সোনাবরু ও আমাদের বাস্তবতা by নাজমুল করিম ফারুক

রগুনা সদর উপজেলার কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের জাকিরতবক গ্রামের ১০ বছরের মেয়ে সোনাবরু। তিন ভাইবোনের মধ্যে সোনাবরু সবার ছোট। জাকিরতবক রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী ফেরদৌসী আক্তারই এই সোনাবরু। ২১ সেপ্টেম্বর সোনাবরুর জন্মদিন, ২১ সেপ্টেম্বর সোনাবরুর শেষ ক্লাস আর ২১ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যুদিন। ২০১১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রাতে সোনাবরু ভাত খেতে চেয়েছিল। চাল নেই ঘরে তাই রান্না হয়নি,


সোনাবরুর মুখে তাই ভাত জোটেনি। ২১ সেপ্টেম্বর মা আকলিমা বেগম সকালে ঘুম থেকে ওঠেই পাশের গুদিঘাটা গ্রামে বাপের বাড়িতে যান ভাই-ভাবীর কিছু গেরস্তালির কাজ করে দিতে। তার বিনিময়ে কিছু চাল এনে সন্তানদের নিয়ে খাবে বলে। মেয়ে সোনাবরু কিছু মুখে না দিয়েই স্কুলে চলে যায়। কারণ তার আজ দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হবে। ফলাফলে সোনাবরু প্রথম স্থান অর্জন করে। একই দিন শুভ জন্মদিন হওয়ায় ও ভালো ফলের আনন্দ ভাগাভাগি করতে সে স্থানীয় একটি দোকান থেকে ছোট্ট একটি কেক এনে স্কুলের শিক্ষক ও সহপাঠীদের নিয়ে স্কুলেই নিজের জন্মদিন পালন করে। স্কুল ছুটি হয়। সোনাবরু বাড়ি ফিরে দেখে মা নেই। হাঁড়িতে ভাতও নেই। বাপের বাড়ির গেরস্তালি কাজ শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায় মা আকলিমা বেগমের। বাড়িতে ঢুকে দেখেন জরাজীর্ণ ঘরের দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকেই দেখেন তার আদরের সোনাবরুর নিথর দেহ শূন্যে ঝুলছে। জন্মদিনেও ভাত নেই ঘরে! এই দরিদ্র মেয়েটি মানতে পারেনি। ফলে ফাঁকা বাড়িতে গলায় ফাঁস দেয় সোনাবরু।
পৃথিবীর বয়স যত বাড়ছে, বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়ভার, শুধু কমছে মানুষের দাম। বিগত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের মধ্যে অন্যতম ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম জনসাধারণের জন্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় তিন বছর হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বরং বিভিন্ন অজুহাতে বেড়েই চলেছে নিত্যপ্রয়োজনীয়সহ মানবজাতির প্রয়োজনীয় সব বস্তুর দাম। বেশি দিন হয়নি বাড়ানো হয়েছিল জ্বালানি তেলের দাম। এর সূত্র ধরে বাড়তে থাকে পরিবহন খাত থেকে শুরু করে মাছের দাম। কারণ মাছ বাজারে আনতে গেলে প্রয়োজন পরিবহন।
পবিত্র মাহে রমজান ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বাংলাদেশ ছাড়া অন্যান্য মুসলিম দেশে সব পণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশের অতি মুনাফালোভীরা কীভাবে সাধারণ মানুষকে চুষে খাবে অপেক্ষা করে ১১টি মাস। মাত্র কয়েক দিন আগে শেষ হলো অতি মুনাফালোভীদের রাজত্ব। তার রেশ কাটতে না কাটতে প্রতিটি পণ্যের লাগামহীন উচ্চমূল্যের ধকল সইতে না সইতে আবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার কারণে নতুন করে মূল্যস্টম্ফীতি, উৎপাদন খরচ ও জীবনযাত্রার ব্যয়ভারও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর সোনাবরুর মৃতদেহের সুরতহাল শেষে তার গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়। ১০ বছরের সোনাবরু প্রায়ই তার মাকে জিজ্ঞেস করত, মা আমরা এত গরিব কেন? সবার বাবা আছে, আমার বাবা নেই কেন? সোনাবরু নিজের গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে তার দারিদ্র্যকে জয় করেছে, পেয়েছে তার বাবার সাক্ষাৎ। কিন্তু এই আমরা যারা প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্যের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছি তারা কি আগামীতে স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারব, নাকি এক একটা সোনাবরু হবো?
হ কড়িকান্দি বাজার, তিতাস, কুমিল্লা

No comments

Powered by Blogger.