অতি দুরন্ত শিশু

শিশুদের আচরণের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত চঞ্চলতা তার স্বাভাবিক জীবনযাপনে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এ ধরনের আচরণ তার ইচ্ছাকৃত নয়। শিশুর এই অস্বাভাবিক আচরণের কারণ ও প্রতিকার নিয়ে লিখেছেন মেহেরুন নেছা রুমা
সন্তানদের আচরণ নিয়ে সব মা-বাবাই কমবেশি দুশ্চিন্তায় থাকেন। একটি নির্দিষ্ট বয়সে শিশু যদি বেশি চুপচাপ থাকে, সেটা তার স্বাভাবিক আচরণ নয়; আবার অধিক মাত্রায় ছোটাছুটি, দৌড়ঝাঁপ করাও অস্বাভাবিক আচরণের মধ্যে পড়ে না।


মাত্রাতিরিক্ত লাফঝাপ করা করা শিশু চার বছরের আফিফার মা ডলির সঙ্গে কথা বলে জানলাম তার সমস্যাটি কোথায়। ডলি বলেন, 'আফিফা অন্য সব বাচ্চার মতো নয়। সে একটু বেশি চঞ্চল। আমার ধারণা ছিল, ছেলে শিশুর তুলনায় মেয়ে শিশুরা একটু শান্ত স্বভাবের হয়ে থাকে। অথচ ছেলেটাই আমার মেয়ের তুলনায় অনেক শান্ত স্বভাবের। আফিফা যখন থেকে হামাগুড়ি দিতে শিখছে, তখন থেকেই তার গতিবিধি যেন একটু অন্যরকম। মুহূর্তের মধ্যেই এখান থেকে ওখানে ছুটে যায়, সামনে যা পায় তাই ধরে ভেঙে ফেলে, যা করার জন্য মনস্থির করে তা করতে নিরুৎসাহিত করলে আরও জিদ ধরে বসে, চিৎকার-কান্নাকাটি করে। কিছুতেই শান্ত হতে চায় না। ধীরে ধীরে আফিফার জিদের মাত্রা আরও বেড়ে গেল। এখন দিন-রাত বিরামহীনভাবে ছোটাছুটি করতেই থাকে। খাট, সোফা, চেয়ার, টেবিল সব দাপিয়ে বেড়ায় মুহূর্তের মধ্যে। কোনো কিছুর প্রতি যত্ন নেই, পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। কিছু চাইলে সঙ্গে সঙ্গেই দিতে হবে। না দিলে কেঁদেকেটে পুরো বাড়ি মাথায় তোলে। কাছে যাকে পায় তাকেই মারতে চায়। এমন লম্ফঝম্প করতে গিয়ে কত যে দুর্ঘটনা ঘটেছে তার হিসাব নেই। তবুও তাকে কিছুতেই দমিয়ে রাখার উপায় নেই, এই মেয়েকে নিয়ে ডলি কোথাও যাওয়া একেবারে ছেড়েই দিয়েছেন। বাইরে গেলেও মেয়েটা মাথা খারাপ করে দেয়। শপিংয়ে গেলে ওর জন্য কোনো কিছু সুস্থভাবে দেখার উপায় নেই। কেনা তো দূরের কথা, এটা-ওটা ধরবে, মানুষের জিনিসপত্র ফেলে দেবে, কখনও ভেঙে দেবে। ওর জন্য কতবার যে জরিমানা গুনতে হয়েছে!
আফিফার মতো এমন অনেক শিশুই আছে, যারা স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশিই চঞ্চল। এ ধরনের বাচ্চাকে নিয়ে মা-বাবা উদ্বিগ্ন থাকেন ঠিকই, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তারা এটাকে শিশুদের স্বভাবজাত আচরণ মনে করে তেমন গুরুত্ব দেন না। আসলে এটা মোটেই স্বাভাবিক আচরণ নয়। বাচ্চারা দুষ্টুমি করবে, কিন্তু তারও একটা মাত্রা আছে। যেসব শিশু মোটেই স্থির থাকে না, বুঝতে হবে তাদের সমস্যা আছে। আর সময়মতো চিকিৎসা করালে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ অনেকাংশেই সহজ হয়। এ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা কী বলেন জেনে নিই।
অতি দুরন্তপনার কারণ
ষ বংশগত কারণে শিশুদের মধ্যে এ আচরণ বিরাজ করতে পারে।
ষ মাতৃগর্ভে বিরূপ পরিবেশ তথা মা যদি সিগারেট, অ্যালকোহল পান করেন, মানসিক বিকারগ্রস্ত থাকেন এবং পারিবারিক কলহে জড়িত থাকেন।
ষ পরিবেশ দূষণ তথা সিসার বিষক্রিয়া।
ষ জন্মের সময় বা জন্মের পর শিশুর মস্তিষ্কে কোনো আঘাত বা প্রদাহ।
ষ স্কুলগামী শিশুদের প্রবল মানসিক চাপ।
ষ অভিভাবক বা শিক্ষকের অত্যধিক চাপ।
ষ খাবারে আর্টিফিসিয়াল রঙের ব্যবহার।
কীভাবে বুঝবেন বাচ্চা অতি দুরন্ত
ষ পড়াশোনা ও খেলাধুলায় কোনোটিতেই মনোযোগ না থাকা।
ষ স্কুলের প্রতিটি কাজেই অসাবধানবশত ভুল করা।
ষ সহজ নির্দেশনা অনুসরণ করতে না পারা।
ষ কোনো কাজ গুছিয়ে না করতে পারা।
ষ জিনিসপত্র হারিয়ে ফেলা।
ষ প্রাত্যহিক কাজগুলোও ভুলে যাওয়া।
ষ অযথা হাত-পা ছোড়াছুড়ি করা।
ষ ক্লাসরুমে সিটে বেশিক্ষণ বসে না থাকা।
ষ অযাচিতভাবে দৌড়ানো, লাফানো।
ষ কোনো কাজই সুস্থির বা শান্তভাবে না করা।
ষ অতিরিক্ত কথা বলা।
ষ প্রশ্ন না করতেই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা।
ষ অন্যদের বিরক্ত করা, অন্যকে মারার প্রবৃত্তি থাকা।
এসব শিশু প্রতিবন্ধী বা অটিস্টিক নয়। তাদের বুদ্ধিমত্তা স্বাভাবিকই থাকে। সময়মতো চিকিৎসা হলে এসব শিশু সুস্থ হয়ে উঠতে পারে এবং তারা অবশ্যই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। মনে রাখতে হবে, অতি দুরন্তপনা তার ইচ্ছাকৃত নয়। এটা তার সমস্যা। তাই ধৈর্য ধরে শিশুকে সময় দিতে হবে। খেলার মাঠে খেলতে নিয়ে যেতে হবে। একটি নির্দিষ্ট রুটিন করে তার সবকিছু নিয়মমাফিক নিয়ে আসতে হবে। তবে মারামারি, ভাংচুর করলে তাকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। মাত্রা বেশি হলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
প্রতিটি শিশুর মনোজগৎ অসীম সম্ভাবনাময়। প্রাথমিক বিকাশের সময় যে কোনো সমস্যারই যদি যথাযথ চিকিৎসা না দেওয়া হয় তবে সমস্যা পরে জটিল আকার ধারণ করতে পারে। তাই যথাযথ চিকিৎসা দিয়ে শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে আসতে হবে।


ছবি :সাদমান সাকিব

No comments

Powered by Blogger.