সময়ের প্রতিধ্বনি-'তৃতীয় শক্তি'র সরকার প্রতিষ্ঠায় নানা অপতৎপরতা by মোস্তফা কামাল

রাজনৈতিক সরকারকে ব্যর্থ করতে অপশক্তিগুলো অনেক আগে থেকেই তৎপর ছিল। এখন তাদের তৎপরতা আরো বেড়ে গেছে। অপশক্তিগুলো এখন দুটি উদ্দেশ্য সামনে রেখে কাজ করছে। এক. বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ করা এবং দুই. প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত ও সাংগঠনিক শক্তি দুর্বল করা। যাতে দেশের মানুষ রাজনীতির ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে।


যেহেতু ঘুরেফিরে আওয়ামী লীগ-বিএনপিই ক্ষমতায় আসছে এবং দেশে দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টি হয়েছে, সেহেতু দুটি দলের ওপর থেকেই যেন জনগণ মুখ ফিরিয়ে নেয় সেই পরিবেশ সৃষ্টির সব পরিকল্পনা পাকা করা হয়েছে। এখন পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে। এ পরিকল্পনার সঙ্গে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তো বটেই, সুধী সমাজ ও মিডিয়া প্রতিনিধিরা সম্পৃক্ত রয়েছেন।
বলা হচ্ছে, ওয়ান ইলেভেন-পরবর্তী সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পর দেশের মানুষ এক ধরনের স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়েছিল। কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে হানাহানি শুরু হয়েছিল, তাতে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। দেশের মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবেই দুটি রাজনৈতিক জোটকে পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা মারাত্মক রূপ নেয়। অনেকেই তখন দেশে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করেছিলেন। সেই অবস্থায় মানুষ পরিবর্তন চেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু অরাজনৈতিক সরকার শাসন ক্ষমতায় জেঁকে বসুক_এটা কেউ চায়নি।
তিন মাস মেয়াদি সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নতুন ফাঁদ পাতল ভোটার পরিচয়পত্র প্রকল্প হাতে নিয়ে। বলা হলো, পরিচয়পত্র করার পরই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে। অবশ্য এর আড়ালে ছিল অন্য খেলা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি চিন্তা করল। উর্বর মস্তিষ্কের কিছু লোক সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদকে রাষ্ট্রপতি পদের লোভ দেখালেন। তাঁরা বললেন, সেনা সমর্থনে অরাজনৈতিক সরকার দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকবে। আর সেই সরকারের রাষ্ট্রপতি হবেন তিনি। ব্যস, কাজ হয়ে গেল। তিনি টোপ গিলে ফেললেন। তারপর জানতে চাইলেন, রাষ্ট্রপতি হলে কী করতে হবে?
পরামর্শ দেওয়া হলো, দুই নেত্রীকে মাইনাস করতে হবে! তা না হলে কোনো পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করা যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে মইন উ আহমেদ তৎপর হয়ে উঠলেন। কালবিলম্ব না করে দুই নেত্রীকে আটক করে সাবজেলে বন্দি করলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে একের পর এক প্রহসনমূলক মামলাও করা হলো।
এ বিষয়ে তখনকার অন্যতম নীতিনির্ধারক এক সাক্ষাৎকারে এই লেখককে বলেন, দুই নেত্রীকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে তিনি আপত্তি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তাঁদের গ্রেপ্তার করলে পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। আমরা ব্যর্থ হব। কিন্তু তখন সুধী সমাজ ও মিডিয়ার কয়েকজন প্রতিনিধি আপত্তি জানিয়ে বললেন, দেশকে সঠিক পথে এগিয়ে নিতে হলে দুই নেত্রীকে গ্রেপ্তারের কোনো বিকল্প নেই। কাজেই তাঁর আপত্তি কেউ কানে তোলেনি।
দুই নেত্রীকে গ্রেপ্তারের পর তাঁদের কর্মী-সমর্থকরা গেলেন খেপে! প্রতিবাদের সেই ঝড় শুধু দেশে নয়, প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যেও বইতে শুরু করল। আর সেই ঝড় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর আঘাত হানতে লাগল। একই সঙ্গে সারা দেশ থেকে নির্বাচনের দাবিও উঠল। তা ছাড়া সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শুরুটা ইতিবাচক মনে হলেও দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে দেশে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করা হলো। বিরাজনৈতিকরণের অপকৌশল হিসেবে রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দেওয়া হলো। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের জন্য তাঁদের কালো তালিকাভুক্ত করা হলো। ফলে আতঙ্ক সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামতে শুরু করল। এ কারণে শুরুতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি মানুষের বিপুল সমর্থন থাকলেও অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই তা উল্টে গেল। ফলে নির্বাচন দিতে বাধ্য হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
নির্বাচনে জনগণের বিপুল অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হলো, দেশের মানুষ গণতন্ত্র চায়। কোনো অরাজনৈতিক সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। অথচ ষড়যন্ত্রকারীরা অরাজনৈতিক সরকারকেই বেশি পছন্দ করে। তারা জানে, গণতান্ত্রিক সরকারকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। কিন্তু অরাজনৈতিক সরকারকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। অপশক্তিগুলো তাই নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দেওয়ার জন্য মহাজোট সরকারের শুরুতেই বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছিল। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটিকে কেউ কেউ সেই ষড়যন্ত্রের অংশ বলে দাবি করছেন। তার পরও ষড়যন্ত্র থেমে ছিল না এবং এখনো নেই। সরকারকে বিব্রত করতে আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর তৎপরতাও আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। তারা এ দেশের অপশক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভেতরে ভেতরে অরাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে।
সরকারের দিন যতই ফুরিয়ে আসছে, অপশক্তির তৎপরতা ততই বাড়ছে। আমরা সেই অপশক্তি এবং তাদের দোসরদের দেখতে পাচ্ছি। তারা আবার মাঠে নেমেছে। তারা নাকি অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন উদ্যমে কাজ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ভেতরে ভেতরে কিংস পার্টি গঠনের প্রক্রিয়াও চলছে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে কোণঠাসা হয়ে পড়া নেতাদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অনেক আগেই আমি বেশ কয়েকটি নিবন্ধ লিখেছি। তখন কারো কারো কাছে বিষয়টি কাল্পনিক মনে হলেও এখন কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টারাই বলা শুরু করেছেন, 'তৃতীয় শক্তি আসছে।' এখন যাঁরা প্রকাশ্যে তৃতীয় শক্তি ফিরে আসার কথা বলছেন, তাঁরা আগের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ঘোর সমর্থক ছিলেন। তাঁরা পেছন থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে পরিচালনা করতেন। রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ায় অনেকে নিভৃতে থেকে কাজ করেছেন। এখন তাঁরা প্রকাশ্যে কাজ করতে শুরু করেছেন।
আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাও ভালো করেই জানেন, তৃতীয় শক্তির কুশীলবরা এখন বেশ তৎপর। তাঁরা টিভিমাধ্যমে 'টক শো'তে অংশ নিচ্ছেন এবং বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেছেন। কেউ যদি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের টকশোর নিয়মিত দর্শক-শ্রোতা হয়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন যে তাঁরা রাজনীতিকদের তুলোধুনো করছেন। এর অর্থ হচ্ছে, এই রাজনীতি দিয়ে হবে না। কিন্তু রাজনীতিকে যে রাজনীতি দিয়েই ঠিক করতে হবে, সে কথাটি তাঁরা বলছেন না। তাঁদের উদ্দেশ্যই হচ্ছে রাজনীতিকদের ব্যর্থ করে দিয়ে অরাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। তাতে তাঁরা লাভবান হতে পারেন।
বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখিতেও আমরা একই চিত্র দেখতে পাচ্ছি। এতে যে সরকার কিংবা বিরোধী দল সতর্ক হবে তা নয়। তারা বিষয়টিকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে। তারা উল্টো মিডিয়ার সমালোচনায় মুখর। সব মিডিয়াই কিন্তু 'এজেন্ডা সাংবাদিকতা' করে না। সব সাংবাদিক কোনো 'বিশেষ উদ্দেশ্যে' কাজ করে না। এ বিষয়গুলো সরকার এবং বিরোধী দল উভয়কেই উপলব্ধি করতে হবে।
কেউ যদি অসৎ উদ্দেশ্যেও সরকারকে সমালোচনা করে, ভুল ধরিয়ে দেয়, তাহলে সেই ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার মনোভাব থাকতে হবে। তাহলে অসৎ উদ্দেশ্যে যারা কাজ করছে, তারা ভবিষ্যতে সতর্ক হবে। এটা বিরোধী দলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
আমি আগেও লিখেছি, দুই নেত্রীর ঐক্য হোক_এটা ষড়যন্ত্রকারীরা চায় না। তাঁদের ঐক্য হলে তো ষড়যন্ত্রকারীদের দেশ নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারবে না। তাই তাঁদের মধ্যে বিরোধ লাগিয়ে রাখতে নানা অপকৌশল-অপতৎপরতা চালিয়ে থাকে। এটা নিশ্চয়ই শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া উপলব্ধি করতে সক্ষম। কাজেই দেশের স্বার্থে দুই নেত্রীর ঐক্য অপরিহার্য।
গণতন্ত্রের জন্য তাঁদের সংগ্রামের কথা নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাইনি। তাঁরা স্বৈরশাসকের জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছেন। অনেক নেতা-কর্মীকে হারিয়েছেন। অনেকের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে ফিরে এসেছে গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্রও ফিরে আসত না, যদি দুই নেত্রীর ঐক্য না হতো।
দুই নেত্রীর অনৈক্যের কারণে আবারও গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হতে পারে। আবার যদি গণতন্ত্র হাতছাড়া হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু শিগগিরই ফিরে আসবে না। আমরা আশা করি, দুই নেত্রীই দেশ, দেশের মানুষকে ভালোবাসেন। দেশের স্বার্থে তাঁরা বিভেদ ভুলে, ক্ষুদ্রতার ঊধর্ে্ব উঠে একসঙ্গে কাজ করবেন। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। বিএনপি বিরোধী দলে। বিএনপির উচিত সরকারকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া এবং জ্বালাও-পোড়াওয়ের আন্দোলন থেকে বিরত থাকা। এতে তাদের জনসমর্থন বাড়বে।
বিএনপি গঠনমূলক বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করলে মানুষের মনে আস্থা ফিরে আসবে। তারা আবার ক্ষমতায় যেতে সক্ষম হবে। অন্যথায় দেশ 'তৃতীয় শক্তি'র হাতে চলে যাবে। সেটা হলে দেশ আবার ২০ বছর পিছিয়ে যাবে। এটা নিশ্চয়ই কারো কাম্য নয়।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.