শু ক্র বা রে র বিশেষ প্রতিবেদন-বিদ্যাপীঠের প্রাণ by জুয়েল খান

রোজ সকালে বিদ্যালয়ের ফটকটি নিজ হাতে খোলেন। তারপর একে একে খুলে দেন শ্রেণীকক্ষের দরজা-জানালা। যেন-বা জ্ঞানের একেকটি দ্বার খুলে দিচ্ছেন—এমন পরমানন্দ তাঁর হূদয়ে বাজে। সাফ-সুতরো শেষ হতে না-হতে শিক্ষার্থীরা এসে পড়ে। এবার তাদের পড়ানোর পালা। সে কাজটিও করেন তিনি পরম মমতায়। পাঠ শেষে ঘণ্টা বাজান। ছেলেমেয়েরা হৈ-হুল্লোড় করে বিদ্যালয় ছাড়ে। পড়ন্ত বিকেলে তালা ঝুলিয়ে তবেই তাঁর ছুটি।
তিনি শামসুর রহমান (৫৯); সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার কামালগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ৪০ বছরের শিক্ষকতা-জীবনে এই রুটিন মেনে আসছেন তিনি। দীর্ঘ এ সময়ে এক দিনের জন্যও বিদ্যালয় থেকে ছুটি নেননি। তাঁর এই নিষ্ঠা ও একাগ্রতার বলে বিদ্যালয়টি ২০০৪ সালে সিলেট বিভাগে অষ্টম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের স্থান অধিকার করে।
অকৃতদার এই মানুষটির বাড়ি দক্ষিণ সুরমার নিয়ামতপুর (শান্তিবাগ) গ্রামে। কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় শিক্ষকতা শুরু করেন। সে ১৯৭০ সালের কথা। কামালগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই শিক্ষকতার মহান ব্রতে নামেন। তখন বিদ্যালয়টি ছিল বেসরকারি। ১৯৭৩ সালে সরকারি হয়। বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের দায়িত্ব পান শামসুর রহমান। ১১ বছর পর প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন। তখন থেকে তাঁর একটাই ধ্যান-জ্ঞান, কীভাবে বিদ্যালয়টিকে শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করা যায়। নিয়মানুযায়ী চাকরি থেকে অবসরে যান ২০০৯-এর ৩১ জানুয়ারি। কিন্তু শিক্ষকতা থেকে অবসর নেননি। অবৈতনিকভাবে তিনি প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আজও শিক্ষকতা করছেন। শুরু থেকে যে কাজগুলো করতেন এখনো তা করে চলেছেন।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালে এখান থেকে চারজন ট্যালেন্টপুলে ও চারজন সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পায়। আগের বছর সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি ছিল দুটি। এই দুই বছরে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে। শামসুর রহমান ছাড়াও নয়জন শিক্ষক আছেন বিদ্যালয়টিতে। কোনো কর্মচারী নেই। বছর খানেক ধরে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে একজন কর্মচারী রাখা হয়েছে। শামসুর রহমানের বয়স হয়ে যাওয়ায় তাঁকে সহায়তার জন্যই কর্মচারী রাখা, জানালেন পরিচালনা কমিটির এক সদস্য।
বিদ্যালয়ে একদিন: সম্প্রতি কামালগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরেজমিনে দেখা যায়, শামসুর রহমান দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়াচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা তাঁর সঙ্গে সমবেত স্বরে কবিতা আবৃত্তি করছে। ক্লাস শেষে কথা হয় শিক্ষার্থী সাজ্জাদ হোসেনের সঙ্গে। সে বলে, ‘স্যার আমরারে খুব মায়া করইন। তাইন ক্লাসো আইলে খুব ভালা লাগে।’ পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র আরাফাত রহমান বলে, ‘স্যার আমরার বাপ-মা। তাইন আমরার সব খবর রাখইন। কিছুতা লাগলে তাইন কিইন্না দেইন।’
অভিভাবক রেণু বেগম বলেন, ‘শামসুর রহমান স্যার থাকায় বাচ্চাদের বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকি। কোনো ছাত্রছাত্রী অসুস্থ হলে তিনি দেখতে আসেন।’
বিদ্যালয়টির বর্তমান প্রধান শিক্ষক শাহীন সুলতানা বলেন, ‘শামসুর রহমান স্যার বিদ্যালয়টির প্রাণ। বিদ্যালয়ের সবকিছু স্যার নিজে করেন। এখানে ৩৭৫ জন শিক্ষার্থী আছে। প্রতিষ্ঠানটিকে সিলেটের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচিতি এনে দিয়েছেন তিনি।’
বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি ওসমান গণি বলেন, ‘স্যার শিক্ষাঙ্গনের রোল মডেল। এই প্রতিষ্ঠানে তিনি ৪০ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন। অবসর গ্রহণের পর থেকে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষকতা করছেন। বিদ্যালয়ের সব কাজ তিনি একাই করেন। ব্যতিক্রমী শিক্ষক, সাদা মনের মানুষ তিনি।’
আলাপ হয় শামসুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘৪০ বছরে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকিনি বা নৈমিত্তিক ছুটি ভোগ করিনি। এটা এমন কিছু না। তবে বিদ্যালয়টা আমার প্রাণের স্পন্দন।’ স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘মা তখন মৃত্যুপথযাত্রী। পরিবারের সবাই চিন্তায় অস্থির। আমি তখন সৃষ্টিকর্তার কাছে একটাই প্রার্থনা করেছিলাম, এমন একটা দিনে যেন তাঁর মৃত্যু হয় যেদিন আমার বিদ্যালয় বন্ধ থাকে। শুক্রবার তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।’ মায়ের কথা বলতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন শামসুর রহমান। বিয়ে করে সংসার করেননি এতে কোনো আক্ষেপ নেই। বিদ্যালয়ই তাঁর সংসার। তাঁর চাওয়া একটাই—এখানেই যেন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারেন।
দক্ষিণ সুরমা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আবদুল মুনতাকিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে যোগদানের পর থেকেই বিদ্যালয়টির সুনাম শুনে আসছি। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা শুরুর পর থেকে এখানে শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করছে। শিক্ষক শামসুর রহমান আমাদের শিক্ষাঙ্গনের জন্য দৃষ্টান্ত।’

No comments

Powered by Blogger.