প্রবীণ দিবস-সমাজে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের অবস্থান

অক্টোবর বিশ্ব প্রবীণ দিবস। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত শতাব্দীতে মানুষের গড় আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছিল ৬০ বছর। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু ৬৫-৭০ ঘোষণার আয়োজন চলছে। বলা বাহুল্য, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে চলেছে প্রবীণ-প্রবীণা অর্থাৎ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সংখ্যা। আর বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা নানা কারণেই অসুখী জীবন যাপন করেন। বিশেষ করে বাংলাদেশে বিভিন্ন অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে


চাকরি-বাকরি করে যাঁরা অবসর গ্রহণ করছেন_দেখা যাচ্ছে তাঁদের অধিকাংশের কর্মক্ষমতা, মনোবল এবং তুলনামূলক দৈহিক স্বাস্থ্যের প্রাচুর্য থেকে যাচ্ছে। কর্মক্ষমতা অটুট থাকা সত্ত্বেও জোর করে ঘরে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তখন হতাশা, অবসাদ ও নিঃসঙ্গবোধ তাঁদের দেহ-মনে জন্ম দিচ্ছে নতুন নতুন অসুখ-বিসুখ। পাশাপাশি আমাদের দেশে যৌথ পরিবারপ্রথা ভেঙে যাওয়ার ফলে অধিকাংশ পরিবারে এখন মা-বাবা ও দাদা-দাদিরা অবাঞ্ছিত মানুষ। অবসর গ্রহণের পর অধিকাংশ পরিবারে এসব মা-বাবা ছেলে-পুত্রবধূদের কাছে হয়ে পড়েন বোঝাস্বরূপ। পেনশনের কিছু টাকা সম্বল করে তাঁদের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা দোলায়িত হয়। প্রত্যেকের এ অবসর জীবন আবর্তিত হয় দুঃখ, শোক, অভিমান এবং দুঃসহ নৈরাশ্যের কত ঘটনা, উপঘটনায়। প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটির টাকা মেয়ের বিয়ে, জমি কেনা ও বাড়ি তৈরিতে খরচ হয়ে যায়। অথচ সব শেষে সেই স্বপ্নের বাড়ি ছেড়ে অবসরপ্রাপ্ত অনেক মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিতে হয়। একরকম বিনা চিকিৎসায় অবহেলা-অনাদরে তাঁদের মৃত্যুবরণ করতে হয়।
বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের এসব সমস্যা সমাধানে পাশ্চাত্য এবং এশিয়ার জাপান, চীন ইত্যাদি দেশ নানা রকম পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। উচ্চহারে ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে বৃদ্ধাশ্রম পরিচালনা, সরকারি চিকিৎসালয়গুলো বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা, বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর স্থানে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সুখকর ও আরামপ্রদ ভ্রমণের কার্যসূচি, অবসর বিনোদন এবং ধর্মচর্চার জন্য বিশেষ আয়োজন ইত্যাদির ব্যবস্থা করে প্রবীণ-প্রবীণাদের অবসাদগ্রস্ততা অনেকাংশে লাঘব করেছে সেসব দেশ। কিন্তু আমাদের দেশে এ ক্ষেত্রে সরকারের ভাবনাচিন্তা নিতান্তই অপ্রতুল। সারা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের দেশে প্রবীণদেরও 'ভুলে যাওয়া' বা ডিমেনশিয়া এবং আলঝেইমার রোগের প্রকোপ বাড়ছে। বলাবাহুল্য, এ রোগ প্রবীণ-প্রবীণাদের শেষ জীবন আরো জটিল ও সমস্যাকীর্ণ করে তোলে। এ রোগ থাবা বসায় বিচার-বিবেচনা শক্তি, মস্তিষ্কের শক্তি-ক্ষমতা এবং চিত্তবৃত্তির প্রতিক্রিয়ার ওপর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাই ডিমেনসিয়াকে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত অগ্রাধিকার বলে ঘোষণা করেছে। গত ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আলঝেইমার্স দিবস উপলক্ষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ ঘোষণাকে সারা বিশ্বে আবার নতুন শপথে উদ্দীপ্ত করা হয়েছে। ঘোষণায় বলা হয়েছে, প্রথমে এ রোগ ও সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। ডিমেনসিয়ায় আক্রান্ত অতি বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পরিচর্যার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষিত নার্সের ব্যবস্থা জরুরি। আক্রান্তদের নিয়ে নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য চাই উপযুক্ত ব্যবস্থাসহ ডে-কেয়ার এবং রেসপাইট সেন্টার। বলা বাহুল্য, আমাদের দেশে এ রোগে আক্রান্তের জন্য উলি্লখিত ব্যবস্থার কোনোটি এখন পর্যন্ত নেই। তাই ডিমেনসিয়ায় আক্রান্তদের চিকিৎসা সাধারণ হাসপাতাল ও নার্সিং হোমে সাধারণ রোগীদের সঙ্গে করা হয়। ফলে রোগের উপশম অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয় না।
এমনিতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সমাজে তথা পরিবারে আজ কোণঠাসা হয়ে রয়েছেন, আলঝেইমারের আক্রমণে স্মৃতিভ্রষ্ট হলে তাঁরা সমাজচ্যুত এবং একঘরে হয়ে পড়বেন। সেই ভয়ংকর অবস্থা থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বাঁচানোর জন্য আজ সরকার এবং স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষভাবে ভাবতে হবে।
আফতাব চৌধুরী

No comments

Powered by Blogger.