ব্যবস্থাপনার কালান্তর-নিজেরাই উদ্ভাবন করতে হবে by ইফতেখারুল ইসলাম

র্ব-৫ : অপরের উদ্ভাবনপ্রক্রিয়া থেকে অর্জিত শিক্ষা সৃজনশীলতার বিভিন্ন স্তর বা পর্যায় রয়েছে। এর একেবারে প্রাথমিক পর্যায় হলো পদ্ধতিগত উদ্ভাবন : এরপর ক্রম-উন্নয়নের ধারায় আসে পণ্য ও পরিষেবার উদ্ভাবন; কৌশলগত উদ্ভাবন এবং সবশেষে ব্যবস্থাপনার উদ্ভাবন। সৃজনশীলতা সর্বস্তরেই প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য অবদান রাখতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, উচ্চতর স্তরের উদ্ভাবনশীলতা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে এবং সমাজে উচ্চতর মানের মূল্য সংযোজন করে, দীর্ঘমেয়াদি সক্ষমতা দেয়।


অবশ্য সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সৃজনশীলতা অর্জন করা তুলনামূলকভাবে দুঃসাধ্য; আমাদের বস্তুগত পছন্দ-অপছন্দকে আমরা দ্রুত বদলে ফেলতে পারি, কিন্তু অন্তর্গত বিশ্বাসকে সহজে বদলাতে পারি না।
নিজেদের প্রতিষ্ঠানের জন্য উপযোগী ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি নিজেদেরই উদ্ভাবন করতে হয়। তবে বিভিন্ন বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান উদ্ভাবনী পদ্ধতিগুলো কিভাবে খুঁজে পেয়েছে এবং প্রয়োগ করেছে, তার উদাহরণ পর্যালোচনা করলে সৃজনশীল ব্যবস্থাপনার জন্য বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য শিক্ষা পাওয়া যাবে। অপরের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া ওই শিক্ষাগুলো সহজেই ব্যবহারযোগ্য, যদিও মনে রাখতে হবে যে এটা রন্ধনশাস্ত্র নয় যে অপরের তৈরি করা উপকরণ-তালিকা ও প্রণালি অনুযায়ী ঘরে ঘরে চলবে রসনাতৃপ্তির আয়োজন।
১. ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির ভেতরকার কোনো সমস্যা সমাধান করতে হলে আগে এর গভীরে প্রোথিত শেকড় পর্যন্ত পেঁৗছে তাকে বুঝতে হবে। কেন একটি নতুন উদ্যোগ সফল হচ্ছে না, তার ময়নাতদন্ত পূর্ণাঙ্গ হওয়া দরকার_সে পর্যন্ত না পেঁৗছে কোনো সমস্যার সহজ সমাধান বা দ্রুত সংস্কার চাইলে তা থেকে যাবে অসম্পূর্ণ এবং অকার্যকর।
২. কোনো পদ্ধতির মূলোৎপাটন করার চেয়ে তাকে গুণে-মানে উন্নত করার চেষ্টা সহজতর। প্রচলিত প্রতিটি পদ্ধতি কোনো না কোনো কাজে লাগে বলেই তাদের রক্ষা করতে অনেকে সচেষ্ট থাকেন।
সুতরাং এদের পাশাপাশি নতুন একটি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রবর্তন করা যেতে পারে, যা প্রতিষ্ঠানকে ভবিষ্যতের জটিল সমস্যা মোকাবিলা করতে শক্তি জোগাবে এবং ব্যবস্থাপনার সংস্কৃতিকে বদলে দেবে।
৩. বৈপ্লবিক লক্ষ্যের প্রতি অঙ্গীকার রেখেও ধাপে ধাপে ক্রমোন্নয়নের পদক্ষেপ ও কর্মসূচি নেওয়া যেতে পারে। এতে বাধা-বিঘ্ন কম আসে এবং তাদের অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়া সহজ হয়।
৪. পরিমাপক এবং মানদণ্ড নির্ধারণ করে নেওয়াটা জরুরি। যেকোনো নতুন পদ্ধতির সাফল্য, বস্তুগত ও গুণগত উভয় দিক থেকেই পরিমাপযোগ্য হতে হবে। তাই সাফল্যের সূচকগুলো, যেমন_উদ্ভাবনী পদ্ধতির সংখ্যা, সময়সীমা, ব্যয়, আর্থিক এবং অন্যবিধ সুফল ইত্যাদি আগে থেকেই নির্ধারণ করে নেওয়া দরকার।
৫. ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির পুনর্নির্মাণে চাই অধ্যবসায়। এই নবনির্মাণ-প্রক্রিয়া সহজসাধ্য নয়। অনেক ক্ষেত্রে এর পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলোও ব্যয়সাধ্য। সুতরাং দীর্ঘমেয়াদে সাফল্য পেতে হলে লেগে থাকার কোনো বিকল্প নেই।
৬. সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিশ্চিত ঝুঁকিগুলো কমানো প্রয়োজন। যেমন_ হঠাৎ করে কর্মীসংখ্যা অথবা কর্মীদের বেতন কমে যাবে, এমন কোনো নতুন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রবর্তন করা কঠিন। যদি এ ধরনের পরিবর্তন অত্যাবশ্যক হয়, তাহলেও সে ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রস্তুতি এবং বিকল্প ভাবনা তৈরি থাকা দরকার।
৭. নতুন সিদ্ধান্ত বা নিরীক্ষামূলক পদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য প্রতিষ্ঠানের ভেতর থেকে স্বেচ্ছাসেবক বেছে নেওয়া যেতে পারে, যাতে অন্তত কিছু মানুষ শুরু থেকেই এর পক্ষে অবস্থান নেয়।
৮. উদ্ভাবনের বিষয়টিকে হালকা ও আনন্দময় রাখা চাই। কর্মী ও ব্যবস্থাপকদের মধ্যে এ বিষয়ে ছোট ছোট প্রতিযোগিতা ও তার মূল্যায়ন, পুরস্কার ইত্যাদি প্রবর্তন করার মধ্য দিয়ে নব উদ্ভাবনের কাজটিকে উপভোগ্য ও জনপ্রিয় করে তোলা সম্ভব।
৯. নতুন উদ্ভাবিত পদ্ধতিটিকে পুরনো পদ্ধতির পাশাপাশি বাস্তবায়ন করে তাদের তুলনামূলক সাফল্য পর্যালোচনা করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে নতুন পদ্ধতির সুফল ও তুলনামূলক শ্রেষ্ঠতা স্পষ্টভাবে ধরা পড়বে।
১০. নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন, প্রয়োগ, পরিমাপ ও মূল্যায়নের পুনরাবৃত্তি করতে হবে। পৌনঃপুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মূল্যায়ন ও তা থেকে শেখার মধ্য দিয়েই সঠিক দিকনির্দেশনাটি বেরিয়ে আসে।
শেষ কথা নয়
ব্যবস্থাপনার ভবিষ্যৎ রূপটি কেমন হবে? কোনো প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা বা প্রধান নির্বাহীর কাছে তাঁর প্রতিষ্ঠানের কৌশলগত লক্ষ্য স্থির করা আছে বলে ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁর কাছে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার কোনো দিকনির্দেশনা আছে তো? অনাগতকালে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি কিভাবে বিকশিত ও ব্যবহৃত হবে, সে বিষয়ে সবার মধ্যে ঐকমত্য আছে কি?
বিভিন্ন কারণে এ রকম একটি সার্বিক রূপকল্প থাকা জরুরি। এটা তৃণমূল পর্যায়ে সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করে। উদ্ভাবন-প্রক্রিয়াকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও অভীষ্ট কেন্দ্রবিন্দু দেয় এবং এটি তাঁদের সতর্কবার্তা দেয়, যাঁরা স্বভাবতই স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালান।
যেকোনো প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে থাকা শীর্ষ ব্যবস্থাপকদের দুটি প্রশ্নের উত্তর দিতে তৈরি থাকা দরকার। প্রথমত, এখন থেকে পাঁচ বছর পর আমাদের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির নতুন, মৌলিক এবং পার্থক্য সৃষ্টি করা বৈশিষ্ট্যগুলো কী হতে যাচ্ছে? দ্বিতীয়ত, আমরা যেভাবে ব্যবস্থাপনা করব, তা কিভাবে আমাদের অন্যদের তুলনায় প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা এনে দেবে। এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য সাধারণত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় থেকে দূরে কয়েক দিনের পর্যালোচনা সভা আয়োজন অথবা উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়।
দুঃখের বিষয়, এই পদ্ধতিগুলো অতি ব্যবহারে জীর্ণ এবং অকার্যকর। এ ধরনের কাজ তিন দিনের আলোচনায় সমাপ্ত হওয়ার নয়। তার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তর থেকেই ব্যবস্থাপনার ভবিষ্যৎ বিষয়ে বিভিন্ন আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই রূপকল্পটি গড়ে উঠবে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের অন্য সব প্রক্রিয়া, নিয়মিত পর্যালোচনা অথবা কর্মিসভার ভেতরে এই আলোচনার সূত্রপাত করতে হবে। তারপর এসব প্রক্রিয়া থেকে উঠে আসা সাদৃশ্যপূর্ণ মতামত, লক্ষ্য-অভিমুখী পরামর্শ, বারবার আলোচিত বিষয় এবং সবার স্বপ্নগুলোকে একত্রে গ্রথিত করতে হবে। এগুলোকে একত্রে মিলিত ও পরিমার্জিত করেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠবে সম্মিলিত বিশ্বাস, সর্বসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি এবং নতুন সিদ্ধান্ত।
ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির পুনরাবিষ্কার হতেই হবে, তবে তা শেষ পদক্ষেপ হিসেবে নয়, এটি হবে পুনর্নির্মাণের সূচনামাত্র। প্রশ্ন হলো, কে এই কাজে ব্রতী হবেন আর কখন তা সম্পন্ন হবে। বাংলাদেশ থেকে এই নবযাত্রা শুরু হবে_এটা আপাতদৃষ্টিতে অতিরিক্ত আশাবাদ বলে মনে হয়, কিন্তু প্রয়োজন যদি উদ্ভাবনের জনক হয়ে থাকে, তাহলে আমরা কেন পিছিয়ে থাকব? মানব সম্পদবিষয়ক অনেক অমীমাংসিত বিষয়েরই সমাধান-ব্যবস্থাপনা শুরু হওয়া উচিত, আমাদের মতো স্বল্প সম্পদ ও সংকটক্লিষ্ট সমাজের ভেতর থেকে। দুর্যোগপ্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ যেমন অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে, তেমনি আরো বহু ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রপথিক হওয়ার প্রয়োজন এবং যোগ্যতা রয়েছে।
ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির পুনর্নির্মাণ করা সম্ভব হলে তার সুফল যে শুধু বাণিজ্যিক লাভ এবং প্রতিযোগীকে পরাস্ত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে তা নয়। উদ্ভাবনী ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য গভীরতর ও মহত্তর প্রণোদনা রয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী যে ব্যবস্থাপনা মডেল আবিষ্কৃত হবে, তা যেন মানুষের মানবিক গুণাবলির পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারে এবং মানুষের সৃষ্টিশীলতা ও হৃদয়াবেগকে ধারণ করতে পারে। যে ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ভবিষ্যতের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে, তাকে প্রথমে হতে হবে মানুষের জন্য উপযুক্ত। এটি যাঁরা করতে সক্ষম হবেন, তাঁরা গড়ে তুলবেন এমন নতুন প্রতিষ্ঠান, যা মানবিক বিকাশের জন্য সহায়ক এবং অনাগত কালের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য হবে উপযোগী।

লেখক : ফার্মাসিস্ট এবং বাণিজ্য ব্যবস্থাপক,
একটি ওষুধ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা

No comments

Powered by Blogger.