টমাস ট্রান্সট্রোমারের নোবেল ভাষণ

নুবাদ : দুলাল আল মনসুর
আমার দিকে তাকিয়ে আছে স্মৃতিরা

জুন মাসের এক সকাল। বিছানা ছাড়ার জন্য বেশি সকাল,
আবার ঘুমিয়ে পড়ার মতো সময়ও নেই।


আমাকে বাইরে যেতেই হবে_স্মৃতিরা ঘন হয়ে জুড়ে আছে
শ্যামলিমার বুক; স্মৃতিরা খোলা চোখে পিছু নেয় আমার।

দেয় না ধরা দৃষ্টিসীমায়; পূর্ণাবয়বে জেগে ওঠে
পটভূমিজুড়ে, সত্যিকারের গিরগিটি সব।

স্মৃতিদের অবস্থান এতটাই কাছে, পাখিদের কান ঝাঁজালো
কলরবেও তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস শুনতে পাই।
উত্তরের শিল্পী

আমি এদভার্দ গ্রিয়েগ মনুষ্য-ভিড়ে ঘুরেছি অনেক মুক্ত মানুষের মতো।
হাস্যরসের খোরাক থাকত হাতের কাছেই, পত্রপত্রিকা পড়া হয়েছে ঢের, এখানে-সেখানে ঘুরেছি অনেক।
বাদকদলের নেতৃত্বের অভিজ্ঞতাও হয়েছে আমার।

নোঙরের সময় ট্রেন-ফেরির ভাবগম্ভীর চেহারার মতো
আলোর বন্যায় বিজয়গর্বে কাঁপতে থাকে কনসার্ট হল।
এখানে এসেছি নিস্তব্ধতার সঙ্গে বন্দিত্বে একাত্ম হতে।
আমার কাজ করার ঘরটা বেশ স্বল্পপরিসর।
ছাইচের নিচে আবাবিল পাখির মতো পিয়ানোটা আঁটসাঁট।

নয়নাভিরাম খাড়া ঢাল থেকে খুব একটা কথা বের হয় না।
বের হওয়ার পথ নেই কোনো।
তবে মাঝেমধ্যে একটুখানি ফাঁক চোখে পড়ে;
সেখান দিয়ে সরাসরি দানবালয় থেকে অদ্ভুত আলো চুইয়ে পড়ে।
হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়!
তারপর এক বসন্তের রাতে পর্বতের ওপরের হাতুড়ির আঘাত
হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনের মতো চুপি চুপি চলে এল
চলে এল
এল আমাদের ঘরে।
আমি মারা যাওয়ার আগের বছর ঈশ্বরের তালাশে গোটা চারেক ঈশ্বরবন্দনা পাঠাব।
তবে তার শুরু এখানেই: নিকটবর্তী আছে যা তা নিয়েই একটি গান,
নিকটবর্তী আছে যা।
আমাদের ভেতরে আছে এক যুদ্ধক্ষেত্র_
এখানে আমরা মৃতের হাড়েরা জীবিত হওয়ার লক্ষ্যে
অবিরত লড়ে যাই।

ফানচাল

সমুদ্রতটে মাছের রেস্তোরাঁ, ছোট, জাহাজডুবি লোকদের তৈরি একটা চালাঘর মাত্র। দরজা থেকে অনেকেই ফিরে যায়; তবে সমুদ্রের বাতাস ফেরে না। একটি ছায়া তার দুর্গন্ধভরা কেবিনে দাঁড়িয়ে আটলান্টিসের পুরনো রেসিপি অনুসারে দুটো মাছ ভাজে। রসুনের হালকা ঝাঁজ, টমেটোর টুকরোর ওপর দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে। প্রতিটা কামড়েই বোঝা যায়, সমুদ্র আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী। গভীর থেকে উঠে আসে গুনগুন।
ক্লান্তিহীন বুনোফুলে ভরা পাহাড়ি পথে আরোহণের মতো আমি আর আমার সঙ্গিনী দুজন দুজনের ভেতরে দৃষ্টি ফেলি। পশুদের কাছাকাছি আমরা; আমরা স্বাগত; আমাদের বয়স বাড়ে না। তবে এত বছর আমরা কত অভিজ্ঞতা একসঙ্গে ভাগ করে নিয়েছি! মনে পড়ে যায় সব; কখনো কখনো আমরা কোনো কাজের ছিলাম বলে মনে হয়নি (যেমন ফুলেফেঁপে ওঠা দৈত্যটাকে রক্ত দেওয়ার জন্য আমরা লাইনে দাঁড়িয়েছি)। কোনো কোনো ঘটনা আমাদের আরো ঘনিষ্ঠ করেছে, না হলে আমাদের এসব ঘটনা বিচ্ছিন্নই করে ফেলতে পারত। আবার কিছু ঘটনা আমরা একসঙ্গেই ভুলে গেছি। তবে সে ঘটনাগুলো আমাদের ভোলেনি; সেগুলো পাথরে পরিণত হয়ে গেছে_কতক হালকা রঙের, কতক কালো। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মোজাইকের অংশ হয়ে গেছে ওই সব পাথর। আর এখন এমন ঘটে_পাথরের টুকরোগুলো একসঙ্গে উড়ে বেড়ায়; মোজাইক দৃষ্টির সামনে দৃশ্যমান। মোজাইক আমাদের জন্য অপেক্ষায় আছে। আমাদের হোটেল রুমের দেয়ালে কেমন চকচক করছে। ডিজাইনের মধ্যে মারমুখী আবার কোমল জিনিসের মিশেলও আছে। তবে আমরা যেভাবে বিছানার কাপড় তুলে ফেলি এত কিছু দেখার সময় আমাদের নেই।
গোধূলিবেলায় আমরা বাইরে বের হই। অন্তরীপের কালচে নীল থাবা সমুদ্রের বিরাট এলাকাজুড়ে পড়ে আছে। আমরা মানুষের স্রোতে মিশে যাই। বন্ধুত্বপূর্ণ হালকা ধাক্কায় এদিক-ওদিক সরে যাই। সবাই অজানা ভাষায় কিচিরমিচির করছে। 'কেউই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়'। আমরা তাদের মধ্য দিয়ে এবং আমাদের মধ্য দিয়ে আরো শক্ত হয়ে উঠি। আমাদের ভেতরের এই শক্তিকে অন্য কেউ দেখতে পায় না। অভ্যন্তরের আপাতস্ববিরোধিতা, গ্যারেজের ফুল, শুভ অন্ধকারের দিকে ঘুলঘুলি। শূন্য গ্লাসে বুদ্বুদ্ তোলা পানীয়। নীরবতা ছড়িয়ে দেওয়া একটি লাউডস্পিকার। প্রতি পদক্ষেপের পেছনে গজিয়ে ওঠা পথ। অন্ধকারে পাঠযোগ্য একটি পুস্তক।

আলোর প্রবাহ ভেতরে ঢুকে পড়ে

জানালার বাইরে বসন্তের পশুটা সূর্যালোকের স্বচ্ছ ড্রাগন
উপশহরীয় শেষ-নেই ট্রেনের মতো দ্রুত এগিয়ে আসে;
আমরা এর অগ্রভাগের দেখা পাইনি কখনো।
তীরবর্তী বাড়িগুলো ধীরে ধীরে দুপাশে সরে যায়;
বাড়িগুলো কাঁকড়াদের মতো গর্বিত
সূর্যের আলোয় পাথরের মূর্তিগুলো চোখ পিটপিট করে।
আগুনের ক্রুদ্ধ সাগর স্নেহস্পর্শে পরিণত হয়।
উল্টো গণনা শুরু হয়ে গেছে।

ভারমিয়ার

সুরক্ষিত কোনো জগৎ বলতে কিছু নেই; শুধু দেয়ালের আড়ালে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়; ওখানেই পান্থশালা; সেখানে উচ্চহাসি, অযথা বকবকানি, দন্ত উন্মোচন, অশ্রু, বেলের উচ্চ শব্দ, উন্মাদ শালা আর মৃত্যু আনয়নকারীর জন্যই আমাদের যত শিউরে ওঠা। বিশাল বিস্ফোরণ, আর উদ্ধারকারী ভবঘুরেদের দেরিতে উপস্থিতি। নৌকাগুলো প্রণালির ভেতর নিজেদের সজ্জায় ব্যস্ত।
ভুল লোকের পকেটের দিকে বয়ে যায় টাকা-পয়সা। চাহিদার ওপর জড়ো হয় চাহিদার স্তূপ; মুখখোলা কেয়ারি থেকে যুদ্ধের আগামবার্তা ঘাম হয়ে ঝরে; ওখান থেকে আর ঠিক দেয়ালের ভেতর দিয়ে, পরিষ্কার স্টুডিওর ভেতর দিয়ে শত বছর বেঁচে থাকার অনুমতিপ্রাপ্ত সেকেন্ডের ভেতর।
'সংগীতের তালিম' এবং 'নীল পোশাকে চিঠি পড়া নারী' নামধারী ছবিগুলো_মহিলার এখন আট মাস চলছে; তার ভেতরে আরো দুটো হৃৎপিণ্ড লাথি ঝাড়ছে। পেছনের দেয়ালে টাঙানো অজানা ভূখণ্ডের মানচিত্র। প্রশান্ত নিঃশ্বাস পতন...। অজনা-অচেনা কী যেন একটা চেয়ারের সঙ্গে পেরেক দিয়ে আটকানো। সোনার ঘণ্টিগুলো অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ঢুকে পড়ে ভেতরে; তারপর হঠাৎ
থেমে যায়, যেন স্থিরতা ছাড়া আর কোনো পরিচয়ই ছিল না কোনো কালে; গভীর থেকে কিংবা উচ্চতা থেকে কানে বাজে সংগীত; এটা আসলে দেয়ালেরই অন্য পাশ থেকে আসা চাপ।
এই চাপ প্রত্যেক বাস্তবতাকে ভাসিয়ে রাখে আর তুলিকে করে দেয় স্থির। দেয়ালের ভেতরে সেঁধিয়ে দিতে করে ক্ষত-বিক্ষত, যে কাউকেই করে অসুস্থ। তবে এর প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় না। পৃথিবী একটাই। তবে রয়েছে দেয়ালের অস্তিত্ব। দেয়ালটা তোমারও একটা অংশ। আমরা জানি আর না-ই জানি, শুধু শিশুরা ছাড়া, আর সবার ক্ষেত্রেই এর সত্যতা রয়েছে। তাদের জন্য কোনো দেয়াল নেই।
পরিষ্কার আকাশটা নেমে এসেছে দেয়ালের গায়ে।
দেয়ালটা শূন্যতার প্রতি প্রার্থনায় রত।
আর শূন্যতা আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে
ফিসফিস করে বলে, 'আমি শূন্য নই; আমি উন্মুক্ত'।

ভ্রমণ

পাতাল স্টেশনে
প্রাচীরপত্রের ভিড়ে
মরা আলো তাকিয়ে রয়।
ট্রেনটা আসে আর
সংগ্রহ করে নিয়ে যায় মুখমণ্ডল আর পত্রাধার।
তারপর অন্ধকার।
আমরা বসে থাকি মূর্তির মতো
যেন আমাদের গুহাপথে সজোরে টেনে তোলা হয়েছে।
নিয়ন্ত্রিত, স্বপ্ন, নিয়ন্ত্রিত।
সমুদ্রস্তরের নিচের স্টেশনগুলোতে তারা
অন্ধকারের খবর বিক্রি করে।
ছুটন্ত মানুষেরা নীরবে, বিষাদে
ঘড়ির কাঁটার নিচে।
ট্রেনটা বয়ে নিয়ে যায়
বাইরের পোশাক আর আত্মাকে।
পাহাড়ি পথের এই ভ্রমণে
চারদিকে মানুষের দৃষ্টি।
তবু কোনো পরিবর্তন নেই।
তবে উপরিতলের খুব কাছেই
শুরু হয়ে যায় মর্মরধ্বনি_স্বাধীনতা।
আমরা পৃথিবীর বাইরে পা রাখি।
বিশাল সবুজ ভূখণ্ড
আমাদের পায়ের তলায়
একবার পাখা ঝাপটিয়ে চুপ হয়ে যায়।
শস্যের খোসাগুলো প্ল্যাটফর্মে
উড়ে আসে। টার্মিনাল-১ চলে এল,
আরো একবার।
আমার সঙ্গে কতজন? চার
পাঁচ, তার চেয়ে খুব একটা বেশি নয়।
বাড়িঘর, রাস্তা, আকাশ,
নীল খাঁড়ি, পর্বত খুলে দেয় জানালা

সি মেজর

মিলনস্থল থেকে ফিরে সে যখন রাস্তায় নেমে আসে, বাতাস তুষারের ঘূর্ণাবর্ত বইছে।
তারা দুজনে যখন শুয়ে আছে, ততক্ষণে শীত এসে গেছে।
রাতের চেহারা তুষারধবল। আনন্দে ভিজে হেঁটে চলে সে।
গোটা শহরই ঢালু। এপাশ-ওপাশ দিয়ে বয়ে যায় হাসির ঢল_
গোটানো কলারের পেছনে সবারই মুখে হাসির বন্যা।
অবারিত স্বাধীনতা।
সকল জিজ্ঞাসাচিহ্ন ঈশ্বরের অস্তিত্বের গানে মুখর_
তার তো সে রকমটাই মনে হলো।

সংগীতের একটি ধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে
ঘূর্ণায়মান তুষারের ভেতর দীর্ঘ পদক্ষেপে হেঁটে যায়।
সব কিছুই সি নোটের দিকে ধাবমান।
একটি কম্পমান কম্পাস সি নোটের দিকে।
যন্ত্রণার চেয়ে ওপরে এক ঘণ্টা।
বেশ তো আয়েশী ব্যাপার।
গোটানো কলারের পেছনে সবারই মুখে হাসি।

একাকী

ফেব্রুয়ারির এক সন্ধ্যায় এখানে আমার মরণদশা হয়েছিল।
রাস্তার উল্টো দিকে তুষারের ওপর হড়কে গেল গাড়ি।
বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ি_গাড়িগুলোর আলো_
সব কিছু যেন দৃষ্টির সামনে ছোট হয়ে এল।

আমার নাম, আমার মেয়েরা, আমার কাজ_
সব যেন আমার কাছ থেকে মুক্ত হয়ে গেল
আর সব কিছুই নীরবে পিছে পড়ে যেতে থাকল
দূরে, আরো দূরে। খেলার মাঠে শত্রুবেষ্টিত কোনো বালকের মতো
আমার যেন কোনো নাম রইল না।

বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়িগুলোর কী বিপুল আলো!
ডিমের মতো সাদা ভাসমান স্বচ্ছ আতঙ্কের ভেতর
যখন চাকায় টান দিলাম, আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল
সেই বিপুল আলোয়। সেকেন্ডগুলো দীর্ঘ হয়ে গেল;
ভেতরে শূন্যতার মতো বিশাল ফাঁকা একেকটার;
সেকেন্ডগুলোর অবয়ব হয়ে গেল
একেকটা হাসপাতাল ভবনের মতো।

চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে
থেমে যাওয়ার মতো একটু ফুরসত মিলতে পারত
নিঃশ্বাস ফেলার। তারপর কী একটা ঘটে গেল :
একবিন্দু শুভেচ্ছা বালি কিংবা একপশলা আশ্চর্য বাতাস।
গাড়ি মুহূর্তে মুক্ত হয়ে সোজা রাস্তায় উঠে চলা শুরু করল।
চোখের সামনে দেখতে পেলাম একটা খুঁটি;
তৎক্ষণাৎ সেটার অবয়ব ভেঙে চুরমার_ঢং করে শব্দ হলো_
তার পরই সেটা যেন অন্ধকারে উড়ে গেল।

তারপর_সুনসান নীরবতা। আবার সিটবেল্ট বেঁধে বসলাম;
দেখলাম কে যেন তুষারের ঘূর্ণিস্রোতের মধ্যেই
আমার কী হয়েছে দেখতে এগিয়ে এল।

২.আমি অনেকক্ষণ ধরে অস্টারগটল্যান্ডের
জমাটবদ্ধ মাঠের ওপর হাঁটছি।
কোথাও কাউকে দেখিনি।

পৃথিবীর অন্যান্য অংশে
চিরন্তন ভিড়ের মাঝে মানুষ জন্ম নেয়,
জীবন যাপন করে, মারা যায়।

সব সময়ের জন্য দৃশ্যমান হতে_
চোখের ভিড়ের মাঝে বেঁচে থাকতে_
এক ধরনের বিশেষ প্রকাশশক্তি গড়ে ওঠা চাই।
কাদার প্রলেপ মাখানো মুখ।

মর্মরধ্বনিমালা নিজেদের আকাশ, ছায়া
আর বালুকণার মতো খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত করে উঠে আসে;
আবার স্তিমিত হয়ে যায়।

আমার একাকিত্ব চাই_
সকালে দশ মিনিট
আর সন্ধ্যায় দশ মিনিট_
কোনো রকম কাজবিহীন শুধুই একাকিত্ব।
প্রত্যেকেই ধর্না দিচ্ছে প্রত্যেকের দুয়ারে।

অনেকেই।

একজন।

বিষাদময় নৌকা

বৃদ্ধরা, শ্বশুর এবং জামাতা, লিৎস এবং ওয়াগনার,
অবস্থান করছে গ্র্যান্ড ক্যানালের পাশে
তাদের সঙ্গে আছে অস্থির মহিলা
সে সব কিছু ওয়াগনারে রূপান্তরকারী রাজা মিডাসকে বিয়ে করেছিল।
সমুদ্রের সবুজ হিম নিজের পথ করে নেয় প্রাসাদের মেঝে অবধি।
ওয়াগনারকে ভালো করে দেখে রাখা হচ্ছে; সুপরিচিত মি. পাঞ্চ পরিলেখা
আগের চেয়ে আরো বেশি ক্লান্ত
মুখমণ্ডল একটা সাদা পতাকা।
তাদের প্রাণময় নৌকা পুরোপুরি পরিপূর্ণ;
দুটো ফিরে যাওয়ার পথ আরেকটা একক।

২. প্রাসাদের জানালাগুলোর একটা হাট করে খুলে গেলে
ভেতরের বাসিন্দারা হঠাৎ লু হাওয়ায় মুখ বিকৃত করে।
বাইরে ময়লাটানা নৌকাটা এসে যায়;
চালক দুজন একবৈঠাঅলা রাহাজান। লিৎস কয়েকটা স্বর লিখেছে;
অর্থ উদ্ধার করা এতই কঠিন বিশ্লেষণের জন্য
সেগুলো পাদুয়ার খনিজবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে হবে।
অনেকগুলো উল্কা!
এতটাই ভারী যে পতনের পরে আর স্থির থাকতে পারে না।
সেগুলো নিচের দিকে ডুবতে ডুবতে ভবিষ্যতের মধ্য দিয়ে
পেঁৗছে যায় তামাটে শার্টের বহরে।
নৌকাটা ভবিষ্যতের অবনত পাথরে বোঝাই।

৩.উঁকি দেওয়ার ছিদ্রপথে দেখা যায় ১৯৯০ সাল।

মার্চের ২৫ তারিখ। লিথুয়ানিয়ার ওপর অনিশ্চয়তাবোধ।
স্বপ্নে দেখলাম একটা হাসপাতাল। সেখানে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী নেই
সবাই রোগী।

একই স্বপ্নে দেখলাম সদ্যোজাত একটা মেয়েকে।
সে পূর্ণবাক্যে কথা বলছে।

৪.বয়সী জামাতার পাশে লিৎস একজন পোকায়
খাওয়া মহান অধিপতি।
এটা একটা ছদ্মবেশ।
বিভিন্ন মুখোশ পরে পরীক্ষা করে দেখা গভীর সত্তা তার জন্য
এই ছদ্মবেশটা বেছে দিয়েছে।
এই সত্তা নিজের মুখ আড়ালে রেখেই ভেতরে প্রবেশ করতে চায়,
মানব সমাজে প্রবেশ করতে চায়।

৫.আবি লিৎস তুষারের মধ্যে এবং সূর্যালোকের মধ্যে
নিজের স্যুটকেস নিজেই বহন করতে অভ্যস্ত
আর মৃত্যুর সময় এলে তাকে কেউ স্টেশনে
দেখতে পাবে না।
উঁচুমানের ব্র্যান্ডির বাতাস কাজের মাঝখান থেকে
টেনে নিয়ে যায়। বছরে দুশটা চিঠি।
বাড়ি যাওয়ার পূর্বে স্কুল বালক শতেকবার
লিখছে ভুল বানানের শব্দ।
সাধারণ চেহারার কালো নৌকাটা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা।

৬.আবারও ১৯৯০।
স্বপ্নে দেখলাম ২০০ কিলোমিটার উদ্দেশহীন গাড়ি চালালাম।
তারপর সব কিছু বিরাট আকৃতির হয়ে গেল।
চড়ুইগুলোর আকৃতি মুরগির মতো;
কান ঝালাপালা তাদের গানের আওয়াজে।

স্বপ্নে দেখলাম রান্নাঘরের টেবিলে
আমি পিয়ানোর কিগুলো এঁকে বাজাতে থাকলাম।
প্রতিবেশীরা এলেন শুনতে।

৭.কি-বোর্ডটা গোটা পার্সিফলজুড়েই ছিল নীরব,
(অবশ্য শ্রবণে সব কিছুই খেয়াল করেছে,)
অবশেষে কিছু বলার অধিকার পেয়েছে।
দীর্ঘশ্বাস...
আজকের সন্ধ্যায় বাজানোর সময় লিৎস সমুদ্র প্যাডেলটা
নিচের দিকে আটকে ধরে রাখে, যাতে সমুদ্রের সবুজ শক্তি
মেঝের ভেতর দিয়ে ভবনের পাথরের কাঠামোর সমান হয়ে না ওঠে।
শুভ সন্ধ্যা সুন্দর গভীর সত্তা!
সাধারণ চেহারার কালো নৌকাটা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা।

৮.স্বপ্নে দেখলাম আমি স্কুল শুরু করতে গেছি। কিন্তু আমার দেরি হয়ে গেছে। রুমের মধ্যে উপস্থিত সবার মুখে সাদা মুখোশ;
কে শিক্ষক তা বলা একেবারেই অসম্ভব।


ধীর লয়ের সংগীত

দালানবাড়িটা বন্ধ। জানালা গলে সূর্যালোক ভিড় করে ভেতরে;
আর মানুষের নিয়তিকে ধারণ করার মতো যথেষ্ট শক্ত
ডেস্কগুলোর উপরিতলকে উষ্ণ করে তোলে।

আজ আমরা বাইরে দীর্ঘ প্রশস্ত ঢালে।
অনেকেরই পরনে কালো পোশাক।
চোখ বন্ধ রেখে সূর্যের নিচে দাঁড়াতে পারো;
অনুভব করবে অলক্ষ্যে সামনের দিকে বাহিত হয়ে চলেছ।

পানির কাছাকাছি খুব একটা নেমে আসি না আমি।
তবে এখন আছি এখানেই।
চারপাশে শান্তিময় পিঠের পাথরের ছড়াছড়ি।
পাথরগুলো ঢেউয়ের ভেতর থেকে
ক্রমে ক্রমে পেছনের দিকে উঠে এসেছে।

নীল বাতাসী ফুল

মন্ত্রমুগ্ধ হওয়া চাট্টিখানি কথা নয় মোটেও। সে তো মাটি আর বসন্তকালের পুরনো এক কৌশলমাত্র : নীল বাতাসী ফুল। অপ্রত্যাশিতভাবে ফুটে থাকে ফুলগুলো। যেখানে সহজে কারো দৃষ্টি আটকায় না, তেমন জায়গায় আগের বছরের বাদামি শুকনো পাতার মধ্য থেকে গজিয়ে ওঠে এই ফুলের গাছগুলো। ফুলগুলোর চকচকে রং বাতাসে ভেসে আসে। অবশ্যই ভেসে আসে, ভেসে আসে রঙের ভেতর থেকে। কড়া নীল বেগুনি, ওজন নেই বললেই চলে। এখানে এখন পরমানন্দ; তবে ধীর কণ্ঠের। 'পেশাগত জীবন'_অপ্রাসঙ্গিক! 'ক্ষমতা' এবং 'প্রচার'_হাস্যকর! তারা হয়তো নিনেভেহতে বিশাল জাঁকজমকপূর্ণ সংবর্ধনায় পড়ে আছে এখন। ভেলাঅলাকে জাগিয়ে তুলছে। আর সর্বোপরি মুকুটসদৃশ স্বচ্ছ ঝাড়বাতিগুলো কাচের শকুনের মতো ঝুলে আছে। এ রকম অতিসজ্জিত চোখধাঁধানো কানাগলির চেয়ে বাতাসী ফুলগুলো বরং নিশ্চুপ মৃত্যুর মতো সত্যিকারের উদ্যাপনের দিকে গোপন পথ খুলে দেয়।

পূর্বের ডিডিআরে নভেম্বর

সর্বশক্তিমান সাইক্লোপ-চোখ মেঘাচ্ছন্ন
আর ঘাস কেঁপে ওঠে কয়লা ধুলোয়।

রাতের স্বপ্নের কাছে বেদম মার খেয়ে
আমরা যে ট্রেনে উঠি
সে ট্রেন প্রতি স্টেশনেই থামে
আর ডিম পাড়ে।

প্রায় পুরোপুরি নিস্তব্ধ। গির্জার বেলের ঢং ঢং শব্দের বালতি
পানি আনছে। কার যেন নিরন্তর কাশি অবিরত
সব কিছু, সবাইকে বকুনি দিয়ে যায়।

একটা পাথরের প্রতিমা ঠোঁট নাড়ে;
এটা নগর।
এর শাসক লৌহকঠিন ভ্রান্ত ধারণা_
ছোট অস্থায়ী দোকানের পরিচারক, কসাই, নৌ অফিসার
আর শিক্ষাবিদদের লৌহকঠিন ভ্রান্ত ধারণা।

কী যে যন্ত্রণাকাতর আমার চোখ দুটো!
জোনাকিদের মৃদু আলোর বাতিতে আমার চোখ দুটো
এত দিন পড়ায় ব্যস্ত ছিল। নভেম্বর গ্রানাইটের মিঠাই নিয়ে আসে।
পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত!
পৃথিবীর ইতিহাসের মতো
ভুল জায়গায় হাস্যময়।

তবে প্রতি বুধবারে
জল আনার বালতির মতো
গির্জার ঘণ্টাধ্বনির ঢং ঢং শব্দ শুনি আমরা।
আজ কি বুধবার? আমাদের রবিবারের জন্য এই তো যথেষ্ট!

সুবার্তিয়ানা

সন্ধ্যার অন্ধকারে নিউ ইয়র্ক নগরীর বাইরের একটা জায়গা থেকে একনজরে আট মিলিয়ন লোকের
আবাসগুলো দেখতে পাবে। পাশ থেকে দেখলে ওখানকার ওই বিশাল নগরীকে মনে হয়
ঝিকিমিকি স্রোত, ওপরের দিকে উঠে যাওয়া ছায়াপথ।
ছায়পথের মধ্যে কফির কাপ এগিয়ে দেওয়া হয় কাউন্টারের মধ্য দিয়ে। দোকানের জানালাগুলো পথিকদের কাছ থেকে জুতোর স্রোত প্রার্থনা করে;
সে জুতোগুলোর কোনো দাগ থাকে না ওখানে।
ওপরে আরোহণরত আগুন পলায়নপর; লিফটের বন্ধ দরজা ওপরের দিকে বেয়ে ওঠে। দরজার পেছনে চিরন্তন সংক্ষুব্ধ কণ্ঠ পুলিশের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়ে।
পাতাল-বাসের ভেতর শ্রান্ত শরীর ঝিমায়; প্রচণ্ড বেগে ধাবিত ভূগর্ভস্থ সমাধি_
সেও আমি জানি_পরিসংখ্যানহীন; এখন এই মুহূর্তে ওখানে কোনো ঘরে সুবার্ত বাজানো হচ্ছে।
আরো জানি, সেই সুর কারো জন্য অন্য যেকোনো সুরের চেয়ে বাস্তব হয়ে ধরা দিচ্ছে।

২.মনুষ্য-মস্তিষ্কের সীমাহীন পরিসর মুঠোর আকারে টুকরো হয়ে যায়।
এপ্রিলে আবাবিল পাখি ঠিক এই এলাকার এই গোলাবাড়ির
নালার নিচে আগের বছরের বাসায় ফিরে আসে। পাখিটা ট্রান্সভাল থেকে উড়তে উড়তে
বিষুবরেখা পার হয়ে, দুই মহাদেশের ওপর দিয়ে দুসপ্তাহ ধরে উড়ে
এই বিলীয়মান বিন্দুতে চলে আসে।
আর সমগ্র জীবন থেকে পঞ্চতারের মাত্র কয়েকটা তানে যে মানুষটি সংকেতকে ধরতে পারেন, যে মানুষটি সুচের আগায় নদী বইয়ে দিতে পারেন
তিনি হলেন ভিয়েনার এক সুঠামদেহী যুবক।
বন্ধুদের কাছে তাঁর পরিচয় 'মাশরুম' বলে; চশমা পরে ঘুমানো
আর পরদিন সকালে সোজা লেখার টেবিলে বসা ছিল তাঁর অভ্যাস।
তারপর তাঁর পাণ্ডুলিপির বিস্ময়কর বিচ্ছুগুলো গতি পেত।

৩.পঞ্চসংগীত গাওয়া হচ্ছে। আমি হেঁটে বাড়ি ফিরছি উষ্ণ বুনোপথে;
পায়ের তলায় ভ্রূণের মতো সংবেদী মাটি কুঁকড়ে উঠি, ঘুমিয়ে পড়ি,
ভবিষ্যতের ভেতর পলকা ওজনে জড়িয়ে যাই,
হঠাৎ মনে হয়, উদ্ভিদেরও চিন্তাশক্তি আছে।

৪.মাটির ভেতর ডুবে না গিয়ে দৈনন্দিন জীবনে শুধু বেঁচে থাকার জন্য আমাদের কতখানি বিশ্বাস রাখতে হয়!
গ্রামের ওপরে পাহাড়ের ঢালে জমে থাকা তুষারের ওপর বিশ্বাস করতে হয়। বিশ্বাস রাখতে হয় নীরবতার প্রতিজ্ঞার ওপর, বোঝাপড়ার হাসির ওপর; বিশ্বাস রাখতে হয় দুর্ঘটনার টেলিগ্রামটা আমাদের জন্য নয়।
আর বিশ্বাস রাখতে হয় ভেতর থেকে কুঠারের আঘাতটা আসবে না।
মনুষ্যাকৃতির ইস্পাতের তিনশ গুণ বেশি মৌমাছি গুঞ্জনের মাঝে আমাদের রাজপথে বহনকারী অক্ষদণ্ডের ওপরও বিশ্বাস রাখতে হয়।
তবে এগুলোর কোনোটাই আমাদের আত্মবিশ্বাসের সমান নয়।
পঞ্চতার বলে আমাদের অন্য কিছুর ওপর বিশ্বাস রাখা উচিত।
আর আমাদের পথের অনেকখানি তাদেরই সঙ্গ আমাদের সঙ্গী।
আর সময়ের সুইচ যখন ঘূর্ণ-কূপের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়, তখন আঙুলগুলো বিশ্বাসের সঙ্গেই অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাওয়া হাত-রেইলে ভরসা রাখে।

৫.পিয়ানোতে আমরা একে অন্যের গায়ে ঘষা খাই আর চার হাতে এফ মাইনর বাজাই;
একই গাড়িতে দুজন কোচোয়ান_দেখতে হাস্যকর।
মনে হয় হাতগুলো অনুনাদক ওজনকে এদিক-ওদিক চালনা করে যেন বিশাল সেকেলে বাহুর ভয়াবহ ভারসাম্যকে বিরক্ত করতেই আমরা বিপরীত ওজনকে বশে আনছি: আনন্দ আর দুর্ভোগ ঠিক একই সমান ওজনের।
অ্যানি বলেছিল, এই সংগীত কত বীরত্বপূর্ণ! তার কথাই ঠিক।
কিন্তু যারা কর্মী মানুষদের ঈর্ষার চোখে দেখে,
যারা খুনি হতে না পেরে আত্মগ্লানি বোধ করে
তারা নিজেদেরই চেনে না এখানে।
আর যারা মানুষ বিকিকিনি করে আর মনে করে সবাইকেই কেনা যাবে, তারাও নিজেদের চেনে না এখানে।
তাদের সংগীতকে নয়। যে দীর্ঘ সুর বিভিন্ন রূপান্তরে একই থাকে :
কখনো চোখধাঁধানো, কখনো সুখনম্য, কখনো কঠোর, কখনো ধীরগতির, কখনো ইস্পাতের তারের মতো। যে চিরন্তন গুনগুনধ্বনি আমাদের পিছে পিছে ফেরে, সেই ধ্বনি_এখন
গভীরতাগুলো তুলে আনার জন্য সক্রিয়।

No comments

Powered by Blogger.