বিভক্তির পথে ইরাক!

দ্যই ইরাক ছেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী। দীর্ঘ নয় বছর সেখানে তাদের শক্তিশালী উপস্থিতি ছিল। সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের পতন ও ফাঁসি কার্যকরের পরও বিভিন্ন রকম প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করেছে তারা। কিন্তু গত রোববার তারা ইরাক ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো একটি চিত্র আবারও প্রবলভাবে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতার একেবারে শীর্ষস্থান থেকে শুরু হয়েছে জাতিগত বিভেদের রাজনীতি। ঐতিহ্যগতভাবেই দেশটির শিয়া ও


সুনি্ন মতাবলম্বীরা কখনও নিজেদের আপন মনে করে না। মার্কিন সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট যে নয় বছর ইরাকে ছিল তখন দেশটির নৃতাত্তি্বক ও উপগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিভেদ কিছু কম পরিলক্ষিত হয়েছিল। কিছুটা ঐকমত্য দেখা গিয়েছিল তাদের মধ্যে। বিপরীতক্রমে, বড় দাগে বিভক্ত ইরাকি গোষ্ঠীগুলো শক্তিশালী বিদেশি সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিকে নিজেদের ক্ষমতা সংহত করার কাজেই লাগিয়েছে। ওই বাহিনী দেশত্যাগ করলে ক্ষমতার যে শূন্যতা তৈরি হবে তা দখলে নিজেদের এগিয়ে রাখার লড়াইয়েই ব্যস্ত থেকেছে তারা। দেশটির দুই চরম প্রতিপক্ষ শিয়া ও সুনি্নরা যে ঐকমত্যের সরকার গঠন করেছিল, মাত্র এক বছরের মাথায় তা এখন ভাঙনের পথে।
ইরাকের গত নির্বাচনে সুনি্ন সমর্থিত আল ইরাকিয়া পার্টি বেশি আসন পায়। ৩২০ আসনের মধ্যে এ পার্টি পায় ৯১টি। ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তিতে তারা ঐকমত্যের সরকার গঠন করে। এক বছরের মাথায় এ জোটে ফাটল দেখা দিয়েছে। সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেছে এ পার্টি। এ পার্টির অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী নূরি আল মালিকি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে ফেলেছেন। তারা সুনি্ন অধ্যুষিত এলাকাগুলোর জন্য যে স্বায়ত্তশাসন দাবি করেছিল তাও প্রত্যাখ্যান করেছেন মালিকি। সুনি্ন নেতাদের অভিযোগ, মালিকি নির্বাচনের আগে অচলাবস্থা নিরসনে যে চুক্তি করেছিলেন তাও মানছেন না।
তবে তাদের এ অভিযোগের ফল হয়েছে ভয়ঙ্কর। সমঝোতার পথে না গিয়ে উল্টো কঠিন আঘাত হেনেছেন শিয়াপন্থি নূরি আল মালিকি। তিনি দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট আল ইরাকিয়া পার্টির নেতা তারিক আল হাশেমির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। সুনি্ন নেতা পার্লামেন্টের উপপ্রধানমন্ত্রী সালেহ আল মুতলাককে অপসারণের জন্য পার্লামেন্টের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। হাশেমির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার সঙ্গে সন্ত্রাসীদের যোগাযোগ রয়েছে। হাশেমি প্রধানমন্ত্রী মালিকির কড়া সমালোচক। মুতলাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মালিকিকে সাদ্দাম হোসেনের চেয়েও খারাপ বলে উল্লেখ করেছেন। গ্রেফতারি পরোয়ানার প্রতিবাদে মন্ত্রিসভা বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছে আল ইরাকিয়া পার্টি। এর আগে প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছেন এমন অভিযোগ তুলে পার্লামেন্ট থেকেও সমর্থন প্রত্যাহার করে দলটি।
সুনি্ন নেতা সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর মার্কিন সহযোগিতায় ইরাকের ক্ষমতায় আসীন হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়ারা। তখন থেকেই নিজেদের কোণঠাসা মনে করতে থাকেন সুনি্ন নেতারা। ২০১০ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে শিয়া, সুনি্ন ও কুর্দিরা একটি সমঝোতায় পেঁৗছায়। সে অনুযায়ী বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী একজন শিয়া, প্রেসিডেন্ট কুর্দি ও স্পিকার সুনি্ন।
দুই ইরাকিয়া পার্টির নেতার বিরুদ্ধে মালিকির এ পদক্ষেপ_ শিয়া ও সুনি্ন নেতাদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই গোটা দেশকেই অস্থিতিশীলতার মধ্যে ফেলে দিতে পারে। তবে শিয়া নেতারা বলছেন, এটি সুনি্নদের বিরুদ্ধে নয়, বরং ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে এ পদক্ষেপ। মার্কিন উপস্থিতি থাকতেও দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত যে দেখা যেত না তা নয়, তবে ওই সময় মার্কিন মধ্যস্থতায় সংকট কাটিয়ে ওঠা যেত। সংখ্যালঘু সুনি্নরা আশ্রয় নেওয়ার জায়গা পেত। এখন মার্কিন বাহিনী ইরাক ছেড়ে দেওয়ার প্রেক্ষাপটে দ্বন্দ্ব ও ঝুঁকি উভয়ই অনেক বেশি বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
দেশটির দুই গোষ্ঠীর এ দ্বন্দ্বই চূড়ান্ত বা দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। জাতিগত এ দ্বন্দ্বে যোগ দেবে প্রতিবেশী দুটি দেশ। শিয়াদের পেছনে রয়েছে শক্তিশালী ইরান আর সুনি্নর পেছনে সৌদি আরব, সিরিয়া ও তুরস্ক। তাছাড়া আরবের বেশিরভাগ দেশই সুনি্নপন্থি। ইরাকের এ দ্বন্দ্ব দেশের সীমানা ছাড়িয়ে খুব সহজেই আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব ও আধিপত্যে রূপ নিতে পারে। গণবিপ্লবে টালমাটাল আরবে ইরাকের এ দ্বন্দ্বও রাখতে পারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের আলাউইত গোষ্ঠী শিয়াদের থেকেই উদ্ভূত। চলমান সিরিয়ান বিপ্লবে আসাদকে বিদায় নিতে হলে লাভবান হবে দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সুনি্নরা। এমন বহু হিসাব-নিকাশের মুখে ইরাকের দিকে এখন নজর গোটা আরব অঞ্চলের। ৯ বছর পর মার্কিন প্রভাবের ছত্রছায়া থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে দেশটিতে যে আশঙ্কা উঁকি দিচ্ছে তা গোটা অঞ্চলের জন্যই ক্ষতিকর হয়ে দেখা দিতে পারে। এ জন্যই ইরাকের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে প্রতিবেশী দেশগুলো।
সূত্র :টাইম, শিকাগো ট্রিবিউন ও রয়টার্স অনলাইন।

No comments

Powered by Blogger.