ইরানকে বোমা বানাতে বাধ্য করবে তারা by গাজীউল হাসান খান

ন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রভাব-প্রতিপত্তি সৃষ্টি কিংবা শক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপ কোনো জাতির জন্য ভবিতব্য হিসেবে কতটুকু কাজ করে তা বলা না গেলেও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও ইহুদিবাদী চক্রান্তের মুখে ইরানকে যে তারা ক্রমেই বেপরোয়া করে তুলছে, তা এখন বলাই বাহুল্য। ইরানের পারমাণবিক গবেষণা এবং জনকল্যাণমূলক কাজে তার শান্তিপূর্ণ ব্যবহারকে কেন্দ্র করে মূলত ইহুদিবাদী ইসরায়েলের চাপের মুখে


যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ও তাদের বশংবদরা এ রাষ্ট্রটিকে পর্যায়ক্রমে এমন এক অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে যে শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষার জন্য হলেও সে বিতর্কিত বোমাটি তৈরি করা ছাড়া হয়তো ইরানের আর কোনো বিকল্প থাকবে না। ইরান শুধু জ্বালানি উৎপাদনের জন্য পারমাণবিক চুলি্ল ব্যবহার করছে না, বরং গোপনে সেখানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে পারমাণবিক বোমা তৈরি করার উদ্দেশে। আর সে বোমা আক্রমণের সামরিক লক্ষস্থল হচ্ছে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল। মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা পরাশক্তির প্রতিভূ ইসরায়েলকে ধ্বংস করাই নাকি ইরানের পারমাণবিক বোমা তৈরি করা একমাত্র উদ্দেশ্য। অথচ ইসরায়েলই বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র পারমাণবিক শক্তির অধিকারী রাষ্ট্র। এ কথা এখন প্রমাণ করার অপেক্ষা রাখে না যে ইসরায়েলের কাছে বিভিন্ন ধরনের ২০০ থেকে ৪০০ পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। সেটি তদন্ত করার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) কোনো তাগিদ নেই। ফিলিস্তিনের দখলদার ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো উড়িয়ে দেবে বলে আক্রমণের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে বারবার। অন্যদিকে সে হুমকি প্রশমিত করার চেষ্টা না করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিগুলোর চাপে আইএইএ কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়াই ইরানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক বোমা তৈরির কাজ এগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ এনেছে তার বিতর্কিত ও বহুল আলোচিত প্রতিবেদনে।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর ইহুদিবাদী ইসরায়েলের আক্রমণের উপর্যুপরি হুমকির বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ জানিয়েছে রাশিয়া। একে একে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ, প্রধানমন্ত্রী পুতিন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেভরেভ বলেছেন, ইসরায়েলের ইরান আক্রমণের পরিণাম ভালো হবে না। তা ছাড়া ইরানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আর কোনো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারির বিরুদ্ধেও রাশিয়া সুস্পষ্টভাবে মত প্রকাশ করেছে। একই ধারায় মতামত দিয়েছে চীন এবং ন্যাটোর প্রভাবশালী সদস্য তুরস্ক। আগামী বছর অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের বিত্তশালী ইহুদি সম্প্রদায় এবং বিশেষ করে প্রভাবশালী আমেরিকান ইসরায়েলি লবিকে খুশি করার জন্য প্রেসিডেন্ট ওবামা ইসরায়েলের পক্ষে নির্লজ্জভাবে যত কথাই বলুন না কেন, আফগানিস্তান ও ইরাকের পর অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বর্তমানে ইরান আক্রমণের কোনো ক্ষমতাই নেই। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের এ কথাটিও ভালো করে জানা আছে, এ মুহূর্তে তারা যদি ইরান আক্রমণ করে তবে আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে জীবিত অবস্থায় খুব বেশি মার্কিন সৈন্য দেশে ফিরে আসবে না। সেখানেই তাদের প্রাণ দিতে হবে স্থানীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী, আল-কায়েদা জঙ্গি ও তালেবানের হাতে। তা ছাড়া ইরান আক্রমণের ফলে একমাত্র সৌদি আরব ছাড়া সমগ্র মুসলিম বিশ্ব যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু সৌদি আরব। তারা মনেপ্রাণে চায় না রাজতন্ত্রবিরোধী শিয়া অধ্যুষিত ইরান পারমাণবিক বোমা কিংবা অধিকতরভাবে সে ধরনের সমরাস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হোক। এ ব্যাপারে একদিকে ইহুদিবাদী ইসরায়েলের অসামান্য চাপ এবং অন্যদিকে প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র সৌদি আরব, এমনকি জর্দানের বাদশাহর চরম উসকানির মুখেও ওবামা রাজি হননি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার ওপর আঘাত হানতে। ওবামা ভালো করেই জানেন, তাঁর শেষ পরিণতি কী হবে। সে কারণেই তথাকথিত যুদ্ধবিরোধী ওবামা লিবিয়ায় ফরাসি ও ব্রিটিশ যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে এবং শেষ পর্যন্ত ন্যাটো বাহিনীকে দিয়ে আক্রমণ চালালেও সরাসরি মার্কিন বাহিনীর নেতৃত্বে কোনো আক্রমণ পরিচালনা করেননি। সেটিই ছিল ইসরায়েলের দক্ষিণপন্থী মোর্চার প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কাছে ওবামার একমাত্র যুক্তি ও তুরুপের কার্ড।
গত সপ্তাহে ইউরোপে পরিচালিত একটি জনমত জরিপে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নিরপেক্ষ মানুষ মত প্রকাশ করেছে যে ইসরায়েলই বিশ্বের নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ, ইরান নয়। কারণ যে ফিলিস্তিনের মুক্তির প্রশ্নে এত কিছু ঘটছে, ইসরায়েল তার কোনো সুরাহা না করে বরং অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে (আল কুদস) ইহুদিদের জন্য আরো নতুন বসতি স্থাপনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। তা ছাড়া রামাল্লায় একটি বিদ্যালয়সহ ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে ইসরায়েলের নিরাপত্তার প্রশ্নে। দখলকৃত ফিলিস্তিনের পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীরে যেসব নিত্যনতুন বসতি স্থাপন করা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক আইনে তার সবই অবৈধ। ইসরায়েলের দক্ষিণপন্থী মোর্চার বর্তমান সরকার এখনো বুঝতে পারছে না, কোনো অবস্থায়ই তারা আর ফিলিস্তিনকে গ্রাস করতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে বিভিন্ন ইহুদিবাদী ফাঁদে ফেলে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি আপাতত যতই ঠেকিয়ে রাখা হোক না কেন, সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যখন চারদিক থেকে ইসরায়েলকে একঘরে করে ফেলা হবে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সমর্থন করতে বাধ্য হলেও সারা বিশ্ব স্বাধীন ও সম্পূর্ণ অবরোধমুক্ত ফিলিস্তিনের পক্ষে। ফিলিস্তিনের মুক্তির ব্যাপারে আর যেকোনো আরব কিংবা অনারব মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রের ভূমিকা যাই হোক, ইরানের ভূমিকা অত্যন্ত পরিষ্কার। ইরান কোনো অবস্থায়ই ফিলিস্তিনের কোনো স্বার্থের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ হয়ে নতজানু ভূমিকা পালন করেনি। সে কারণেই ফিলিস্তিনের আপসহীন রাজনৈতিক সংগঠন 'হামাস' ও লেবাননের জঙ্গি সংগঠন 'হিজবুল্লাহ' ইরানের পক্ষে শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে, যা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের চক্ষুশূলের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা মনে করে, ইরান হিজবুল্লাহ ও হামাসকে অর্থ সাহায্যসহ প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে। তাই ইরাকের পর ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের সার্বিক নিরাপত্তার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন চেয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যে আরো তিনটি রাষ্ট্রের সরকার পরিবর্তন করতে। সে তিনটি রাষ্ট্র হচ্ছে_লিবিয়া, সিরিয়া ও ইরান।
ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল মনে করত, ইরাকের পর মধ্যপ্রাচ্যের এ তিনটি রাষ্ট্র ভবিষ্যতে তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
শান্তিপূর্ণ কাজে পরমাণু শক্তি ব্যবহারের নামে ইরান বোমা তৈরি করার কর্মসূচি দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছে বলে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থাকে (আইএইএ) মনগড়া বিভিন্ন তথ্য দিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল বলে অভিযোগ করেছিল ইরান।
গত ৮ নভেম্বর সেসব তথ্যের ভিত্তিতে আইএইএ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যাতে আন্তর্জাতিক মহলের বেশ কিছু বিতর্ক দেখা দেয়; কিন্তু তাতেও থেমে থাকেনি ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা মিত্রদের তৎপরতা। তারা গত ১৮ নভেম্বর ৩৫ সদস্যের আইএইএর জেনেভা সদর দপ্তরে সে প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ইরানের বিরুদ্ধে একটি নিন্দা প্রস্তাব পাস করেছে। সে প্রস্তাবে পরমাণু কর্মসূচির ব্যাপারে ইরানের বর্তমান অবস্থান সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়সূচি বেঁধে দেওয়া না হলেও আগামী সপ্তাহে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে আয়োজিত আইএইএর বৈঠকে ইরানকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। ইরানের বিরুদ্ধে একতরফাভাবে অনেকটা গায়ের জোরেই নিন্দা প্রস্তাব পাস করার অভিযোগে তারা নিউ ইয়র্কে আয়োজিত সে বৈঠকে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ইরানের পরমাণু কর্মসূচির সামরিক উদ্দেশ্য রয়েছে বলে যে পশ্চিমা অপপ্রচার রয়েছে, তার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ইহুদিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের সমালোচনা করেছেন। আইএইএ বলেছে, বিভিন্ন অভিযোগের বিরুদ্ধে ইরানের সঙ্গে তাদের আলোচনা অত্যন্ত গভীর ও জোরদার হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু ইরান বলেছে, সংস্থা ও তার সদস্যরা ইরানের প্রদত্ত কোনো বক্তব্যই আমলে নিচ্ছে না এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাদের সব কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে লাভ কী? ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভারের বিরুদ্ধে আইএইএর কোনো অভিযোগ নেই; নেই কোনো তদন্তের উদ্যোগ বা প্রস্তাব। অথচ জ্বালানি উৎপাদন ও চিকিৎসাক্ষেত্রে গবেষণার লক্ষ্যে গৃহীত ইরানি পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য তার স্থাপনাগুলোর ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা চলছে। অন্যরা যাই করুক ইহুদিবাদী ইসরায়েল শেষ পর্যন্ত ইরানকে ছাড়বে না। যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড়ে চেপে বসা সিন্দাবাদের কুৎসিত বুড়ো দৈত্যের মতো সময় ও সুযোগ বুঝে একদিন ইরাকের অসিরাক পারমাণবিক প্রকল্পের মতো ইরানের স্থাপনাগুলোতেও আঘাত হানবে ইহুদিবাদীরা। তার প্রেক্ষাপটে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা চাপে ক্রমেই একঘরে হয়ে যাওয়া ইরানের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই। ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তর নিরাপত্তা ও শান্তির প্রশ্নে তাই জরুরিভাবে ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইহুদিবাদী ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উপর্যুপরি হুমকিই ইরানকে শেষ পর্যন্ত বাধ্য করবে বোমা তৈরি করতে। তা ছাড়া ইরানের আর গত্যন্তর থাকবে না।
লন্ডন, ২০ নভেম্বর, ২০১১
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.