গল্প-খেরোখাতার জীবন by শরীফ আতিক উজ জামান

পেছন থেকে চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে যখন একগাদা লোকের ভেতর দিয়ে তাকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসছিল তার মা, তখন নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিল পুটে। কিন্তু তেল-সাবান না পড়া রুক্ষ আঠালো চুলে ওর মায়ের খসখসে হাতের মুঠোটা এমনভাবে বসে গিয়েছিল যে, তা কোনোমতেই ছাড়াতে পারছিল না। ১২-১৩ বছর বয়সী একটি ছেলের শরীরে যেটুকু জোর থাকা উচিত, অপুষ্টির শিকার পুটের শরীরে তা নেই।


তবে মুখের জোরটা ঠিকই আছে। মায়ের সঙ্গে গায়ের বলে না পারলেও সে খিস্তিখেউরে কম যাচ্ছিল না। কারণ, তাকে যখন টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন তার সমবয়সী ইয়ার-দোস্তরা দেখছিল আর দাঁত বের করে হাসছিল, যা দেখে পুটের রাগ আরো বেড়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, কোনোভাবে ছুটে গিয়ে ওদের দাঁত কেলানো বের করে দিয়ে আসে। কিন্তু ওর রোগাপাতলা মায়ের গায়ে আজ যেন অসুর ভর করেছে। কোনোভাবেই চুলধরা মুঠোটাকে আলগা হতে দেয় না সে।
'খান্নাছের বাচ্চা, তোরে কই হক্কালে উইডা ভাই-বইন দুইডার লগে খেলা কর, তাইলে আমি তাড়াতাড়ি মাইনষের বাড়ির কামগুলান সাইরা দিয়া আইবার পারি; তা না, হ্যায় সিনেমা হলের সামনে যাইয়া খাড়ায়া থাহে। হা কইরা নায়ক-নায়িকাগোর ছবি দ্যাখলে প্যাটে খাওন জুটবো রে হারামজাদা? তোরে না কইছি, জুম্মাবারে বাড়ির থনে কুনুহানে নড়বি না, জুম্মাবারে বাসাবাড়িতে কামের চাপ বেশি। তা শোনোস না কেন রে শয়তানের বাচ্চা?' এ পর্যায়ে অন্য হাতে পুটের পিঠে দুমদাম কয়েক ঘা বসিয়ে দেয় তার মা। পুটে ফুঁসতে থাকে। সেও সমান তালে মুখ চালাতে থাকে_
মারবি না কইলাম, ভালো হইব না, একদিন বাড়ি ছাইড়া চইলা যামু, তহন বুঝবি।
এহ্, বাড়ি ছাইড়া যাইব। কুন চুলায় যাইবিরে হারামির ছাও? কেডা তোরে খাওন দিব? যা না, মুরাদ থাহে তো যা, কইরা-ধইরা আন। এত বড় দামড়া হইছস, বইয়া বইয়া গিলোস।
খালি আমারে কইবার পারো। বাজানে কী কামডা করে হুনি। হারাদিন হয় হুইয়া থাহে, নয় খয়বরের দোহানের সামনে ক্যারাম খেলে। তারে কিছু কইবার পারো না? কইলে তো তোমারে ধইরা...
এ কথার কোনো উত্তর দেয় না পুটের মা। টানতে টানতে ওকে এনে ফেলে বস্তির যে ঘরটায় ওরা থাকে, তার সামনে। সেখানে মাটিতে উদাম পাছায় থেবড়ে বসে ওর ছোট বোনটা কাঁদছে। আর একেবারে গেদা ভাইটা, যে এখনো বসতে শেখেনি, উপুড় হয়ে নিজের পায়খানা-পেচ্ছাবের মধ্যে হুটোপুটি খেলছে। হাতেও মাখিয়েছে। দুই নাকের ফুটো বেয়ে ঝুলে থাকা হলুদ সর্দির সঙ্গে হলুদ মল লেগে বিমূর্ত চিত্রকলার মতো মনে হচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে পুটের মায়ের মাথা আরো গরম হয়ে গেল। শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুঁজে সে খপ করে ছেলেটার একটা হাত ধরে উঁচু করে তুলে নাতা ছেঁড়া থলের মতো টানতে টানতে পাশের পরিষ্কার জায়গাটায় ধপ করে আছড়ে ফেলে ছাপড়ায় ঢুকে একটা ভাঙা বালতিতে আধবালতি পানি এনে উদাম ছেলেটার গায়ে ঢেলে দিল। তারপর এক মুঠ ঘাস ছিঁড়ে তাই দিয়ে ঘসে ঘসে তার গা-পাছা-পা পরিষ্কার করতে লাগল আর মুখে গজগজ করেই চললম-
মরণ আমার, হক্কালবেলা একজন অহনো নাক ডাইকা ঘুম পাড়বার নাগছে, আর একজনে সিনিমার নায়ক-নায়িকার ছবি দেখবার লাইগা হলের সামনে হা কইরা খাড়ায়া রইছে। আর এদিকে এইডায় হাইগা-মুইতা সয়লাব করছে। আজ কামে যাইতে দেরি হইব, আর বেগম সাহেবার ঝাড়ি খাওন লাগব। অগের কী? বইয়া বইয়া খাওন পাইতাছে, জমিদারের বংশদর সব।
এতক্ষণে চিল্লাফাল্লা শুনে ছাবড়ার ভেতর থেকে পুটের বাপ বেরিয়ে আসে। চোখ-মুখ কুঁচকে চরম বিরক্তি ভরে জিজ্ঞেস করে_
আরে হইছেডা কী? এই হাত-হক্কালে চিল্লাইতেছ ক্যা? তুমাগের লাইগা এট্টু শান্তিমতো ঘুমাইবারও জো নাই দেখতাছি।
হাত-হক্কাল, না? বেল গড়াই কুনহানে গেছে, দ্যাখতে পাও না? চোখ থাকলে তো দ্যাখবা। জোরে জোরে ছেলেটার গা-হাত-পা ঘষতে থাকে পুটের মা। ছেলেটি ক্যাঁ ক্যাঁ করে কেঁদেই চলে। এরপর ঘষা বাদ দিয়ে বালতিটা হাতে করে ঘরে ঢোকে। ঘড়ায় রাখা পানি থেকে আধবালতি পানি গড়িয়ে দিয়ে ঢেলে ঢেলে ভালোভাবে ধুয়ে ছেলেটাকে সাফ করে পুটের কোলে নিয়ে ফেলে। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে বলে, 'ঠিকমতো দেইখ্যা রাহিস। আমি কামে গেলাম। আর হাঁড়িতে ভাত ঢাকা দেওয়া আছে, খাইয়া লইস। ফের যদি তোরে সিনেমা হলের সামনে দেখছি, ঠ্যাং ভাঙ্গি ফালামু।'
'আবার অয় হলের সামনে গেছিলোনি। তোরে না কইছি...'_তেড়ে এসে পুটের বাপ ঠাস করে একটা চড় লাগিয়ে দেয় পুটের গালে। ছোট ভাইটাকে কোলে নিয়ে সে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। কোনোমতে সামলে নেয়, কিন্তু রাগে ফুঁসতে থাকে। পুটের মা এগিয়ে আসে ঠেকাতে। কিন্তু তার আগেই থাপড়টা লেগে যায়। স্বামীর দিকে তাকিয়ে ঝাঁজের সঙ্গে বলে_থাক, তুমার আর শাসন করা লাগব না। দয়া কইরা আইজ এক বেলা রিশকা চালাইয়ো, ঘরে চাইল নাই।
আইজ না জুম্মাবার। নামাজ পড়তে যাইতে হইব, আইজ পারুম না।
সওয়াব কামাইবা? নামাজ পড়লে সওয়াব হয়, পোলাপাইনের মুখে খাবার জুগাইলে হয় না?
পুটের বাপ কী যেন বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু সেই সুযোগ না দিয়ে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে যায় পুটের মা, 'আমার হইছে মরণ, ব্যাডায় গতরসুগা, এক বেলা রিশকা চালাইলে দুই বেলা তার গা-হাত-পা টেপন লাগে। সারাদিন কামের পর নিজে এট্টু হুইবো কি, তা না; হের গা-হাত-পা টেপো। হ্যারে রিকশা চালাইতে যাইতে কইতেও ইচ্ছা করে না।' এখানেই বিষয়গুলো শেষ নয়, বাকিগুলো সে আর মুখে বলতে পারে না। দিনে হাড়ভাঙা খাটুনির পর প্রতি রাতে আছে সোহাগের যন্ত্রণা। সোহাগ না করতে পারলে তার আবার রাতে ভালো ঘুম হয় না। ছেলেমেয়েগুলো না ঘুমানো পর্যন্ত শুধু এপাশ-ওপাশ করতে থাকে। ওদের শ্বাস ঘন হলেই সে শরীরের ওপর চড়ে বসে। শরীর ভালো না থাকলেও তাকে গরম করা লাগে। কতদিন বলেছে, 'কী করো, রোজ রোজ এক কাম। নামো তো, ভালো লাগে না।' কিন্তু শোনে না। ব্যাটা মানুষের এই খাসিলত কি সবার সমান? বেশি জোরাজুরি করলে কয়, 'ক্যারে মাগি, কুনহানে গেছিল যে, আমারে ভালো লাগতাছে না?' রাগে ফোঁসে সে, কিন্তু কিছু বলে না। ছেলেমেয়ে তিনটে জেগে যাবে বলে মটকা মেরে পড়ে থাকে। তার ওপর আবার সুখবেলুন পরতে বললে রাগ হয়। সুখবেলুনে নাকি সুখ হয় না। 'বেশি হুখ পাইতে গিয়াই তো তিনডা ফুটছে। মনে হয় লাত্থি দিয়া দূর করি দেই'_রাগে দাঁত কিড়মিড় করে পুটের মা। কিন্তু কী করবে? ব্যাটা মানুষ না থাকলে ওই বস্তির মধ্যে থাকা যায় না, মেয়ে মানুষগুলো মুরগির মতো হয়ে যায়, আশপাশে শেয়াল ঘুরঘুর করতে থাকে। তাই তো পুটের বাপকে সে জোর দিয়ে কিছু বলতে পারে না। বাসাবাড়িতে কাজ করে এনে খাওয়ায়। তার একটা স্বামী আছে, এর জন্যই তাকে নিয়ে কেউ টানাহেঁচড়া করে না। নইলে বস্তির ফেলানি-কাশেম-রুস্তম-শহীদরা যে হারামি। স্বামী ছেড়ে গেলে সালমারে ওরা কী জ্বালাতনই না করল। মেয়েটা শেষমেশ শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেল। কেমন আছে গেদা বাচ্চাটাকে নিয়ে, কে জানে। আর কোথায়ই বা তারা নিরাপদ? বড় সাহেবরাই বা কম যায় কিসে? এক দিন বেগম সাহেবা বাড়িতে না থাকলেই তো টাকা সাধে। আগে দু-তিনটি বাড়ি ছেড়েছে তো সাহেবদের জন্যই। "গরিব মাইনষের বেডিরা হগ্গোলের ফাও মাল হইয়া যায়। পোলাডা সত্যি কথাই কয়_'বাজানে তো কাম করে না, হ্যারে কিছু কও না ক্যান?' ক্যান যে কই না, তা তুই কী বুঝবি? আমার কষ্ট তুই কি বুঝোস? তর ধাত যা দ্যাখতাছি, তাতে ভালো কিছু তো মনে অইতাছে না।"_একা একাই বিড়বিড় করে পুটের মা।
কলিং বেল টিপলে বেগম সাহেবা দরজা খুলেই ঝনঝন করে ওঠে, 'তোমার আক্কেলটা কেমন পুটের মা, আজ না শুক্রবার, কাজের চাপ বেশি, তাড়াতাড়ি আসার কথা। থালা-বাসন ধোয়া, মাছ-তরিতরকারি কোটা, কাপড় কাচা, ঘর মোছা, রান্নাবান্না কখন করবে তুমি?' কোনো কথা বলে না পুটের মা। তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গিয়ে ঢোকে। শুধু বিড়বিড় করতে থাকে, 'শুক্কুর বার না, আমার মরণবার। এই বার আইলে পোলায় হক্কালে চলি যায় সিনিমা হলের সামনে, নতুন কী বই লাগছে তার ছবি দ্যাখতে। হের বাপে উডে দেরি করি, তারপর ক্যারাম খেলবার যায়। আর বাসাবাড়িতে বেগম সাহেবাগোর কাম বাড়ি যায়, আমার হইছে মরণ।'
বাপের হাতে থাপড় খেয়ে পুটে ফুঁসতে থাকে। গেদা ভাইটা তার কোলের মধ্যে শরীরের সঙ্গে বাদুড়ের মতো লেপ্টে ঝুলতে থাকে। ওদিকে মাটির ওপর বসে ফেদি ঘ্যান ঘ্যান করতেই থাকে। খুব কষে ধমক লাগাতেও ভয় পায়_শেষে চিৎকার করে কেঁদে সারা বস্তি মাথায় করে ফেলবে। মা ফিরে না আসা পর্যন্ত তাকে ওদের সামলাতে হবে। মাঝে মাঝে ওরা যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখনই ওর একটু শান্তি। কী করবে সে? মা কাজ না করলে খাবে কী? 'বাপটা শালা হারামজাদা', দাঁত কিড়মিড় করতে থাকে সে। যখন হাতে আর পয়সাকড়ি থাকে না, তখন একবেলা মনে হলে রিকশা চালায়। নইলে তার মায়ের জমানো টাকা চুরি করে। খুঁজে না পেলে চায়। মা দিতে না চাইলে মারধরও করে। খানিক আগে গোসল করে হাঁড়ি থেকে ভাত বেড়ে খেয়ে সেজেগুজে বের হয়ে গেল। 'নিচ্চিত, খয়বরের দোকানের সামনে ক্যারাম খেলাইবার নাগছে', বিড়বিড় করে পুটে। মায়ের ফেরার ঠিক আগে আসবে। মা খাওয়া নিয়ে এলে খেয়েদেয়ে লম্বা একখানা ঘুম দেবে। তারপর আবার বের হয়ে যাবে। এরপর ফিরবে সেই রাতে। ঠাণ্ডা ভাত আবার সে খেতে পারে না। যত রাতই হোক না কেন, মায়ের চুলা জ্বালিয়ে ভাত গরম করে দিতে হয়। কোনো কোনো দিন তরকারি পছন্দ না হলে সে দাঙ্গা-ফাসাদ বাধিয়ে দেয়। মা রাগ করে কয়, 'তুমি কি মুরগি-খাসি আইন্যা রাখছিলা যে, আমি বিরিয়ানি পাকাইয়া রাখমু?' এতে আবার তার অপমান হয়। উঠে তার মাকে লাগিয়ে দেয় কিল-থাপড়। মাটা যে কেন এত মার খায়, সে বোঝে না। মাঝেমধ্যে মনে হয়, বঁটি দিয়ে কোপ মেরে মাথা ফালা ফালা করে দেয়। কিন্তু পারে না। কিসের যেন বাধা, সে বুঝতে পারে না। এত দাঙ্গা-ফাসাদ, আবার মাঝরাতে কখনো ঘুম ভেঙে গেলে সে অন্ধকারে শুনতে পায় তার মা-বাবার চাপা হাসি। মা ধমক দেয়, 'আস্তে, পোলাপাইন জাইগা যাইব।' একই ঘরে মাদুর পেতে গাদাগাদি করে শোয়া, পাঁচজনের জায়গা হয় না। একজন নড়লে আরেকজনের ঘুম ভেঙে যায়। মা-বাপের কথা শোনার ইচ্ছা হয় না। ঘুমের ভান করে সে মটকা মেরে পড়ে থাকে। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে, নিজেও বুঝতে পারে না।
কোলের ভাইটা ঘুমিয়ে গেছে তার দুর্বল কাঁধে মাথা রেখে। তাকে ছেঁড়া মাদুরের ওপর শুইয়ে দিয়ে সে ঢাকা দেওয়া হাঁড়ির কাছে গেল। ঢাকনা তুলে দেখল, একমুঠ ভাত পড়ে আছে। পাশে বাটিতে রাখা তরকারিতে মাছের টুকরো-টাকরা কিচ্ছু নেই। যা ছিল বাপে গিলে গেছে। শুধু কয়েকখানা আলু পড়ে আছে। এখন তাকে কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ আর লবণ দিয়ে ভাত কয়টা চটকে খেতে হবে। ওদিকে ফেদিও খেয়েছে কি না কে জানে। তাকেও কয়টা দিতে হয়। কিন্তু ভাত যা আছে, তাতে তার একারই হয় না। সাধে কি ওর বাপের ওপর রাগ হয়। গেলার সময় একবারও ওদের কথা ভাবল না। তরকারির ডালাটা থেকে একটা পেঁয়াজ আর একটা মরিচ তুলে নেয় পুটে। পেঁয়াজটাকে বঁটিতে কেটে মরিচ-লবণ দিয়ে ভাত মেখে ফেদির হাত ধরে ছাপড়ার ভেতর এনে বসায়। মুখে ভাত তুলে দিতেই গপগপ করে গিলতে থাকে মেয়েটা। ওর খিদে দেখে নিজের আর এক লোকমাও খেতে ইচ্ছে করে না পুটের। যদিও ক্ষুধায় তার পেট চোঁ চোঁ করছে। কিন্তু অন্যের ক্ষুধা সম্পর্কে এতটুকু মেয়ের কোনো বোধ সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। তাই পুটেকে সে খাওয়ার কথা বলে না। ওই মুহূর্তে পুটে ভীষণ রেগে যায়, সবার ওপর। মা-বাবা, ছোট দুটি ভাইবোন_সবার ওপর। বোনের খাওয়া হয়ে গেলে ও টিনের বাটিটা ধুয়ে রাখল। বাসি পেটে ঢক ঢক করে এক মগ পানি খেল সে। এটুকুই জুটল সকালে। পানি খাওয়ার পর ফেদিকেও মগে ঢেলে পানি দিল। কিন্তু ফেদি আবার ঘ্যান ঘ্যান করতে লাগল। বোধ হয় এখনো ওর পেটে ক্ষুধা রয়েছে। কিন্তু হঠাৎই পুটের রাগ বেড়ে যায়। ঠাস ঠাস করে ফেদির গালে দুটো চড় কষে দেয়। চড় খেয়ে সে হাত-পা ছুড়ে আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। ছোট ভাইটা জেগে যাওয়ার ভয়ে পুটে তার মুখ চেপে ধরে বাইরে এনে ধপাস করে মাটিতে ফেলে দেয়। আবার পিঠে বসিয়ে দেয় দু-চার ঘা। মেয়েটি হা করে লম্বা দমে কাঁদতে থাকে। তার কান্না শুনে পাশের ছাপড়া থেকে দু-একজন মহিলা বেরিয়ে আসে। তারা পুটেকে বলে, 'ওই ছোড়া, মাইয়াডারে অমন কইরা মারস ক্যা? মায়া-দয়া নাই কুনো?' সেদিকে খুব একটা ভ্রূক্ষেপ করে না পুটে। সকালে মায়ের চুল ধরে হিঁচড়ে টেনে আনা, বাপের থাপড়, তার ওপর না খেয়ে থাকায় তার মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে আছে। অনেকক্ষণ ধরে ইনিয়েবিনিয়ে কেঁদে শেষমেশ ফেদি থামে। কিন্তু তার আগেই ছাপড়ার ভেতর গিয়ে ছোট ভাইটার পাশে শুয়ে পড়ে পুটে। আর কখন ঘুমিয়ে যায়, টের পায় না। ঘুম ভাঙে তার মায়ের হাঁকডাকে। বাড়ির কাজ সেরে সে ছেলেমেয়েদের জন্য খাবার নিয়ে যখন ফিরে আসে, তখন প্রায় তিনটা বাজে। এই সময়ের মধ্যে পুটে রোজই ভাইবোন দুটোকে গোসল করিয়ে নিজেও গোসল সেরে মায়ের খাবার নিয়ে আসার অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু আজ নিজেই ঘুমিয়ে পড়ায় তা আর হয়ে ওঠেনি। তা নিয়ে তার মা বকবক করল অনেকক্ষণ। 'অবরবেলায় গোসল করালে ঠাণ্ডা লাইগা যাইব' বলে পুটেকে যাচ্ছেতাই বলে গালমন্দ করল, 'হারামজাদার খালি সিনেমা হলে যাওয়া, জম্মের সিনেমা দেহনের নেশা, রাস্তার থনে পুরানা কাগজ কুড়াইয়া সেইহান থেইক্যা নায়িকাগোর ছবি কাইটা প্যান্টের পকেটের মদ্যে রাখছে, হেইদিন ধোওনের সময় দেখছি। খান্নাছের বাচ্চা, ধোন ফুটছে, যে ছেমরিগোর ছবি লই ঘুরোস?' মায়ের কথা পুটের শরীরে যেন আগুন ধরিয়ে দেয়। কিন্তু এখন সে আর কিছু বলবে না। কারণ, এখন মাকে খেপালে তাকে খেতে দেবে না, ঘর থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে। আগেও এমনটি করেছে। আর বাপটা তো হারামির হারামি। এখানে থাকলে এতক্ষণ পুটের পিঠে পড়ত কিছু। সিনেমা হলে যাওয়া নিয়ে অনেকবার মার খেতে হয়েছে তাকে। কিন্তু তার বাপকে সে দেখেছে গোলেনার সঙ্গে পাশাপাশি বসে সন্ধ্যার শোতে সিনেমা দেখতে। গোলেনা এক বারাসে নটি। গ্রাম থেকে এসেছে। স্বামী তাড়িয়ে দেওয়ার পর এই বস্তিতে এসে জুটেছে। আজ একজনের সঙ্গে, তো কাল আরেকজনের সঙ্গে ফিনিক দিয়ে বেড়ায়। সুগন্ধি তেল মেখে লাল ফিতায় দুই বেণি করে, কালো ঠোঁটে পুরু করে লাল লিপস্টিক লেপ্টে, হাঁসপেয়ে আঙুলে লাল নেইল পোলিশ মেখে ঝকমকে শাড়ি পরে এর-ওর সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। ওকে দেখলে পুটের ভালো লাগে না, কেমন যেন গা গুলায়। ওর ভালো লাগে পূর্ণিমা, শাবনুর, মৌসুমি আর পপিকে। শুক্রবার নতুন ছবি লাগলেই সে পোস্টার দেখতে ছোটে। প্রথম দিনই ছবিটা তার দেখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু হয় না। ১৫-২০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে সে সাধারণত ছবি দেখতে পারে না। থার্ড ক্লাসের গেটম্যান ফজর আলিকে দুই-তিন টাকা দিলে কিংবা বিড়ি-সিগারেট খাওয়ালে কোনো এক ফাঁকে তাকে ঢুকিয়ে দেয়। এভাবে দুই-তিন দিনে সে পুরো ছবিটা দেখে ফেলে। তবে প্রথম দিন ফজর আলি খুব ভাব নেয়, কথা বলতে চায় না, আবার সে একটা মেয়ে নিয়ে আসে, তাকে ঠিকই ঢুকিয়ে নেয়। পুটের খুব রাগ হয়, কিন্তু কিছু বলতে পারে না। আর যা-ই হোক, ফজর আলিকে খেপানো যাবে না। তাহলে সিনেমা দেখা শেষ। তাই সহ্য না করে উপায় থাকে না।
বিকেলবেলায় পুটে আবার ছুটছিল সিনেমা হলের দিকে। বস্তি থেকে বেরিয়ে একটা মাঠ অতিক্রম করে বড় রাস্তায় উঠতে হয়। মাঠটায় ওর বয়সী কিছু ছেলেমেয়ে গোল হয়ে বসে ছিল। ওদের পুটে চেনে। কিন্তু খুব একটা যে মেশে, এমন নয়। পুটে খুব দ্রুত পায়ে এগোচ্ছিল। ওদের মধ্যে টনি নামের একটা ছেলে তাকে ডাক দেয়। পুটে যাবে না মনে করেও আবার থেমে পড়ে। তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে ওদের জটলার মধ্যে দাঁড়ায়। জাকির নামের একটা ছেলে দাঁত বের করে বলে, 'কিরে, হলে যাইতাছস, নতুন বই লাগছে? তর পিরিও নায়িকার বই?'
কেডায়রে অর পিরিও নায়িকা?_ফোরকান নামের একটি ছেলে জিজ্ঞেস করে। এ কথায় জাকির খ্যাক খ্যাক করে খানিকক্ষণ হাসে। তারপর বলে_
'জানস না, গুদবাড়ে, ড্যাগা ড্যাগা মাই, নাচতে গ্যালে মাটি দাবি যায়। হ্যার ছবি পকেটে লই গুরি বেড়ায়।' তারপর কাছাকাছি মুখ নিয়ে ওরা ফিসফিস করে কী যেন বলে, আর সবাই খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ে। পুটে ভেবে পায় না, কী বলে ওরা এত হাসছে। মনে হয় ঘুসি মেরে নাক উড়িয়ে দেয়। কিন্তু সংখ্যায় ওরা অনেক, সবাই লাগলে পেরে উঠবে না। ওরা হেসেই চলে। একজন মুখ ফসকে বলে বসে_
'হ্যায় নায়িকারে মনচোদা করে, চোখবুজি হাত মারে, মুই দেখছি। আর ওর পিরিও নায়ক ক্যাডায় জানস? হ্যায় আসলে নায়ক না, সাইড নায়ক আমিন্যা। নায়িকার পেছনে গুরি গুরি চান্স না পাই হ্যার লগে বইন পাতায়। হেইডা নায়ক হইলোনি।' আবার সবাই খ্যাক খ্যাক করে হাসতে থাকে। হাততালি দেয়। রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে থাকে পুটে। এরপর একজন বলে_
আবে হুন, ওইসব নায়ক-নায়িকা ছাড়ি দে। মোগো লগে আয়। ডান্ডি লইবি, ডান্ডি?
হেইডা আবার কী?
'ডান্ডি চেনোস না?' বলেই আবার খ্যাক খ্যাক করে সবাই হেসে ওঠে, 'ওলে আমাল পুতু বাবু, ডান্ডি চিনে না।'
ফোরকানের হাতে একটা পলিথিনের ব্যাগ। তার মধ্যে হলুদ মতো কী যেন একটা দেখা যাছে। সে পলিথিনের মধ্যে নাক-মুখ ডুবিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। তারপর মুখটা বের করে, চোখ বন্ধ করে ঝিম ধরে থাকে। পুটে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। জাকির বলে_হ্যায় অহন 'জি্বনের বাদশা', হ্যায়তো দুনিয়ায় নাই। তুই টান মার দুইডা, তুইও চলি যাইবি আসমানের ওপার।
'ওইডা কী?'_হাত বাড়িয়ে পলিথিনটা ধরতে চায় পুটে। কিন্তু জাকির পলিথিনটা সরিয়ে নিয়ে বলে_
'উঁহু, অমনি হইব না, মাল ছাড়ো পাঁচ টিহা, আমরা কি এমনি পাইছি? সিদ্দিকবাজার থিইক্যা ১০ টিহায় কিনছি, জুতার আডা। আহারে ঘিরান, শ্বাস লইলে মনে লয়...'_বাকিটুকু আর বলে না। সেও পলিথিনে মুখ ডুবিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। তারপর ফোরকানের মতো সেও চোখ বুজে বসে থাকে। এবার টনি তার হাত থেকে পলিথিনটা নেয়। কিন্তু তখনই মুখ ডুবিয়ে শ্বাস নেয় না। পুটের দিকে তাকিয়ে বলে_ 'কী অইল, লইবি যদি মাল ছাড়।' তখন ফোরকান আর জাকির চোখ খোলে। চোখ দুটো লালচে আর ঝিমুনি ভাব। তারাও পুটের দিকে তাকিয়ে বলে_ 'জলদি কর হালায়'। তারপর টনিকে ইশারা করে বলে_
'নায়িকার মাই নাচানি দেহার পয়সাডা কাড়ি ল তো।'
পুটে তখনো দ্বিধান্বিত। কী করবে ভাবছে। এমন সময় টনি তার প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দুই টাকার একটা ছাতাপড়া নোট বের করে আনে। তারপর অন্য পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেয়। কিন্তু কিছু পায় না। ছাতাপড়া নোটটাকে উল্টেপাল্টে দেখে বলে_
'হালায় দুই ট্যাহা লই নায়িকার ডায়ে পাছা দেখবার যাইতাছিলি?'
হ্যায় ফজর আলিরে ঘুস মারি হাফটাইমে ভিত্রে ঢুকি যায়। দে দুই টিহা, দে। কাইল আরো তিন টিহা আনি দিবি। ওই টনি, তুই টান মারি পলিথিনডা অরে দেস না ক্যা।
'অয়, আগে মারুক'_টনি পলিথিনটা এগিয়ে দিয়ে বলে। তার হাত থেকে পলিথিনটা নিয়ে বড় করে মুখ খোলে পুটে। সঙ্গে সঙ্গে থাবা মেরে ধরে টনি বলে_
'হালায় করে কী? সব মাল উইড়া যাইব গা, মুখ ছুডু করি ধর।' তারপর দুই হাতে কী করে পলিথিনের মুখটা ছোট করে ধরে নাক ডুবিয়ে শ্বাস টানতে হয়, তার কৌশলটা শিখিয়ে দেয়। পুটে সেভাবে শ্বাস টানে। প্রথমে ভয় ভয় লাগে, তাই ছোট করে শ্বাস নেয়। গন্ধটা খারাপ নয়, ভালোই লাগে। তারপর জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকে, টলুইনের ঝাঁজ তার স্নায়ুর ওপর কাজ করতে শুরু করে। আপনাআপনিই তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। তার চোখের সামনে অনেক কিছু ভেসে উঠতে থাকে : তার মা চুলের মুঠি ধরে তাকে হলের সামনে থেকে বস্তির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, বাপে দুমাদুম পিঠের ওপর কিল-থাপড় মারছে, ফেদি তার ভাগের ভাতটাও খেয়ে ফেলছে, ছোট ভাইটা হেগেমুতে তার কোল ভাসাচ্ছে, গোলেনার সঙ্গে তার বাবা গা ঘেঁষাঘেষি করে বসে সিনেমা দেখছে, ফজর আলি আরো একটা টাকার জন্য তাকে দেরি করে হলে ঢুকতে দিচ্ছে, আর প্রিয় নায়িকাকে দেখার জন্য সে অস্থির হয়ে উঠছে। এই পর্যায়ে সেও নায়িকাদের সঙ্গে মেঘের মধ্যে ভেসে ভেসে গান গাইছে, দেখতে পায়। কিন্তু পরক্ষণেই টনি-জাকির-ফোরকানদের খ্যাক খ্যাক হাসির শব্দ তার কানে আসে। সে অস্পষ্ট শুনতে পায়, ওরা বলছে_
'শালারে মালে ধরছে। অহন রোজ আইব, দেহিছ।'
নেশার ঘোরে মাঠের মধ্যে চিত হয়ে শুয়ে থাকে পুটে। তার ভাবনাজুড়ে তখন নায়িকারা। তার বেশ সুখ-সুখ লাগে। আর তাকে ঘিরে গোল হয়ে বসে থাকা ছেলেগুলো খ্যাক খ্যাক করে হাসতে থাকে।

No comments

Powered by Blogger.