বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর দুর্দিন-প্রদীপের নিচের অন্ধকার দূর হোক

ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষা অর্জন যেমন সাধনার ফল; এর আলো ছড়ানোর বিষয়টিও বরাবর ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর। এ দেশের শিক্ষাগুরুরা বিদ্যার মুক্তো ছড়িয়ে দিতে গিয়ে বিত্তের খেই হারিয়ে ফেলাতেই গৌরব খুঁজে পেয়েছেন। কেবল শিক্ষকের ত্যাগ ও শিক্ষার্থীর সাধনা নয়; গঙ্গা-যমুনা প্রবাহিত এই ভূখণ্ডে শিক্ষাদান প্রক্রিয়া ছিল নেহাতই অবাণিজ্যিক। কিন্তু এসব প্রাচীনকালের কথা। এখন আর শিক্ষা সমাজের দু'একজনের ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও


আত্মত্যাগের বিষয় নয়। শিক্ষার জাতীয়করণও ঘটেছে। নাগরিকের শিক্ষার সিংহভাগ দায়িত্ব এখন রাষ্ট্রের কাঁধে। কিন্তু সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়ভার সর্বাংশে বহন করা তৃতীয় বিশ্বের একটি রাষ্ট্রের পক্ষে বাস্তবসম্মতও নয়। এও মনে রাখতে হবে, গত কয়েক দশকে যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তেমনি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে বহু গুণ। আর সরস্বতীর সঙ্গে লক্ষ্মীর মিলনও লক্ষণীয়। শিক্ষা এখন স্বাস্থ্যের পরই সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক খাত। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই বাণিজ্যিক সুবিধার কতটুকু এর সঙ্গে জড়িত শিক্ষক-কর্মচারীরা পাচ্ছেন? শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের পক্ষে-বিপক্ষে প্রবল মত রয়েছে; কিন্তু এর আর্থিক সুফল যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীরা পাচ্ছেন না, সে ব্যাপারে দ্বিমতের অবকাশ সামান্যই। গ্রামীণ জনপদের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের অবস্থা আরও করুণ। তারা না পাচ্ছেন সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সুযোগ-সুবিধা; না পাচ্ছেন শহুরে বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার মতো বাণিজ্যিক সুফল। শুক্রবার সমকালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে তাদের দুর্দিনের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
জানা যাচ্ছে, গত কয়েক বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম, বাড়ি ভাড়াসহ জীবনযাত্রার ব্যয় কয়েকগুণ বাড়লেও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সেই হারে বাড়েনি। উপরন্তু সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন আর্থিক সুযোগ-সুবিধা। এমপিওভুক্ত নয় এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের মাস শেষে নির্ভর করতে হয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায়ের ওপর। সমাজে যারা শিক্ষার আলো বিতরণ করে চলেছেন, যারা জাতির মেরুদণ্ড শক্ত রাখার ব্রতে নিয়োজিত, তাদের এমন আর্থিক দৈন্য সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীর বাড়ি ভাড়া হিসেবে ১০০ টাকা কিংবা চিকিৎসা ভাতা হিসেবে ১৫০ টাকা বরাদ্দ এই বাজারে উপহাস ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। এমপিওভুক্তির অনিয়মিত প্রক্রিয়া বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য গলার ফাঁসে পরিণত হয়েছে। তারা না পারছেন অন্য পেশায় যেতে, না পারছেন শিক্ষকতায় টিকে থাকতে। আমরা জানি, আমাদের মতো দেশে সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই বলে শিক্ষকদের এমন দুর্দশা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। নিয়মিত এমপিওভুক্তি প্রক্রিয়া এবং শিক্ষকদের বেতন-ভাতা অন্যান্য পেশার সঙ্গে সামঞ্জস্য করার উদ্যোগ নিলেই পরিস্থিতির নিঃসন্দেহে উন্নতি ঘটবে। শিক্ষকদের পৃথক বেতন স্কেল গঠনের যে কথা মাঝে মধ্যেই শোনা যায়, তাও যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করা হবে বলে প্রত্যাশা। আমরা জানি, বর্তমান সরকার শিক্ষার মান উন্নয়নে যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়নসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু শিক্ষকদের সুদিন ফিরে না এলে সব উদ্যোগই ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেসব প্রদীপ সমাজে আলো জ্বালাবে, তাদের নিচের অন্ধকার দূর করার ক্ষেত্রে অবহেলার অবকাশ নেই।
 

No comments

Powered by Blogger.