অকুতোভয় বিচারপতি by মাহবুবুর রশীদ

৯২৬ সালে বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মুর্শেদ রাজশাহী বিভাগের ভেতর প্রথম স্থান দখল করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৩০ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। এরপর একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩২ ও ১৯৩৩ সালে যথাক্রমে এমএ এবং এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। শেষোক্তটিতে প্রথম শ্রেণী। ১৯৩৯ সালে লিংকনস ইন থেকে বার এট-ল' ডিগ্রি লাভ করেন। দেশে ফিরে কলকাতা হাইকোর্টে ব্যারিস্টারি পেশায় যোগ দেন।


তিনি প্রখ্যাত রাজনীতিক হুমায়ন কবির এবং আবুল মনসুর আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কংগ্রেস এবং প্রজা পার্টির জোট সরকার গঠনের চেষ্টা করেন। বাংলার কংগ্রেস নেতাদের জঙ্গি মনোভাবের জন্য এটা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এখানে আমরা বিচারপতি মুর্শেদের যে পরিচয় পেলাম, তাহলো তিনি অনেকটা রাজপরিবারের সদস্যের মতো, অথচ তিনি এসেছিলেন সাধারণ মানুষের রাজনীতি করতে, তাদের কথা বলতে। ভারত বিভাগের পর তিনি ঢাকা হাইকোর্ট বারে যোগদান করেন। তিনি মহান ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট যে ২১ দফার অঙ্গীকার করে নির্বাচন করে, তিনি সেই ২১ দফা প্রণয়নকারীদের অন্যতম। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশত বার্ষিকীর উদযাপন কমিটিতে নেতৃত্ব দেন। ১৯৫৫ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৬৩ সালে তার দেওয়া আবদুল হক বনাম ফজলুল কাদের চৌধুরী গংয়ের শাসনতান্ত্রিক একটি মামলার রায় এক বিরাট বিস্ফোরণ। আইয়ুব খান এসে যে অপ্রতিহত ক্ষমতা চালিয়েছে যাচ্ছিলেন, এই রায় তার রাশ টেনে ধরে। ষাটের দশকে আরও কিছু ঐতিহাসিক রায় এসেছে যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমার্তন মামলা। এসব রায় পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট বহাল রেখেছেন। যদিও এসব রায়কে বাঙালির বিজয় বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। কিন্তু আসলে বিচারপতিরা রায় দিয়েছেন সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে। ১৯৬৫ সালে কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ বাধে। ৬ সেপ্টেম্বর যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ বাধার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান সরকার উবভবহপব ড়ভ চধশরংঃধহ ৎঁষবং নামে এক অধ্যাদেশ জারি করে। এর অধীনে বাঙালি দেশপ্রেমিক, বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের নির্বিচারে ধড়পাকড় করা হয়। এসব বন্দির প্রথম একটি ব্যাচ ছাড়া পায় বিচারপতি মুর্শেদের রায়ের ফলে। এই প্রথম ব্যাচের ভেতর বর্ষীয়ান নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তও ছিলেন। আইয়ুব-মোনেম খানের সরকার ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে দেশের শত্রু হিসেবে গণ্য করে গ্রেফতার করেছিল ১৯৬৫ সালে। তিনি ১৯৭১ সালে কুমিল্লা শহরের বাড়ি থেকে না পালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। নিষ্ঠুর অত্যাচার করে তাকে হত্যা করা হয়। ধীরেন্দ্রনাথ ১৯৪৮ সালে করাচিতে প্রথমবারের মতো গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুলেছিলেন। ন্যায়বিচার ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য বিচারপতি মুর্শেদ এমন একটা ইমেজ গড়ে তুলেছিলেন, যার আলো ছড়িয়ে উদ্ভাসিত করেছিল গোটা হাইকোর্টকে। অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল তার সতীর্থদের। বিচারপতি মুর্শেদের বর্ণাঢ্য ও ঘটনাবহুল বিচারকের দায়িত্বের পরিসমাপ্তি ঘটে যখন ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি হিসেবে পদত্যাগ করেন। ১৯৬৮ সালের শেষে আইয়ুব-মোনেম দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়। আইয়ুব তার পতন আসন্ন দেখে গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বান করেছিলেন সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য। এখানেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৭৫-এর আগস্টে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর তাকে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পদে যোগদানের আবেদন জানানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি গ্রহণ করেননি। এ ধরনের ক্রান্তিকালে অনেক সুযোগ সন্ধানী ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করেছেন। বিচারপতি মুর্শেদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। কেননা ক্ষমতার লোভ তার কখনও ছিল না। তিনি সরাসরি কিছু সামাজিক কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় তিনি আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাজকর্মে জড়িয়ে পড়েন এবং বেশ ক'বছর এর চেয়ারম্যান ছিলেন। ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তান রেড ক্রস সোসাইটির চেয়ারম্যান ছিলেন। দীর্ঘদিন রোগভোগের পর ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল তিনি মারা যান। ষাটের দশকে বিচারপতি মুর্শেদের কী ইমেজ ছিল, তা এখনকার কেউ কল্পনা করতে পারবে না। স্বাধীন বাংলাদেশ কেন আমরা তাকে অধিকতর দায়িত্ব দিয়ে কিছু নিতে পারলাম না, তা বোধগম্য নয়। তবে এতে তো আর তার ক্ষতি হয়নি। হয়েছে আমাদের।

No comments

Powered by Blogger.