যে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত, তাকে মারা যায় না-ফিরে দেখা by আবু সাইয়িদ

মুজিবের বিমান লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্টে নামলে পাকিস্তানি জান্তার হাতে বন্দি হওয়ার পর এই প্রথমবারের মতো গোটা বিশ্ব ৫১ বছর বয়সী এই বাঙালি নেতাকে চোখে দেখল। লন্ডনে সবচেয়ে অভিজাত হোটেল ক্ল্যারিজে এক সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে ক্লান্ত মুজিব আবেগমথিত ভাষায় বর্ণনা করেন তার বন্দিজীবনের কথা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর শর্তহীন আত্মসমর্পণে জুলফিকার আলি ভুট্টো উত্তেজিত ও বিমূঢ় হয়ে পড়েন।


জাতিসংঘে হাজার বছর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার তেজোদৃপ্ত ভাষণের পরদিনই তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন হবে তা নিয়ে আলোচনা করেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও ভুট্টোর আলোচনায় শেখ মুজিবের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে মার্কিন দলিলে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরাট ভূমিকা স্বীকৃত। আলোচনায় বলা হয়, তার অতিশিগগির মুক্তি বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের হাজার হাজার জনগণের মধ্যে যে তিক্ততা ও সমস্যা রয়েছে তা মুছে ফেলতে সহায়ক হবে। প্রেসিডেন্ট আগ্রহ নিয়ে ভুট্টোর কাছে জানতে চান, শেখ মুজিবের মুক্তির ব্যপারে তার কী মতামত? ভুট্টো বলেন, শেখ মুুজিবের মুক্তির নিশ্চয়তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে তা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। 'স্বাভাবিকভাবেই আমরা স্বীকার করি যে, এটি একটি গুরুতর বিতর্কিত বিষয়, কিন্তু এ সম্পর্কেও আমাদের অধিক গুরুত্ব দিয়ে এর ইতিবাচক দিক ভাবা উচিত।'
ওই দিনই ভুট্টো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব দি স্টেট মি. রজার্সের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ভুট্টোর সঙ্গে ছিলেন অ্যাম্বাসাডর রাজা। তিনি সেক্রেটারিকে বলেন, মার্চ মাস থেকে যে ট্র্যাজেডি শুরু হয়েছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে বেশি বিলম্বিত না হলে তা এড়ানো যেত। সেক্রেটারি রজার্সের এক প্রশ্নের উত্তরে ভুট্টো বলেন, পাকিস্তান নতুনভাবে সমঝোতার জন্য প্রস্তুত। এটা খুবই জরুরি যে, এর জন্য পাকিস্তানের জনগণের অভিপ্রায় এবং ভারতের সেনা প্রত্যাহার গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য শেখ মুজিবের উপস্থিতি অপরিহার্য। কিন্তু জনগণের সামনে তাকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে উপস্থাপনে তিন মাস সময় প্রয়োজন। সুনির্দিষ্ট এক প্রশ্নের জবাবে ভুট্টো আরও বলেন, তিনি মনে করেন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভেতর একটি 'অতিমাত্রায় শিথিল কনফেডারেশনের' মাধ্যমে সম্পর্ক রচনা সম্ভব। তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেন না এখনই তা সম্ভব কি-না।
২. এ আলোচনা থেকে পরিষ্কার হয়ে আসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পাচ্ছেন। ভুট্টো পাকিস্তানে এসে ক্ষমতা দখল করেন। বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে রেস্ট হাউসে নিয়ে আসেন। ভুট্টো রেস্ট হাউসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দু'বার দেখা করেন।
সামরিক ক্যামেরা ট্রায়ালের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কানে এসেছিল কামাল হোসেনকে পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে আটক রাখা হয়েছে। তিনি ভুট্টোকে অনুরোধ করেন যেন কামাল হোসেনকে রেস্ট হাউসে তার কাছে পাঠিয়ে দেন। ড. কামাল হোসেনকে হরিপুর জেল থেকে পরের দিন শেখ মুজিবের কাছে নিয়ে আসা হয়। এ সময় তাদের রেডিও ও সংবাদপত্র দেওয়া হয়।
আজিজ আহমদকে অবসর থেকে পুনরায় পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে ভুট্টো নিয়োগ দেন। কীভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকায় পাঠানো যেতে পারে তার ব্যবস্থা করতে তিনি দায়িত্ব পান। শেখ মুজিব রেডক্রস বা ইউএনওর প্লেনে সরাসরি বাংলাদেশে আসার প্রস্তাব দিলে আজিজ আহমদ তাতে অসম্মত হন। তিনি বলেন, তারা পিআইএর বিমান ব্যবহার করতে পারেন কিন্তু সেখানে বিপদের ঝুঁকি রয়েছে। ভারতের আকাশ পথ পাকিস্তান বিমানের জন্য বন্ধ এবং এ মুহূর্তে এ বিষয়ে ভারতের কাছে অনুরোধ পাকিস্তানের পক্ষে অনুকূল ও শোভনীয় হবে না। তিনি পরামর্শ দেন পিআইএর প্লেন তাদের তেহরানে নিয়ে যেতে পারে, সেখান থেকে তারা তাদের গন্তব্যে যাত্রা করতে পারেন। আলাপ-আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় সব বন্দোবস্ত চূড়ান্ত হওয়ার পর তাদের লন্ডনে পেঁৗছানো হবে। আজিজ আহমদ লন্ডন যাত্রার ব্যবস্থা করতে এয়ার মার্শাল জাফর চৌধুরীকে দায়িত্ব দেন। তিনি জানতে চান, বোয়িং প্লেন একনাগাড়ে লন্ডন পর্যন্ত যেতে পারে কি-না। এয়ার মার্শাল জবাবে বলেন, বাতাস অনুকূলে থাকলে তা সম্ভব। তিনি বলেন, তাড়াতাড়ি ও গোপনীয়ভাবে সব আয়োজন সম্পন্ন করবেন। এসব কথাবার্তার দু'তিনদিন পর তাকে করাচি থেকে বলা হয়_ ক. স্টেট ব্যাংক থেকে এক ব্যাগ ফরেন কারেন্সি আনতে এবং মিসেস কামাল ও তার সন্তানদের ইসলামাবাদে নিয়ে আসার জন্য।
৩. ভুট্টোর গোপন ইচ্ছা : ৭ জানুয়ারি ভুট্টোর ৪৪তম জন্মদিনের উৎসব লারকানায় পালন শেষে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জুলফিকার আলি ভুট্টো ইসলামাবাদে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিদায় জানাতে। রাতে ফরেন অফিস খোলা ছিল। বিমানবন্দরে ভুট্টো তার কথার পুনরাবৃত্তি করে বলেন, যেভাবে শিথিল সম্পর্ক চান তা আপনার বিবেচনাধীন, এটা হতে পারে 'লুজ কনফেডারেশন'। মুজিব প্রতিবাদ করে বলেন_ না, না, আমি আগেই বলেছি, অপেক্ষা করুন, দেখি কিছু করা যায় কি-না। মুজিব বলেন, এটা আমার ওপর ছেড়ে দিন। মুজিব ইঙ্গিত দেন দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তাকে বহু কিছুর সম্মুখীন হতে হবে। তাকে বহু বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হবে। ভুট্টো বলেন, যদি দু'অংশের মধ্যে পুনরায় বন্ধুত্ব স্থাপনে তার প্রয়োজন হয় তবে তিনি ঢাকায় যেতে প্রস্তুত। মুজিব বলেন, 'আমি আমার জনগণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করব, আমি আপনাকে পরে জানাব। এখন নয়। এয়ার মার্শাল জাফর চৌধুরী করাচি থেকে যে ৫০ হাজার ডলার নিয়ে এসেছিলেন ভুট্টো মুজিবের ব্যক্তিগত খরচের জন্য তার হাতে তুলে দিতে চাইলে মুজিব সেই অর্থ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, 'ঈড়হঃৎরনঁঃব রঃ ভড়ৎ সু পযধৎঃবৎবফ ঢ়ষধহব.' তারা উষ্ণ বিদায় করমর্দন করেন। তখন ৮ জানুয়ারি। ভুট্টো তার সঙ্গীদের বললেন, 'ঞযব নরৎফ যধং ভষড়হি.'
৪. মুজিবের বিমান লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্টে নামলে পাকিস্তানি জান্তার হাতে বন্দি হওয়ার পর এই প্রথমবারের মতো গোটা বিশ্ব ৫১ বছর বয়সী এই বাঙালি নেতাকে চোখে দেখল। লন্ডনে সবচেয়ে অভিজাত হোটেল ক্ল্যারিজে এক সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে ক্লান্ত মুজিব আবেগমথিত ভাষায় বর্ণনা করেন তার বন্দিজীবনের কথা। তিনি বলেন, 'আমি বন্দি ছিলাম কনডেম সেলে ফাঁসির অপেক্ষায়। জেলে ঢোকানোর পর থেকে জানতাম না, বাঁচব না মরব, মৃত্যুর জন্য মানসিক প্রস্তুতি ছিল আমার। কিন্তু আমি জানতাম বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবেই।' পাকিস্তানের সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্কের সম্ভাবনা সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে মুজিব বলেন, 'দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা আমার লোকের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে তাতে আমাদের আর একসঙ্গে থাকা সম্ভব না।' মুজিবের এই গোপন ইসলামাবাদ ত্যাগের খবর সাংবাদিকরা পর্যন্ত জানলেন ১০ ঘণ্টা পর। ৬ ঘণ্টার এক সংক্ষিপ্ত সফরে ইরানের শাহর পাকিস্তানে পেঁৗছানোর ঠিক আগে আগে মুজিবের পাকিস্তান ত্যাগের খবর প্রচার করা হয়। ততক্ষণে মুজিব পেঁৗছে গেছেন লন্ডনে। মুজিবকে ক্লান্ত দেখালেও দৃশ্যত স্বাস্থ্য বেশ ভালোই ছিল। ঠোঁটে ধরা ব্রায়ার পাইপে টান দিতে দিতে মুজিব হালকাচালে বলেছিলেন, 'আপনারা দেখছেন, আমি বহাল তবিয়তে বেঁচে আছি। এ মুহূর্তে আমাকে শুধু দেখুন, দয়া করে কিছু শুনতে চাইবেন না।'
এর কয়েক ঘণ্টা পরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও পরিবারবর্গের সঙ্গে টেলিফোনে আলোচনার পর লন্ডনে ক্ল্যারিজ হোটেলে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন তিনি। হোটেলের বাইরে তখন সমবেত হয়েছে উৎফু্ল্ল হাজারো বাঙালি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশকে একটি 'অনিবার্য বাস্তবতা' হিসেবে উলেল্গখ করে বিশ্বের প্রতি স্বীকৃতি ও জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান। স্পষ্টতই ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে মুজিব 'উষ্ণ এক মরু এলাকায় অবস্থিত কনডেম সেলে' তার বন্দি জীবনের বর্ণনা দেন। এই সময় পুরো পরিবার ও গোটা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন তিনি। মুজিব বলেন, 'আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম। যে মানুষ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত, কেউ তাকে মারতে পারে না।'

অধ্যাপক আবু সাইয়িদ : সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী

No comments

Powered by Blogger.