পথিকৃৎ বাঙালি উদ্যোক্তা-স্মরণ by মোস্তফা কামাল

৯৯৫ সালের ১৯ অক্টোবর আমরা হারিয়েছি জহুরুল ইসলামকে। পরিশ্রম, সততা, নিষ্ঠা এবং আত্মবিশ্বাস তাকে সোনার মানুষে পরিণত করেছিল। এ অসাধারণ বাঙালি কৃতী সন্তানের তুলনা শুধু তিনি নিজেই। শুধু শিল্পপতি পরিচয়ে সীমাবদ্ধ করলে তাকে খাটো করা হয়। একজন সমাজ সংস্কারক, সফল সংগঠক, ব্যবস্থাপকের মডেল তিনি। অলৌকিকভাবে তিনি কিছু অর্জন করেননি। তার সব অর্জনই সম্পন্ন হয়েছে শ্রমে এবং মেধায়।


পরিশ্রম, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা তাকে করেছে সফলকাম। তা যেমন ব্যবসায় তেমনি সমাজসেবায়। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে তিনি তার ব্যবসার বিস্তার ঘটিয়েছেন সে আমলেই। লন্ডন, বাংলাদেশ বা যে কোনো দেশের একটি অফিসে বসে তিনি বিভিন্ন দেশের অফিসগুলো পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করতেন দক্ষতার সঙ্গে। আবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও শহরে সেবামূলক কোনো পদ্ধতি-প্রক্রিয়া দেখে তা দেশে তথা ঢাকায় বাস্তবায়নের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। যোগাযোগ করতেন রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে। ব্যক্তিগত সে পরিকল্পনা থেকেই তার ইস্টার্ন হাউজিং প্রতিষ্ঠা। এ উদ্যোগে ঢাকার আবাসিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি ছিল কর্মসংস্থানের এক বিশাল আয়োজন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শ্রমশক্তির কর্মসংস্থানের দুয়ারও খোলে তার মাধ্যমেই। দেশের অর্থনীতির ভিত্তিতে রক্ত সঞ্চালক হিসেবে আজও দেশ-বিদেশে দৃষ্টান্ত হিসেবে উচ্চারিত হয় এ নামটি। শুধু বিনিয়োগ-কর্মসংস্থানেই নয়, তার জনহিতের হাত প্রসারিত হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, ব্যাংক, কৃষি, ক্রীড়াসহ বিভিন্ন খাতে। দেশের ব্যবসা এবং ব্যবসায়ীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় জহুরুল ইসলাম ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়। পশ্চিমা ধনী আদমজী, ইস্পাহানি, দাউদদের অসহযোগিতা মোকাবেলা করে তিনি এ দেশীয় ব্যবসা ও ব্যবসায়ীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট থেকেছেন। কাজের মাধ্যমে এগোতে চেয়েছেন তিনি। ব্যস্ত মহানগরী বা শহুরে সংস্কৃতি থেকে দূরে গ্রামীণ মনোরম পরিবেশে বেসরকারি উদ্যোগে জহুরুল ইসলামের শিক্ষা প্রকল্প ঘুরে এলে বোধসম্পন্ন যে কোনো মানুষই বিস্মিত হবেন। মনের অজান্তেই প্রশ্ন আসবে, বেসরকারি উদ্যোগে কি এমন আয়োজন সম্ভব! বাজিতপুর থানা ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেই প্রাচীন। কিন্তু এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল বরাবরই দুর্বল। ব্যতিক্রমী শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে ইতিহাসের জন্ম দিয়ে জহুরুল ইসলাম নিজেও ইতিহাস হলেন। তিনি নিজে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন না। স্থানীয় প্রাইমারি স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণী শেষ করে কিছুদিন সরারচর শিবনাথ হাই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। এরপর ভর্তি হন বাজিতপুর হাই স্কুলে। কিছুদিন পর চাচা মহকুমা প্রকৌশলী মুর্শিদ উদ্দিনের সঙ্গে চলে যান কলকাতায়। সেখানে ইংরেজি মাধ্যমে কলকাতা রিপন হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন শেষ করেন। এরপর ভর্তি হন বর্ধমান জেলার এক কলেজে। সেখান থেকে চলে আসেন মুন্সীগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে। প্রতিকূল পরিবেশ ও পারিবারিক দায়দায়িত্বের চাপে তার লেখাপড়া আর এগোয়নি।
তার কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৪৮ সালে। মাত্র ৮০ টাকা মাসিক বেতনে সিঅ্যান্ডবির ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্টের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। তিন বছর পর ১৯৫১ সালে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে শুরু করেন ঠিকাদারি ব্যবসা। এ জীবনের শুরুতে তিনি কিশোরগঞ্জ পোস্ট অফিস নির্মাণের কাজ পান। পরে পান গুলিস্তান থেকে টিকাটুলী সড়কের কাজ। এরপর তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। কাজের সততা ও গুণমানে মাত্র দুই বছরের মাথায় তিনি নিজেকে একজন প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হন। আর্থিক অবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার বাবার ১৩ সদস্যের পরিবারকে নিয়ে আসেন ঢাকায়। ভাইবোন_ সবাইকে উচ্চশিক্ষার পথে ধাবিত করেন। এ ১৩ সদস্যের একান্নবর্তী পরিবার এক সময় রূপ নেয় বিশাল এক পরিবারে, যা তিনি ধরে রেখেছিলেন ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। স্ত্রী সুরাইয়া বেগম ছিলেন তার জীবনের অগ্রযাত্রার সহযাত্রী তথা অনুপ্রেরণা।
অন্তর্দৃষ্টি ও দূরদৃষ্টি_ এ দুই দৃষ্টির সমন্বয়ে জহুরুল ইসলামের মধ্যে ছিল দ্বিমুখী মননশীলতা। কাছে-দূরে সমানতালে দেখা ও পর্যবেক্ষণের এ দ্বিমুখী ক্ষমতা ছিল বিশ্বের খুব কমসংখ্যক মনীষীরই। বর্তমানকে যথাযথভাবে উপলব্ধি এবং ভবিষ্যৎ নির্ধারণের এ অনন্য ক্ষমতাকে অনেকে ঐশ্বরিক মনে করে থাকেন। অতুলনীয় প্রজ্ঞা, দৃঢ়তা, বিচক্ষণতা, তাকে ব্যবসা, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সমাজসেবা ইত্যাদিতে উদ্ভাবনী শক্তি জুগিয়েছে। আমাদের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও একাত্তরের যুদ্ধে জহুরুল ইসলামের অবদান আমাদের ইতিহাসেরই অংশ। তিনি ফলাও করে বা প্রচারের উদ্দেশ্যে কখনও ওই অবদানের কথা উল্লেখ করতেন না। বরাবরই দান-অনুদানের মতো মহৎ কাজগুলোতে তিনি গোপনীয়তা রক্ষা করতেন। তার সেই বিশেষ অবদান প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বিচারপতি মরহুম আবু সাঈদ চৌধুরীর লেখা, 'প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি' নামে গ্রন্থে কিছু উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, জহুরুল ইসলাম ১৯৭১ সালের ১০ জুন ঢাকা ত্যাগ করে লন্ডন চলে যান। সেখানে তিনি সুবেদ আলী ছদ্মনাম ধারণ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কার্যক্রম চালাতে থাকেন। সেই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে মরহুম আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে মোটা অঙ্কের নগদ অর্থ প্রদান করেন। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খানের লেখা 'স্বৈরাচারের দশ বছর' গ্রন্থেও উল্লেখ আছে_ জহুরুল ইসলাম ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় পাকিস্তান সরকারের জেলে আটক নেতাকর্মীদের মোকদ্দমাদির খরচ, আহতদের চিকিৎসার খরচ জোগাতেন। ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার খরচও দিয়েছেন। এভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধে নীরবে-নিভৃতে নিজেকে সম্পৃক্ত করে নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিকের ভূমিকা পালন করেছিলেন জহুরুল ইসলাম। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে জহুরুল ইসলামের ছিল ব্যক্তিগত হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। বঙ্গবন্ধু তাকে 'হাজি সাহেব' নামে ডাকতেন। বিনয়, উদারতা, আতিথেয়তা, পরোপকার ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য ছিল তার ছোটবেলা থেকেই। পরে কর্মজীবনে এসব বৈশিষ্ট্যের আরও বেশি প্রকাশ ঘটেছে। কখনও তিনি একা খেয়েছেন এমন নজির খুব কম। খাওয়ার টেবিলে মানুষ কম থাকলে তিনি খাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ পেতেন না। এ দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিসেবীসহ সৃষ্টিশীলদের সঙ্গে ছিল তার আত্মার সেতুবন্ধ। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ ও অগ্রযাত্রা এবং সৃষ্টিশীল কাজে তিনি সহযোগিতা করেছেন উদারভাবে। সেসব সহায়তা, দান-অনুদানের কথা তিনি প্রকাশ করতেন না। ছোটবেলা থেকেই তার খুব ঝোঁক ছিল খেলাধুলার প্রতি। কর্মময় জীবনে তিনি ছিলেন মোহামেডান ক্লাবের অন্যতম সদস্য। মোহামেডানের উন্নয়নে তার বরাদ্দ তথা অবদান ছিল বিস্তর। 'নাভানা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট' তার ক্রীড়াঙ্গনের প্রতি প্রীতিময়তার এক স্মারক।
জহুরুল ইসলাম ছিলেন ধর্মাচারী ব্যক্তিত্ব। তবে তার ধর্মকর্ম চর্চায় ছিল ব্যতিক্রমী ধারা। দীন-দুনিয়াকে তিনি খুব আলাদাভাবে দেখতেন না। তিনি মনে করতেন, দুনিয়া দীনের বাইরে নয়, আবার দীনও দুনিয়ার বাইরে নয়। পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান ইসলামের আদর্শে উজ্জীবিত জহুরুল ইসলাম নিকটজনদের বলতেন, জীবনের সব কিছু দীনের আওতায়। শুধু নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদিই দীনের কাজ নয়। সেই চেতনা থেকেই তিনি নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, মসজিদ-মাদ্রাসা-এতিমখানা নির্মাণের পাশাপাশি সমাজ ও দেশ গঠনেও সচেষ্ট ছিলেন দুর্বারগতিতে। দুর্বার পথচলা ও কর্মচাঞ্চল্যের মধ্যেও তাকে কখনও নামাজ কাজা করতে দেখা যায়নি। দেশপ্রেমকেও তিনি দেখতেন দীন-দুনিয়ার অংশ হিসেবে। এ প্রেমসাধনা যে তিনি শুধু '৭১-এ করেছেন তা নয়। '৭১-এর আগে-পরেও সারাক্ষণ দেশ গঠন ও দেশ সমৃদ্ধকরণে তিনি ছিলেন সাধকের ভূমিকায়।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
mostofa71@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.