চরাচর-ঝিনুকের জীবনচিত্র by বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

দুই হাতের আঙুলগুলো একসঙ্গে আটকানো। পায়ের আঙুলের অবস্থাও অনুরূপ। হাতের আঙুলগুলো স্বাভাবিক না থাকার ফলে লেখালেখির কাজটা বহু কষ্টে করতে হয় তাকে। ক্লাসে আর পরীক্ষার হলে নির্দিষ্ট সময়ে প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর খাতায় তুলে দেওয়ার কাজটি কষ্টসাধ্য_এই ব্যাপারটার প্রতি অদম্য আগ্রহ তাকে ঘিরে থাকে সব সময়। এক হাতে কলম ধরে অন্য হাতে কলমটি ঠেস দিয়ে বড় বিচিত্রভাবে লিখে চলে সে।


বিভিন্ন প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া এ শিশুটির নাম ঝিনুক দেব। জন্ম থেকেই এমন শারীরিক সমস্যা নিয়ে এগিয়ে চলছে সে। তার বাবার নাম যতীন্দ্র দেব। লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। মায়ের নাম অলি রানী দেব। একদিকে ঝিনুকের প্রতিবন্ধী জীবন, অন্যদিকে পিতৃহীন ছোট ভাই আর মাকে নিয়েই তার সংগ্রাম। ছোট ভাই ঝুমুর। সে পড়ছে তৃতীয় শ্রেণীতে। তার বাবার মৃত্যুর পর তাদের সংসারে নেমে আসে নানা দুঃখ-দুর্দশা। সংসারের অভাব-অনটনসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও থেমে থাকেনি ঝিনুক। নিজের মেধাকে ফুটিয়ে তুলতে তার ঐকান্তিক প্রয়াস তাকে নিয়ে গেছে সাফল্যের দিকে। অঙ্গপ্রতিবন্ধী হয়েও ঝিনুক সিলেট বিভাগের আওতায় শ্রীমঙ্গল উপজেলার চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছে। এখন পড়ছে ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীতে। পাচ্ছে প্রতিবন্ধী ভাতাও। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার রূপসপুর আবাসিক এলাকার হিমাংশু পালের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঝিনুক তার বাসার পাশে অন্য একটি ছেলের সঙ্গে খেলা করছে। এই ছোট্ট ও জীর্ণ বাড়িতেই ভাড়া থাকে ঝিনুকদের ছোট পরিবার। ঝিনুক জানায়, পড়াশোনা করতে অনেক ভালো লাগে তার। পড়াশোনা করে সে অনেক বড় হতে চায়।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে প্রথমে কথা বলতে রাজি হননি ঝিনুকের মা অলি রানী দেব। তাঁর চোখ-মুখজুড়ে তখন উৎকণ্ঠা আর ভয়ের ছাপ লক্ষ করা গেছে। কথা বলতে অনুরোধ করা হলে তিনি বলেন, 'আত্মীয়স্বজনের অনুমতি ছাড়া আমি কথা বলতে পারব না। সমস্যা হবে।' বিষয়টি বোঝানোর পর তিনি জানান, ঝিনুক ভিক্টোরিয়া স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে। টাকার অভাবে আমি ঝিনুকের চিকিৎসা করাতে পারছি না। স্বামীহারা সংসারে দুই ছেলের লেখাপড়াসহ সাংসারিক খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয় আমাকে। ঝিনুকের সুচিকিৎসা ও পড়ালেখার জন্য সরকারসহ সমাজের বিত্তবানদের কাছে সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছেন তিনি। চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জহর তরফদার বলেন, 'প্রতিবন্ধকতা দমিয়ে রাখতে পারেনি ঝিনুককে। তার পরিবারের অবস্থা খুবই করুণ! তার সুচিকিৎসার বিষয়টি নিশ্চিত হলে অনেকের চেয়ে অনেক ভালো করত সে।' ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অয়ন চৌধুরী বলেন, 'ঝিনুক মিশুক প্রকৃতির এবং পড়ালেখায়ও আশাব্যঞ্জক। আমরা স্কুলের পক্ষ থেকে ওর বেতন মওকুফসহ বিরতির সময় খাবারের ব্যবস্থা করেছি।' নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঝিনুকের নিকটাত্মীয়রা বিত্তশালী হলেও তাদের অবস্থা নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো।
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

No comments

Powered by Blogger.