর্গত উপজেলা। জৈন্তাপুর-জকিগঞ্জ সংযোগ সড়কে সুরমা নদীর তীরে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তে। এখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত এক প্রতিরক্ষা অবস্থান। প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। তাদের সহায়তা করেছে খাইবার রাইফেলস, থাল ও তোচি স্কাউটস এবং স্থানীয় রাজাকার বাহিনী।
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে জকিগঞ্জ ও আটগ্রাম মুক্ত হওয়ার পর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী সিলেটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু কানাইঘাটের পাকিস্তানি অবস্থান ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য শক্ত এক বাধা। এ জন্য কানাইঘাট দখলের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে কানাইঘাট-দরবস্ত রাস্তা ব্লক করতে ওই সড়কের লুবাছড়া চা বাগানে অবস্থান নেন। তখন পাকিস্তানিরা দূরবর্তী অবস্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে ১০৫ মিলিমিটার কামানের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এ অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের আক্রমণের কৌশল রদবদল করে ভিন্ন পন্থা গ্রহণ করেন। তাঁরা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে যান। দুটি দল কাট অব পার্টি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। একটি দল অবস্থান নেয় কানাইঘাট দরবস্ত সড়কে। আরেকটি কানাইঘাট চরখাই সড়কে। এই দলের দলনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জহিরুল হক খান। অন্যটি আক্রমণকারী দল হিসেবে থাকে। ২ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা যে যাঁর অবস্থানে পৌঁছে যান। কিন্তু আক্রমণ শুরুর আগেই পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে যায়। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারাও ত্বরিত পাল্টা আক্রমণ চালান। দেড় ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনারা পালাতে থাকে। কিন্তু তাদের পালানোর পথ ছিল রুদ্ধ। এক দল পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগীরা জহিরুল হক খানের অবস্থানের দিক দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সে সুযোগ তারা পায়নি। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন পলায়নরত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর। তাঁদের প্রবল আক্রমণে অধিকাংশ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়—লাশে ভরে যায় যুদ্ধক্ষেত্র। ৪ ডিসেম্বর সকাল আটটার মধ্যেই কানাইঘাট স্বাধীন হয়। কানাইঘাটের যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ৫০ জন নিহত, ২০ জন আহত এবং ২৫ জন আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিবাহিনীর ১১ জন শহীদ ও ২০ জন আহত হন।
জহিরুল হক খান ১৯৭১ সালে স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের (বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ) শিক্ষার্থী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। সীমান্ত এলাকায় খণ্ড খণ্ড যুদ্ধে অংশ নেন। জুন মাসে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় প্রথম বাংলাদেশ অফিসার্স ওয়ারকোর্সে। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁকে ৪ নম্বর সেক্টরের আমলাসিদ সাবসেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারপর বেশ কয়েকটি যুদ্ধে তিনি অগ্রবর্তী দলে থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য জহিরুল হক খানকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ৩৭।
জহিরুল হক খানের পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সদর উপজেলার সুহিলপুর ইউনিয়নের সুহিলপুর গ্রামে। বর্তমানে বাস করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার মৌলভীপাড়ায়। তাঁর বাবার নাম সুলতান আহমদ খান, মা হাবিয়া খাতুন। স্ত্রী মাহবুবা আক্তার। তাঁদের চার ছেলে।
জহিরুল হক খান বলেন, ‘বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুরু করেছে। এই বিচারপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়াতে হবে।’
সূত্র: জহিরুল হক খান বীর প্রতীকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন; প্রথম আলোর সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি বদর উদ্দিন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৪।
গ্রন্থনা: তারা রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.