বরিশালে বখাটেরা খুন করল মুক্তিযোদ্ধাকে-জিন্নাতের পাশে দাঁড়ায়নি পুলিশ

দেশকে হায়েনাদের কবল থেকে মুক্ত করতে একদিন তিনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র। দেশ স্বাধীন হলো। তারপর তিনি নামলেন আরেক লড়াইয়ে_মানুষ গড়ার সংগ্রামে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর যখন দেখলেন নিজের মেয়েই বখাটের উৎপাতের শিকার, তিনি তার প্রতিবাদ করলেন। আর এ প্রতিবাদ করাই কাল হলো তাঁর জন্য। পুলিশের উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে বখাটেরা ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁর ওপর। জীবন বাজি রেখে যে ভূখণ্ডকে তিনি
হায়েনামুক্ত করেছিলেন, সেই মাটির বুকে ঝরল তাঁর তাজা রক্ত। বখাটের ছুরির আঘাতে প্রাণ দিলেন মুক্তিযোদ্ধা জিন্নাত আলী (৫০)। তিনি বরিশালের এ ওয়াহেদ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের গণিত বিষয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন।

নিহত মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী শিরিনা বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, গত শুক্রবার সাড়ে ৮টার দিকে জিন্নাত আলী বরিশাল নগরীর সাগরদী বাজার থেকে তরকারি কিনে হেঁটে বাসার উদ্দেশে চান্দুর মার্কেটের দিকে যাচ্ছিলেন। বাসার মাত্র ৫০ গজ দূরে তিনি যখন উপকূল কিন্ডারগার্টেনের সামনে বরিশাল-ঝালকাঠি সড়কে তখন মোটরসাইকেল আরোহী দুই যুবক তাঁর পথরোধ করে। তারা জিন্নাত আলীর পেটে ঢুকিয়ে দেয় ছুরি। চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন জিন্নাত আলী। মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁকে শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করা হয়। অবস্থা সংকটজনক হওয়ায় গতকাল শনিবার বিকেলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। পথেই মারা যান জিন্নাত আলী। শিরিনা বেগম বলেন, চিকিৎসাধীন অবস্থায় জিন্নাত আলী বলে গেছেন, বখাটে রূপম ও তার সহযোগী হামলা চালায়।
এ ঘটনায় রূপম নামের এক বখাটের বোন ও তার সহযোগী আরিফুর রহমান মিঠুকে আটক করা হয়েছে। নিহত মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের অভিযোগ, মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার ঘটনায় জিন্নাত আলী কাউনিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন। কিন্তু পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি শুক্রবারের রাতের ঘটনায় গতকাল বিকেল পর্যন্ত থানায় মামলা কিংবা রূপমকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের দায়িত্বে থাকা উপপুলিশ কমিশনার মো. জিল্লুর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, সাধারণ ডায়েরি করার পরও পুলিশের ব্যবস্থা না নেওয়ার ঘটনায় একজন সহকারী পুলিশ কমিশনারকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শেবাচিম হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. আবদুর রহিম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ধারালো অস্ত্রের আঘাতে জিন্নাত আলীর খাদ্যনালির একটি অংশ ছিদ্র হয়ে যায় এবং একই সঙ্গে বেশ কয়েকটি ধমনি কেটে গেছে। এতে শরীর থেকে প্রায় সাত ইউনিট (ব্যাগ) রক্তক্ষরণ হয়। ধমনিগুলো সংযোজনের পাশাপাশি তাঁর শরীরে রক্ত দেওয়া হচ্ছিল। শেষমেশ গতকাল বিকেলে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। শুনেছি বরিশাল ত্যাগ করার পর জিন্নাত আলী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।'
অভিযুক্ত বখাটের নাম রূপম ঘোষ ওরফে রুপা ওরফে অনিক (২২)। জানা যায়, তার বোন তুলি বখাটেদের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে ২০০৭ সালে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। আত্মহত্যার প্ররোচণার দায়ে এক বখাটের বিরুদ্ধে রূপম মামলাও করেছিল।
জানা গেছে, শিক্ষক জিন্নাত আলী প্রায় সাত বছর ধরে চান্দুর মার্কেটের পাশেই একটি বাসায় স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ে বরিশাল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। তাকেই রূপম উত্ত্যক্ত করত।
জানা যায়, বরিশাল নগরীর বাজার রোড এলাকার সুলতানী বিড়ি ফ্যাক্টরির পেছনে প্রয়াত কৃষ্ণ চন্দ্র ঘোষের ছেলে রূপম ঘোষদের বাসা। সে জিন্নাত আলীর একাদশ শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়েকে কলেজে আসা-যাওয়ার পথে উত্ত্যক্ত করত। এর প্রতিবাদ করায় মেয়েটিকে অপহরণেরও হুমকি দেওয়া হয়। মাস দুয়েক আগে জিন্নাত আলী বিষয়টি কাউনিয়া থানার ওসিকে লিখিতভাবে (জিডি) জানিয়ে প্রতিকার চান। অভিযোগের কথা জানতে পেরে রূপম আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং শিক্ষকের পরিবারকে মুঠোফোনে হুমকি-ধমকি দেয়। মুঠোফোনে হুমকির বিষয়টি ধারণ করে তাঁর অডিও পুলিশকে শোনানোও হয়। এর পরও পুলিশ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এ সুযোগে রূপম আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
জিন্নাত আলীর ছোট মেয়ে কালের কণ্ঠকে বলে, 'আমি কলেজে আসা-যাওয়ার পথে রূপম আমাকে উত্ত্যক্ত করত। মোবাইলে ফোন করে হুমকি দিত, উল্টাপাল্টা কথা বলত। হামলার পরও সে ফোন করে জানতে চায় আমার বাবা মৃত না জীবিত।'
মেয়েটি আরো বলে, 'আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য রূপম প্রায়ই বাবাকে হুমকি দিত। এ নিয়ে একাধিকবার বাবা মোবাইল ফোনে ওকে সাবধান করে দেন।' মেয়েটি বলে, 'হাসপাতালে আমার বাবা বলেছেন যে সেই ঘটনার জের ধরে রূপম তাকে হত্যার উদ্দেশে হামলা করে। বাবা আমাকে বলেছেন, রূপম আর আরিফুর রহমান মিঠু হামলা করে মোটরসাইকেলযোগে পালিয়ে যায়।'
এ ব্যাপারে জানতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে রূপম কালের কণ্ঠকে জানায়, সে কখনো ওই মেয়েকে উত্ত্যক্ত করেনি। রূপম বলে, 'সরকারি বরিশাল কলেজ থেকে ২০১০ সালে এইচএসসি পাস করি। ওই মেয়ে যখন অষ্টম শ্রেণীতে তখন মুঠোফোনে তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওর বোন-জামাই জুবায়েরের বন্ধু ছাবি্বর হোসেন সম্পর্ক ভাঙতে আমাকে প্রকাশ্যে হুমকি দেয়। এর পর থেকে এক বছর ধরে ওর কিংবা পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই।'
রূপম আরো বলে, 'মাস দুয়েক আগে ওর বাবা কাউনিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি করলে পুলিশ আমাকে খুঁজতে বাড়িতে যায়। তখন আত্মগোপন করতে ঢাকার একটি খাবার হোটেল চাকরি নেই। বর্তমানে সেখানেই অবস্থান করছি। কিন্তু হামলার ঘটনায় আমাকে জড়ানোয় পুলিশ আমার বোনকে আটক করেছে।'
এদিকে রূপম ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তার দাবিতে গতকাল বিকেলে নগরীর রুপাতলী ও সাগরদী এলাকা উত্তাল হয়ে ওঠে। ওয়াহেদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে মুক্তিযোদ্ধা জিন্নাত আলীর লাশ দেখতে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পাশাপাশি র‌্যাবের টহলদল ছিল তৎপর। তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা রোকেয়া বেগম বলেন, 'আজ (শনিবার) চূড়ান্ত পরীক্ষা শুরু হয়েছে। তাই শিক্ষার্থীরা হামলার ঘটনায় প্রতিবাদ করতে পারেনি। তা ছাড়া আহত শিক্ষক মারা গেছেন বিকেলে। বিষয়টি শিক্ষার্থীরা অবগত নয়। তার পরেও আগামীকাল (রবিবার) বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হবে। এ ঘটনায় শিক্ষক, অভিভাবক আর শিক্ষার্থীরা মর্মাহত। তারা দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছে।'
জিডির বিষয়টি নিশ্চিত করে কাউনিয়া থানার ওসি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, 'ঘটনাস্থল কোতোয়ালি হলেও মেয়েটির পরিবার আমাদের থানায় জিডি করেছে। আমরা জিডিটি কোতোয়ালি থানায় পাঠিয়ে দেই।'
কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মো. শাহিদুজ্জামান বলেন, 'কাউনিয়া থানা থেকে এ ধরনের কোনো জিডি তদন্তের জন্য পাঠানো হয়নি। তিনি আরো বলেন, বখাটে রূপমের বোন ও তার সহযোগী আরিফুর রহমান মিঠুকে আটক করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। শুনেছি আহত শিক্ষক মারা গেছেন। তবে কেউ এখনো মামলা করেননি।'

No comments

Powered by Blogger.