স্বাধীনতার ৪০ বছর-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৬২ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন।শহীদ মোহাম্মদ লোকমান, বীর প্রতীক শহীদের রক্তে রাঙা হলো বাংকার প্রতিরক্ষা অবস্থানে মোহাম্মদ লোকমান ও তাঁর সহযোদ্ধারা সতর্ক অবস্থায়। যেকোনো সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী আক্রমণ করতে পারে। রাতে তাঁরা পালা করে কেউ ঘুমালেন, কেউ জেগে থাকলেন। ভোর হতেই শুরু হলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ। তাঁরাও পাল্টা আক্রমণ চালালেন।


কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা বেশ বেপরোয়া। গোলাগুলিতে হতাহত হলো বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। তার পরও তারা এগিয়ে আসতে থাকল। মোহাম্মদ লোকমান ও তাঁর সহযোদ্ধারা বিপুল বিক্রমে ও সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের মোকাবিলা করতে থাকলেন। থমকে গেল পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রযাত্রা। প্রচণ্ড গোলাগুলি চলতে থাকল। এমন সময় হঠাৎ গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়লেন মোহাম্মদ লোকমান। রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল তাঁর বাংকার। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ৫ জুন, ছাগলনাইয়ায়।
ছাগলনাইয়া ফেনী জেলার অন্তর্গত থানা (বর্তমানে উপজেলা)। ১৯৭১ সালে ফেনীর বিলোনিয়া এলাকা জুন মাসের ২২ তারিখ পর্যন্ত মুক্ত ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা মুক্ত বিলোনিয়ায় অবস্থান নিয়ে আশপাশ এলাকায় অপারেশন পরিচালনা করছিলেন। জুন মাসের প্রথমার্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মুক্ত বিলোনিয়া এলাকা দখলের জন্য অভিযান শুরু করে। ৩ জুন পাকিস্তান সেনাবাহিনী ফেনী থেকে বান্দু-দৌলতপুর রেললাইন এবং ছাগলনাইয়া হয়ে উত্তর দিকে যাওয়া লাইন ধরে অগ্রসর হতে থাকে। প্রথম দিন তারা প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়নি। ৪ জুন মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রবর্তী দলের সঙ্গে তাদের প্রথম যুদ্ধ হয়। সেদিন তারা প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে পিছু হটে যায়। পরদিন অর্থাৎ ৫ জুন তারা অতর্কিতে আবার আক্রমণ শুরু করে। এদিন ছাগলনাইয়ার দিক দিয়ে অগ্রসর হতে থাকা পাকিস্তানি সেনাদের দল ছিল বেশ বেপরোয়া। ছাগলনাইয়ায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা অগ্রসর হতে থাকা পাকিস্তানি সেনাদের বিপুল বিক্রমে প্রতিরোধ করেন। পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণে যথেষ্ট ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তার পরও তারা এগোতে থাকে। তখন ছাগলনাইয়ায় ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। কয়েক ঘণ্টা ধরে চলা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীই জয়ী হয়। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিতে মোহাম্মদ লোকমানসহ তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং কয়েকজন আহত হন। মোহাম্মদ লোকমান একটি বাংকারে ছিলেন। সেখান থেকে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন। হঠাৎ তাঁর শরীরে এক ঝাঁক গুলি লাগে। সঙ্গে সঙ্গে শহীদ হন তিনি। সেদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীরও ৪০-৫০ জন হতাহত হয়। যুদ্ধশেষে মোহাম্মদ লোকমানসহ তিনজন শহীদের মরদেহ সমাহিত করা হয় পাঠান নগরে।
মোহাম্মদ লোকমান চাকরি করতেন ইপিআরে (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পরে বিডিআর, এখন বিজিবি)। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন সিলেট ইপিআর সেক্টরের অধীনে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধ যুদ্ধ শেষে যুদ্ধ করেন ২ নম্বর সেক্টরের রাজনগর সাব সেক্টরে। শুভপুর, মুন্সিরহাটসহ আরও কয়েক স্থানের যুদ্ধে অসীম সাহসিকতা প্রদর্শন করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ মোহাম্মদ লোকমানকে মরণোত্তর বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ২১৪।
শহীদ মোহাম্মদ লোকমানের পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি উপজেলার অম্বরনগর ইউনিয়নের ওয়াসেকপুর গ্রামে। বিবাহিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক মাস আগে তিনি বিয়ে করেন। তাঁর বাবার নাম ইসমাইল হোসেন। মা সামছুন নাহার। স্ত্রী কাওছারা বেগম। তাঁর সন্তান নেই। কাওছারা বেগমের পরে অন্যত্র বিয়ে হয়। মোহাম্মদ লোকমানের নাম এলাকাবাসী প্রায় ভুলে গেছে। নতুন প্রজন্মের কেউ তাঁর নাম ও বীরত্বের কথা জানে না। শহীদ মোহাম্মদ লোকমানের ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: ফখরুল ইসলাম (নোয়াখালী) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২।
গ্রন্থনা: তারা রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.