মেয়ের বেলায় এক বউয়ের বেলায় আরেক by রুহিনা তাসকিন

ম-কাঁঠালের ছুটিতে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে মেয়ে বেড়াতে এসেছে বাপের বাড়ি। মায়ের খুশির অন্ত নেই। রান্নাঘর সরগরম। আড্ডা-হইচই। কদিন পর ফিরে গেছে ওরা নিজের বাড়িতে। ছেলের বউ এবার জানাল, তার বাপের বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে চায় সে। অমনি শাশুড়ির মুখ ভার। বাড়িটা খুব ফাঁকা ঠেকছে। এখনই বউয়ের যেতে হবে বাপের বাড়ি! নিজের ঘরে গিয়ে মোবাইল ফোন চাপলেন, মেয়ের কাছে কল। ‘তোরা গেলি আর বউও চলল বাপের বাড়ি।’


সিরিয়ালের চিত্রনাট্য মনে হচ্ছে কি ওপরের কথাগুলো? ভুক্তভোগী মাত্রই বুঝবেন, এটা একদম বাস্তব চিত্র। মেয়ের বেলায় যা মায়ের কাছে খুব স্বাভাবিক, ছেলের বউয়ের বেলায় সেই একই ঘটনা ফুলেফেঁপে তাল হয়ে যায়।
আশাপূর্ণা দেবীর সুবর্ণলতার যুগ থেকে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি আমরা।
মেজো বউ সুবর্ণর সবই বাঁকা। আর নিজের ছেলেমেয়েরা হীরার আংটি। বাঁকা হলেও ক্ষতি কী? শাশুড়ি স্বর্ণর এই দর্শন খোলাখুলি মানেন, এমন শাশুড়ি বোধ হয় এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবু অবচেতনেই কি চলে আসে একটু পার্থক্য?
বউ বলে আর ডাকা হয় না। আজকাল ছেলের বউকে নাম ধরে ডাকারই চল। তবু বাড়ির মেয়েটির মতো না হয়ে ছেলের বউই রয়ে যায় মেয়েরা শাশুড়ির কাছে। মা বলে ডাকা হলেও শাশুড়িই রয়ে যান তিনি। আর এর প্রভাব পড়ে ননদ-ভাবি, এমনকি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কেও। নাদিয়া (ছদ্মনাম) মনে করেন তা-ই, ‘আমার স্বামী এত কিছু বোঝে না। আমাদের সমস্যা মেটাতে গিয়ে উল্টো ও-ই বিপদে পড়ে। অনেক সময় শাশুড়ি সরাসরি অভিযোগ করেন আমার বিরুদ্ধে। আর আমাকে বাঁচাতে গিয়ে মায়ের কাছে দোষী হয় সে।’
টিভি সিরিয়ালে দেখানো বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্ব আর সংঘাত বাস্তবে হয়তো ঘটে না।
কিন্তু সূক্ষ্ম একটা রেষারেষি যেন খুব সাধারণ ঘটনা। রোজকার জীবনের নানা উপলক্ষে বেরিয়ে আসে তার দৃষ্টিকটু রূপটা। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত তাসমিয়া (ছদ্মনাম) বলেন, ‘ঈদের সময় শাশুড়ির কাপড়টা একটু বেশি ঘুরেই কিনি। তবু আজ পর্যন্ত তাঁর মনমতো হলো না। অথচ আমি নিশ্চিত, একই কাপড় তাঁর মেয়ে দিলে তিনি দারুণ খুশি হতেন। আবার আমার শ্বশুর সব সময় আমার আর তাঁর মেয়ের জন্য একই রকম কাপড় কেনেন। এটা নিয়েও যেন কষ্ট পান শাশুড়ি।’
শ্বশুরবাড়ি আর বাপের বাড়ির পরিবেশে একদম আকাশ-পাতাল পার্থক্য মনে হয়
নাদিয়ার কাছে, ‘আমার মাকে দেখেছি ছেলের বউয়ের সঙ্গে অনেক বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতে, যেটা আমি শ্বশুরবাড়িতে পাইনি। আমার ননদ-ননাসেরা যেন আমাকে প্রতিপক্ষ ভাবেন। আমার বাড়িতে কী রান্না হয়, আমি কেমন পোশাক পরি—সবকিছুতেই তাদের দখলদারি থাকা চাই। দেখা গেল, পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠানে আমি একটি শাড়ি পরেছি। আমার ননদ পরদিন ঠিক একই রকম শাড়ি কিনে আনলেন। ব্যাপারটা হয়তো খুব তুচ্ছ। কিন্তু এ যেন সূক্ষ্মভাবে আমাকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা।’
ননদ-ভাবি অনেক সময় একই বয়সী হয়েও কাছাকাছি আসতে পারেন না। সম্পর্কটা বন্ধুর মতো না হয়ে যেন প্রতিপক্ষের হয়ে দাঁড়ায়। ব্যতিক্রমও অবশ্য দেখা যায়। তাসমিয়া (ছদ্মনাম) মনে করেন, ‘মা আর মেয়ে দারুণ বন্ধু হলে যেন তারা দুজনে মিলে ভাবিকে একটা আলাদা দলে ফেলে দেয়। আবার মেয়ের যদি বাইরে একটা আলাদা জগৎ থাকে, বন্ধু থাকে, তাহলে সে ভাবিকে বুঝতে চেষ্টা করে। ভাবির হয়ে মাকেও বোঝানোর চেষ্টা করে।
আমার অনেক সৌভাগ্য যে আমার শ্বশুরবাড়ির আর কেউই শাশুড়ির মতো একগুঁয়ে নন।’ তাসমিয়া হাসেন।
দুই পক্ষের এই যে দ্বৈরথ, একই পরিবারে থেকেও পরস্পরকে আপন করে নিতে না পারা। এর জন্য কি শুধু মায়েরাই দায়ী?
বর্ষীয়ান এক মায়ের কথা শুনি তাঁর মেয়ে আনোয়ারা চৌধুরীর (ছদ্মনাম) মুখে, ‘ছেলের বউকে ঘরে এনে মা বলেছিলেন, “ওকে কিন্তু আমি একটু বেশি ভালোবাসব। তোরা কেউ মন খারাপ করবি না।” আমরা কিছু মনে রাখিনি। কিন্তু আজ মায়ের অবস্থা দেখলে সত্যিই কষ্ট হয়। ছেলেদের কাছে যেন মা আর আগের মতো আপন নেই।
এ জন্য কি মায়ের সেই একটু বেশি ভালোবাসাই দায়ী?’ মা যদি ছেলের ওপর নির্ভরশীল হন, তাহলে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। এমন মত বিশেষজ্ঞর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন মনে করেন, ছেলের ভূমিকা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। মা আর স্ত্রী দুজনই তাঁর কাছের মানুষ। কারও জায়গা কেউ দখল করে নিচ্ছে না, এটা দুজনকেই বুঝিয়ে বলতে হবে। তবে ছেলের বউ যেহেতু পরিবারের নতুন সদস্য, মাকেই তাই এগিয়ে আসতে হবে।
শিক্ষা আর প্রচারের ফলে এই দূরত্ব অনেকটা কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি। কিছুদিন আগেই ছেলের বিয়ে দিয়েছেন বিলকিস চৌধুরী। তিনি মনে করেন, মেয়ে আর ছেলের বউয়ের মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য আছে। আর সে জন্যই বউকে বেশি আদর করতে হবে। ‘আমার রাইসাকে (মেয়ে) বকলে, আদর না করলে কীই-বা আসে-যায়। ও তো আমার মেয়েই। কিন্তু মেহনাজকে (বউ) তো এখন আপন করে নিতে হবে। আমাদের পরিবারে যাতে মানিয়ে নিতে পারে, মা-বাবাকে বেশি মিস না করে, সেটা আমাকেই দেখতে হবে। আমার শাশুড়িকে খুব ভয় পেতাম; ভাবতাম, তিনি যদি আমাকে আর একটু ভালোবাসতেন, আমি তাঁর দশ গুণ করতাম। আর তখনই ভেবেছি, আমার ছেলের বউকে যেন এমন অবস্থায় পড়তে না হয়,’ বলেন তিনি।
এই পরিবারের মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া রাইসা তাসনুভা মনে করেন, বোন আর ভাবির স্থান এক নয়। ‘বোনের সঙ্গে ঝগড়া, বেয়াদবি কত কিছু করি। আবার সব ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু ভাবির সঙ্গে এমন করার কথা চিন্তাও করি না। তবে আস্তে আস্তে আমরা অনেক সহজ হচ্ছি।’
ছেলের বউ মেহনাজ কাজ করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। চাকরির ক্ষেত্রে পরিবার থেকে সহযোগিতাই পেয়ে আসছেন। তিনি বলেন, ‘আমি, আমার স্বামী আর ননদ সবাই এই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছি। কাজেই আমাদের কাজের ক্ষেত্র কেমন হতে পারে, কেমন চাপ থাকবে এটা তো পরিবারের অন্যরা জানেই। আমার ব্যস্ততা বা ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবাটা তাই পরিবারে খুব স্বাভাবিক বলেই ধরে নেওয়া হয়। তবে বোধ হয় অন্য মেয়েরা আমার মতো সুবিধা পায় না। আর নতুন পরিবারে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা তো দুই পক্ষ থেকেই থাকতে হবে। আমার শাশুড়ি যেমন আমাকে আপন করে নিতে চেষ্টা করছেন। আমার দিক থেকেও একই রকম চেষ্টা থাকছে।’

ছবি তুলেছেন খালেদ সরকার। ছবিগুলো প্রতীকী। নারীমঞ্চের আয়োজনে মডেল হয়েছেন নাসিম ইকবাল, তানজিম ইকবাল আলী, তাবিতা জহুর

No comments

Powered by Blogger.